সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশ ।। Origin and development of sociology

সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশ

বলা হয় কিছু মানবিক, নৈতিক মতবাদ ও প্রকৃতির সংমিশ্রণই সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তির কারণ। অনেকের মতে, দু'টি বিশেষ প্রবৃত্তি- সংস্কারের ও সমাজ উন্নতির প্রতি আগ্রহ এবং ইতিহাস দর্শনের প্রতি কৌতুহল থেকে সমাজবিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে সমাজবিজ্ঞান রাষ্ট্রীয় দর্শন, ইতিহাসের দর্শন, জীববিজ্ঞানের বিবর্তনবাদ এবং সামাজিক জরিপ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। 
তবে সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভবের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। 

কিন্তু সমাজব্যবস্থা ও সমাজজীবনকে জানার ও বুঝার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে চিন্তার আদি উন্মেষ থেকে। সমাজ সম্পর্কে চিন্তা ভাবনার ইতিহাস সমাজের মতোই প্রাচীন। মূলত সমাজজীবনের সমস্যা সম্পর্কিত চিন্তা - ভাবনার সূত্রেই আবির্ভাব ঘটেছে সমাজবিজ্ঞানের। তবে শুরুর দিকে মুখ্য বিষয় হিসেবে নয় বরং আনুসঙ্গিক বিষয় হিসেবেই সমাজ সম্পর্কিত চিন্তা - ভাবনা শুরু হয়েছিল। আর একটি আলাদা বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের জন্ম মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পাশ্চাত্য শিল্প বিপ্লব ও রাজনৈতিক সামাজিক বিপ্লবের যুগে। 

একটি আলাদা বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠায় কয়েকজন বিশেষ চিন্তাবিদদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান রয়েছে : 
গ্রিক দার্শনিক (Greek philosopher): পাশ্চাত্য সমাজে সর্বপ্রথম গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে সমাজ সম্পর্কে ধারাবাহিক চিন্তা চেতনা ও বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা লক্ষ করা যায়। মানব চিন্তার দুই প্রধান নায়ক প্লেটো ও এরিস্টটল। সামাজিক জীবন সম্বন্ধে সুসংবদ্ধ চিন্তাভাবনা পাশ্চাত্যে তাদের দ্বারাই শুরু হয়। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা গভীর কল্পনাশ্রয়ী চিন্তা ভাবনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। 
গ্রিক দার্শনিক প্লেটো (Plato) তার "The Republic" গ্রন্থে আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান। তার ছাত্র এরিস্টটল (Aristotle) "The Politics" গ্রন্থে সামাজিক সমস্যার ক্ষেত্রে অধিকতর বাস্তববাদিতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি মূলত যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সরকারের শ্রেণিবিভাগ ও একটি আদর্শ সামাজিক ব্যবস্থার রূপায়ণে সচেষ্ট হয়েছিলেন। 
সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশ

ইবনে খালদুন (Ibn Khaldun): ত্রয়োদশ শতকের বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে খালদুন তার 'আল - মুকাদ্দিমা' গ্রন্থে সমাজের গতিবিধি এবং সমাজ জীবনে বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিসমূহের ব্যাখ্যা দেন। তিনি সামাজিক ঘটনাবলি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে 'Umran' বা 'Umaranayat' প্রত্যয়টির উল্লেখ করেন। এটি সমাজবিজ্ঞানের প্রতিশব্দ হিসেবে পরিচিত। তার মতে , প্রাকৃতিক ঘটনাবলির মতোই সমাজজীবনও কতকগুলো নিয়ম দ্বারা পরিচালিত। ফলে অতীত ঘটনার দলিল ও বর্তমান ঘটনা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক ঘটনাবলিকে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হন। তিনি রাষ্ট্রের উৎপত্তির মূলে ‘সামাজিক সংহতি' ও দ্বন্দ্বের ভূমিকাসহ রাষ্ট্রের উত্থান - পতনের ব্যাখ্যা দেন। তিনি সমাজজীবনে ভৌগোলিক উপাদানের প্রভাব বিষয়ক তত্ত্বেরও প্রবক্তা। সমাজবিষয়ক তার এ সব চিন্তা - ভাবনার কারণে এ . কে . নাজমুল করিমসহ অনেকেই তাকে সমাজবিজ্ঞানের আদি জনক হিসেবে অভিহিত করেন। 

ম্যাকিয়াভেলি (Machiavelli): ষোড়শ শতকের ইতালির অন্যতম চিন্তাবিদ "The Prince" গ্রন্থের রচয়িতা নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি (Niccolo Machiavelli) যে সমাজ দর্শন প্রচার করেছেন তার প্রধান ভিত্তি হলো মানব প্রকৃতি ও মানব দর্শন। তার মতে , মানুষ প্রকৃতিগতভাবে দুষ্টু। মানুষের একটি বৈশিষ্ট্য হলো তার থেকে শক্তিশালী কোনো শক্তির দ্বারা বাধ্য না হলে সে ভালো কিছু করতে চায় না। মানুষের মধ্যে একইসাথে স্বার্থপরতা এবং কলহপ্রিয়তা বিদ্যমান। এক কথায় মানুষের লোভ - লালসা সীমাহীন, যে কারণে মানুষের মধ্যে সর্বদাই দ্বন্দ্ব - কলহ বিদ্যমান এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত নিয়মনীতি দ্বারা বাধ্য না হলে গোটা সমাজজীবনকেই ব্যহত করতে চায়। 

টমাস মুর (Thomas Moore): ম্যাকিয়াভেলির পরে একই যুগের আরেকজন চিন্তাবিদ হলেন স্যার টমাস মুর ( Thomas Moore )। তিনি তার "Utopia" নামক গ্রন্থে মানুষের দৈনন্দিন সামাজিক সমস্যার সমাধান করে একটি আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান। তিনি এ গ্রন্থে যে পূর্ণ রাষ্ট্রের চিত্র এঁকেছেন তার মাধ্যমে সকল সমাজের সমস্যার সমাধান এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ ন্যায়ের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন প্রকৃতির নিয়ম - শৃঙ্খলাকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে সঠিকভাবে মেনে চলার মাধ্যমে একটি নিখুঁত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।  

ভিকো (Vico): ইতালির দার্শনিক জিয়ামবাতিস্তা ভিকো ( Giambattista Vico ) পাশ্চাত্যে প্রথম ইতিহাস দর্শনের বৈজ্ঞানিক আলোচনার ভিত্তি স্থাপন করেন । যার নাম 'The New Science'। তিনি তার 'The New Science'- এ জাতিসমূহের সাধারণ প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন , মানুষের গবেষণার উপযুক্ত ক্ষেত্র হবে মানুষ। তিনি এটাও মনে করতেন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনাবলি বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার উপযুক্ত বিষয়। ভিকোর মতে, সমাজ কতকগুলো সুনির্দিষ্ট নিয়মের অধীন এবং বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ ও পাঠের মাধ্যমে সমাজ বিকাশের সূত্রাবলিকে আবিষ্কার করা যায়। এছাড়া ভিকো সমাজ পরিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা: 
ক. দেবতার যুগ; 
খ. বীর যোদ্ধাদের যুগ; 
গ. মানুষের যুগ। 
তিনি তার ইতিহাস দর্শনে মানব ইতিহাসের ধারার মূল কারণ খুঁজতে গিয়ে মানবসমাজের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে যে সব আলোচনা করেছেন তা এ যুগের বিচারে সমাজবিজ্ঞানের পর্যায়ে ফেলা যায়। 

মন্টেস্কু (Montesquieu): ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু তার ' The Spirit of Laws ' গ্রন্থে সামাজিক সমস্যার বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। সমাজ গবেষণার ক্ষেত্রে তার অবদান ভিকোর থেকে বেশি বলে মনে করা হয়। তিনি মানবসমাজ বিকাশে ভৌগোলিক উপাদানের ভূমিকা নিয়েও আলোচনা করেছেন। 

কঁদরসে (Condorcet): ফরাসি দার্শনিক কঁদরসে সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি তার 'Historical Human Mind' গ্রন্থে সমাজ পরিবর্তনের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছিলেন যা পরবর্তীকালে সমাজতান্ত্রিক মতবাদের বিকাশে সুদুরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল। উপরে উল্লিখিত মনীষীরা রাষ্ট্রচিন্তা, সমাজচিন্তা ও দর্শনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও তাদেরকে সমাজবিজ্ঞানের পূর্বসূরিদের দলে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। কেননা সমাজচিন্তার আলোচনার সূত্রপাত অনেক আগে ঘটলেও একটি আলাদা বিষয় হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের জন্ম মূলত পাশ্চাত্যের শিল্প ও ফরাসি বিপ্লবের ফলে।

 সাইমন ও কোঁৎ (Simon and Comte): ফরাসি চিন্তাবিদ সেইন্ট সাইমন (Saint Simon) শ্রমিক শ্রেণির দুঃখ - দুর্দশা - দেখে বিচলিত হন এবং তা মোচনের জন্য একটি নতুন বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। তিনি সমাজ বিকাশ ও সমাজ পরিবর্তনের একটি নকশা তৈরি করেন। সে নকশা অনুসরণ করে তার ছাত্র অগাস্ট কোঁৎ (Auguste Comte) সমাজ সম্পর্কিত নানা লেখালেখি শুরু করেন এবং ১৮৩৯ সালে সর্বপ্রথম Sociology শব্দটি ব্যবহার করেন। এ কোঁৎকেই আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের জনক বলে অভিহিত করা হয়। তার বিশেষ কৃতিত্ব হলো তিনি 'Sociology' শব্দটির জনক এবং এই বিজ্ঞানের পরিধি ও গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দেন। 

১৮৩০ থেকে ১৮৪২ সালের মধ্যে কোঁৎ এর বিখ্যাত গ্রন্থ Positive Philosophy ৬ টি খণ্ডে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটিতে তিনি মানব জ্ঞান বিকাশের ধারা সম্পর্কে একটি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান। তার মতে , মানুষের সকল চিন্তা - চেতনা, ধ্যান - ধারণাসমূহ জ্ঞানের সকল শাখা এবং পৃথিবীর সকল সমাজসমূহ অত্যাবশ্যকীয়ভাবে তিনটি পর্যায় পার করে এসেছে এবং বস্তুগত ও অবস্তুগত উভয় বিষয়েই তা প্রযোজ্য। তিনি এ তিনটি পর্যায়ের প্রত্যেকটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তিন ধরনের সামাজিক অবস্থার বর্ণনা দেন। এ তিনটি পর্যায় হলো: ধর্মতাত্ত্বিক পর্যায়, অধিবিদ্যাগত পর্যায় ও দৃষ্টবাদী পর্যায়; আর তার মানব জ্ঞানের এই তিনটি পর্যায়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তিন ধরনের সামাজিক ব্যবস্থা হলো-
ক. সামরিক সমাজ (Military society);
খ. আইনগত সমাজ (Legal society); 
গ. বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ (Scientific society)
এছাড়া আরও তিনজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদের নাম উল্লেখ করা যায় , যারা পেশাদার সমাজবিজ্ঞানী না হয়েও সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে মূল্যবান অবদান রেখেছেন। এরা হলেন : 

কার্ল মার্কস (Karl Marx): জার্মান দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্কস বিশ্বাস করতেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা সকল দ্বন্দ্ব - সংঘাত ও শোষণের মূলে কাজ করে। তিনি শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ গঠনে আগ্রহী ছিলেন এবং এ বিষয়ে নানা মতবাদ দেন। তার মতে , প্রতিটি সমাজের মধ্যে শোষিত ও শোষক এ দুটি শ্রেণি বিদ্যমান। এই দুই শ্রেণির সংগ্রামের ফলে সামাজিক পরিবর্তন ঘটে। অগাস্ট কোঁৎ যেমন তার চিন্তাধারায় মানব বিবর্তনের কালসমূহকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছিলেন; কার্ল মার্কসও তেমনি মানব ইতিহাসের স্তরকে ভাগ করেছেন অর্থনৈতিক যুগভেদের মাধ্যমে এবং তিনি পাঁচটি উৎপাদন পদ্ধতি নির্ধারণ করেন। যথা- 
ক. আদিম সাম্যবাদ; 
খ. দাসপ্রথা; 
গ. সামন্তবাদ ; 
ঘ. পুঁজিবাদ ও 
ঙ. সমাজতন্ত্র। 
এছাড়া এশিয়াতে উৎপাদন পদ্ধতি ইউরোপীয় উৎপাদন পদ্ধতি থেকে ভিন্ন হওয়ায় তার নাম দেন এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি। 

চার্লস ডারউইন (Charles Darwin): ইংরেজ প্রকৃতিবিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন (Charles Darwin) - এর বিখ্যাত "The Origin of Species" ( 1859 ) গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার সময় থেকেই বিবর্তন সম্পর্কে জীববিজ্ঞানের পঠন - পাঠন ও গবেষণার কাজ শুরু হয়। তিনি জীব জগতের বিবর্তন ধারা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যোগ্যতমের টিকে থাকা (Survival for the fittest) ও টিকে থাকার সংগ্রাম (Struggle for existence) সূত্র দু'টির জন্ম দেন। তার মতে, জীবনযুদ্ধে যোগ্যতমরাই টিকে থাকে। আর অক্ষম ও দুর্বলরা প্রকৃতির নিয়মেই বিলুপ্ত হয়। 

হার্বার্ট স্পেন্সার (Herbert Spencer): ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী হার্বার্ট স্পেন্সার নিজেকে সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মনে করতেন এবং এই নতুন বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টাও চালিয়েছেন। তার এই বিজ্ঞান সামাজিক জীবন ও কার্যাবলি সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। তিনি মনে করতেন, প্রকৃতির মতো সমাজের জন্য একটি আলাদা বিজ্ঞানের প্রয়োজন এবং তা সম্ভব। তিনি চার্লস ডারউইনের দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ডারউইনকে অনুসরণ করে স্পেন্সার জীবদেহের সাথে সমাজদেহের তুলনা করে সামাজিক বিবর্তন সংক্রান্ত আলোচনার সূত্রপাত করেন। তিনি বলেন, মানবসমাজ একটি সহজ ও সরল অবস্থা থেকে বিবর্তিত হয়ে একটি জটিল অবস্থায় রূপান্তরিত হয়। 

সিগমান্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud): অস্ট্রিয়ান মনোবিশ্লেষক সিগমান্ড ফ্রয়েড সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, মানুষ সমাজে বাস করে এবং সমাজের কার্যকলাপ তার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। ফ্রয়েড তার সহজাত জৈবিক প্রবৃত্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখে সমাজের সূত্র ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছেন। তার মতে, মানুষ দলবদ্ধ সমাজব্যবস্থায় পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং শাসিত। এছাড়া ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী ফ্রেডারিক লো প্লে (Frederic Le Play), আমেরিকান সামাজিক নৃবিজ্ঞানী লুইস হেনরি মর্গান (Lewis Henry Morgan) এবং ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড বার্নেট টেইলর ( Edward B. Tylor ) প্রমুখ সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে অবদান রাখেন। 

ফ্রেডারিক লো প্লে (Le play): ফরাসি গবেষক লো প্লে (Frederic Le Play) সমাজবিজ্ঞানের প্রাথমিক উৎপত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে তিনি কর্মজীবী শ্রেণির মানুষের পারিবারিক জীবন ও অর্থনীতি সম্পর্কে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য ব্যবহার করেছেন। 

মর্গান (Morgan): মার্কিন সামাজিক নৃবিজ্ঞানী লুইস হেনরি মর্গান (Lewis Henry Morgan) ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত গ্রন্থ Ancient Society তে সামাজিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সমাজকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করে তার পর্যায়ক্রমিক বিবর্তনের ধারা তৈরি করেন। তিনি বলেন, মানব সমাজ বিবর্তিত হয়ে বর্তমান ( সভ্যতা ) রূপ ধারণ করেছে। তার মতে, সমাজ বিবর্তনের তিনটি স্তর বা পর্যায় থাকে। এ তিনটি পর্যায় হলো (ক) বন্যদশা (Savagery), (খ) বর্বরদশা ( Barbarism ) ও (গ) সভ্যতা (Civilization)।

টেইলর (Tylor): ইংরেজ নৃবিজ্ঞানী টেইলরের মতে, সংস্কৃতি হচ্ছে ইতিহাসের বিজ্ঞান এবং তা সাংস্কৃতিক প্রগতির দর্শনের তিনটি স্তর তথা আদিমতা, বর্বরতা ও সভ্যতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি আরও বলেন, সাংস্কৃতিক প্রগতির তিনটি সর্বজনীন স্তর রয়েছে, তবে তিনি এসবকে ইতিহাসের চালিকাশক্তি হিসেবে গ্রহণ করেননি। বরং এগুলোকে পূর্বের অবস্থা পুনঃনির্মাণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বস্তুত সমাজবিজ্ঞানের জন্ম হয় পাশ্চাত্যের শিল্প ও ফরাসী বিপ্লবকালে। এ সময় ইউরোপীয় সমাজে এক বৈপ্লবিক সামাজিক পরিবর্তন সূচিত হয়। 

একথা সত্য যে, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো কোনো স্বতঃসিদ্ধ তত্ত্ব বা সূত্র সমাজবিজ্ঞান এখনো উদ্ভাবন করতে পারে নি, তথাপি সমাজবিজ্ঞানের উন্নতি বয়েই চলেছে। বর্তমানে আধুনিক প্রায় সকল দেশেই এর দ্রুত প্রসার ঘটছে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url