জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর ব্যবহার || Use of Genetic Engineering
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর ব্যবহার
বর্তমান বিশ্বে বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য উৎপাদন, শিল্প উৎপাদন, পরিবেশ রক্ষাসহ মানবজীবনের নানা চাহিদা মেটাতে কাজ করছে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি। মেডিকেল সায়েন্স, ফার্মাসিউটিক্যালস্ ও কসমেটিক ইন্ডাস্ট্রির জীবন রক্ষাকারী ওষুধ উৎপাদন, এনজাইম ও হরমোন উৎপাদনে এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কৃষিতে উন্নত ফলনের জন্য জেনেটিক প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নিচে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর ব্যবহার সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
ইনসুলিন তৈরি: কৌশলগতভাবে পরিবর্তিত E - coli ব্যাকটেরিয়া ও ইস্ট হতে বাণিজ্যিকভাবে মানবদেহের ইনসুলিন উৎপাদন হলো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর সবচেয়ে বড় সুফল। ইনসুলিন ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় প্রয়োজন হয়।
উন্নতমানের ফসল উৎপাদন: ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের দেশে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তির ওপর বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, আখ গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রভৃতি সংস্থা কাজ করে অনেক উচ্চফলনশীল জাতের শস্যবীজ উৎপাদন করেছে। এগুলোর মধ্যে উচ্চ শীব্র (BRRI) জাতের বহু ভ্যারাইটির ধানের বীজ উদ্ভাবন, পার্পল বা বেগুনি কালারের উফশী ধান উদ্ভাবন উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও সয়াবিন, ভুট্টা, তুলা, তৈলবীজ, টমেটো, পেঁপে ইত্যাদির জিন বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে এগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধি, পোকা - মাকড় ও অন্যান্য উদ্ভিদনাশক ছত্রাক ও ভাইরাস প্রতিরোধ করা যাচ্ছে। জেনেটিক্যালি রূপান্তরিত ফসল অধিক খরা ও ঠান্ডা সহ্য করতে পারে।
রোগের চিকিৎসা: জিন থেরাপি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর অন্যতম সুফল। জিন থেরাপির মাধ্যমে রোগের চিকিৎসা করে এবং ত্রুটিপূর্ণ জিন পরিবর্তন করে রোগীকে সুস্থ করে তোলা যায়।
ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য উৎপাদন: নির্দিষ্ট জিনের ক্লোনিং দ্বারা নতুন অনেক অত্যাধুনিক ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য উৎপাদন করা হয়।
হরমোন তৈরি: শিল্পজাত ব্যাকটেরিয়া থেকে উৎপাদিত হিউম্যান গ্রোথ হরমোন বামনত্ব (বেঁটে) রোধ করে এবং পোড়া তৃক, কেটে যাওয়া হাড় ও খাদ্যনালির আলসারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
ভাইরাসনাশক (Anti viral): জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর মাধ্যমে তৈরিকৃত "Interferon" (মানব কোষ থেকে নিঃসৃত এক ধরনের রস) ভাইরাসনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
টিকা ও জ্বালানি তৈরি: জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর ফলে জৈব কারখানায় প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ও এনজাইম উৎপাদন করা যায়। এগুলো দিয়ে প্রচুর সংখ্যায় ট্রিপ্টোফ্যান (Tryptophan) - এর মতো টিকা ও সম্পূরক তৈরি করা সম্ভব। এছাড়া জ্বালানি তৈরিতেও এগুলো ব্যবহৃত হয়।
মৎস্য উন্নয়ন: স্যামন মাছের জিন স্থানান্তরের মাধ্যমে মাগুর , কার্প , তেলাপিয়া মাছের আকৃতি অনেক বড় করা সম্ভব হয়েছে।
পরিবেশ সুরক্ষা: বিজ্ঞানীরা জিন প্রকৌশলের ওপর গবেষণা করে নতুন ব্যাকটেরিয়া তৈরি করেছেন , যা পরিবেশ সুরক্ষায় অবদান রাখছে।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর ঝুঁকিসমূহ
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর মাধ্যমে নতুন প্রজাতি উন্নয়নের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত ঝুঁকিসমূহ সর্বদা আমলে নিতে হবে। যথা
১. প্রাণী ও মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি: জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর মাধ্যমে উৎপাদিত GMO পণ্যসমূহ বিষক্রিয়া মুক্ত হতে হবে। এতে কোনো প্রকার এলার্জি সৃষ্টিকারী উপাদান থাকলে, তা চিহ্নিত করতে হবে। এর কোয়ালিটি মানুষের খাদ্য উপযোগী না, পশুখাদ্য উপযোগী তা নির্দিষ্ট করতে হবে।
২. পরিবেশ ঝুঁকি: যদিও পরিবেশের ওপর GMO এর প্রভাব নির্ধারণ কঠিন, তদুপরি এক্ষেত্রে কতিপয় বিষয়ের ঝুঁকি যথাসম্ভব নির্ধারণ করা আবশ্যক। যেমন GMO এর মাঝে প্রবেশকৃত জিন বা ঐ জিনের প্রোডাক্ট (প্রোটিন) পরিবেশে উন্মুক্ত অবস্থায় কতদিন অবস্থান করতে পারে, GMO ব্যতীত অন্যান্য জীব ঐ ট্রান্সজেনিকের প্রতি কতটা সংবেদনশীল, অপ্রত্যাশিত জিনের প্রকাশ বা ট্রান্সজিনের স্থায়িত্বের অভাব ঘটছে কি না এ বিষয়গুলো নির্ধারণ করা জরুরি। এছাড়াও ট্রান্সজিনের প্রকাশের ফলে বাস্তুসংস্থানের প্রভাব, মাটির উর্বরতার ওপর প্রভাব, জৈবযৌগ ও জৈববৈচিত্র্যের পরিবর্তনের প্রভাব প্রভৃতি ঝুঁকিগুলোও এক্ষেত্রে বিবেচনায় নিতে হবে।
৩. চাষ ঝুঁকি: যে সমস্ত বিষয় খেয়াল রাখতে হয়, তা হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশে কাঙ্ক্ষিত জীবের টিকে থাকার সামর্থ্য, পরিবর্তনশীল চাষ খরচ, পুষ্টিমানের পরিবর্তন, আগাছার প্রতি সংবেদনশীলতা ইত্যাদি। এই বিভাগের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আগাছা বা উৎকৃষ্ট আগাছা সৃষ্টি করার ক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করা। কারণ কোনো GM শস্য যদি কোনো Super Weed সৃষ্টি করে, তবে অন্য ফসলের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে। এছাড়াও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর আরও কিছু কুফলের মধ্যে রয়েছে-
১. জীববৈচিত্র্য হ্রাসের কারণে জীবজগতে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি।
২. অনৈতিক বা অযাচিতভাবে জিনের স্থানান্তর।
৩. মানবদেহে প্রয়োগযোগ্য এন্টিবায়োটিক ঔষধের কার্যকারিতা হ্রাস ও অ্যালার্জির উদ্ভব।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। দেশে ধান, পাট, আখ প্রভৃতি গবেষণা কেন্দ্র প্রতিনিয়ত উন্নতমানের সার বীজ আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ব্যাপক সফলতাও অর্জন করেছে। বাংলাদেশে মিষ্টি আপেল কুল, পেয়ারা, পেঁপে প্রভৃতি ফলের উন্নত বীজ আবিষ্কারের ফলে এই ফলগুলোও ব্যাপক অর্থকরী ফসলের ভূমিকা রেখে চলেছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - এ বাংলাদেশের বিশেষ সাফল্য হলো, পাটের জীবন রহস্য বা জিনোম সিকোয়েন্সের আবিষ্কার। বাংলাদেশের প্রখ্যাত জীনতত্ত্ববিদ ডঃ মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট গবেষণা কেন্দ্র এবং তথ্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডেটা সফট - এর একদল তরুণ উদ্যমী বিজ্ঞানী ও গবেষকগণের যৌথ প্রচেষ্টায় ২০১০ এর মাঝামাঝিতে পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কৃত হয়। ডঃ মাকসুদুল আলম এর আগে পেঁপেরও জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করেন।