হিসাববিজ্ঞান || Accounting

হিসাববিজ্ঞান

হিসাববিজ্ঞানের ধারণা  

সমাজ উন্নয়নের ধারায় মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। গড়ে ওঠে বিভিন্ন প্রকার ব্যবসায় - বাণিজ্য ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। ফলশ্রুতিতে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান তথা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে অর্থ সম্পর্কিত ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। এসকল ঘটনা বৈচিত্র্যময় ও অগণিত। নির্দিষ্ট কৌশল বা পদ্ধতি ছাড়া এসকল আর্থিক ঘটনার সার্বিক ফলাফল ও প্রভাব জানা খুবই কষ্টকর। হিসাববিজ্ঞান হচ্ছে এমন একটি শাস্ত্র যেখানে ব্যবসায়ে সংঘটিত সকল আর্থিক ঘটনার সামগ্রিক প্রভাব ও ফলাফল নির্ণয়ের পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। হিসাব ও বিজ্ঞান এ দুটি শব্দের সমন্বিত রূপ হলো হিসাববিজ্ঞান। 

আভিধানিক অর্থে হিসাব বলতে 'গণনা করা' বুঝায়। পক্ষান্তরে, বিজ্ঞান বলতে কোনো বিষয় সম্পর্কে সুশৃঙ্খল জ্ঞানকে বুঝায়। কাজেই হিসাববিজ্ঞান হলো কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে যে সকল আর্থিক লেনদেন সংঘটিত হয় ঐ সকল লেনদেন সুশৃঙ্খলভাবে লিপিবদ্ধ করা, ফলাফল নির্ণয় ও বিশ্লেষণ করে তথ্য সংশ্লিষ্ট ব্যবহারকারীর নিকট প্রতিবেদন আকারে উপস্থাপনের ব্যবস্থা বিশেষ। প্রতিষ্ঠানের মালিক, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ হিসাব তথ্য জানার জন্য সর্বদাই আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে। হিসাববিজ্ঞান এই আগ্রহ পূরণ করার জন্য আর্থিক লেনদেনসমূহ সংরক্ষণ ও পর্যালোচনার মাধ্যমে লেনদেনের প্রভাব ও ফলাফল নির্ণয় করে বিভিন্ন পক্ষকে প্রতিবেদন আকারে অবহিত করে, যা তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সহায়ক হয়। হিসাববিজ্ঞান ব্যবসায়ের আর্থিক লেনদেন লিপিবদ্ধকরণ, শ্রেণিবন্ধকরণ ও ব্যাখ্যাকরণের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করে। যার ফলে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন নির্ণয় করা যায় এবং এ সংক্রান্ত তথ্যাবলি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। হিসাববিজ্ঞানের জ্ঞান ব্যবহার করে হিসাবের বিভিন্ন বিবরণী ও প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয় যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা জানা যায়। 

সুতরাং বলা যায়, হিসাববিজ্ঞান হলো আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন পরিমাপক একটি ব্যবস্থা বা প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আর্থিক অবস্থার পরিবর্তনকারী লেনদেনসমূহ সুশৃঙ্খলভাবে লিপিবদ্ধ করা হয় এবং লিপিবন্ধকৃত লেনদেনসমূহ বিশ্লেষণের মাধ্যমে আর্থিক ফলাফল ও অবস্থা নিরূপণের জন্য প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়। হিসাববিজ্ঞান আর্থিক অবস্থার বিভিন্ন দিক পর্যালোচনার মাধ্যমে ব্যবসায়ের পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করে এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক তথ্য সরবরাহ করে থাকে। 

হিসাববিজ্ঞানের অর্থ ও সংজ্ঞা

সাধারণ অর্থে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন সংঘটিত আর্থিক লেনদেনসমূহ বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে লিপিবদ্ধকরণ, শ্রেণিবিন্যাসকরণ, উদ্বৃত্ত নির্ণয়, আর্থিক ফলাফল প্রস্তুতকরণ, বিশ্লেষণ ও আর্থিক তথ্য প্রদান করাই হলো হিসাববিজ্ঞান। হিসাববিজ্ঞান শব্দটি পৃথক করলে পাওয়া যায় হিসাব ও বিজ্ঞান। হিসাব শব্দের অর্থ আর্থিক লেনদেনসমূহের গণনা আর বিজ্ঞান বলতে বুঝায় লেনদেনসমূহ লিপিবদ্ধকরণ, আর্থিক ফলাফল নির্ণয় ও বিচার - বিশ্লেষণে বিশেষ জ্ঞান। অতএব, হিসাববিজ্ঞান বলতে অর্থের মাপকাঠিতে পরিমাপযোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের লেনদেনসমূহের গণনা শ্রেণিবিন্যাস, আর্থিক ফলাফল প্রস্তুত ও বিশ্লেষণ করার কাজকে হিসাববিজ্ঞান বলে। 

হিসাববিজ্ঞান সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা নিম্নে প্রদান করা হলো: American Institute of Certified Public Accountants (AICPA) - এর মতে, "আর্থিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন লেনদেন ও ঘটনাসমূহকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে এবং অর্থের পরিমাণে লিপিবন্ধকরণ , শ্রেণিবদ্ধকরণ , সংক্ষিপ্তকরণ ও তার ফলাফল বিশ্লেষণ করার কৌশলকে হিসাববিজ্ঞান বলে।" 

American Accounting Association ( AAA ) - এর মতে, "যে পদ্ধতি আর্থিক তথ্য নির্ণয়, পরিমাপ ও সরবরাহ করে উহার ব্যবহারকারীদের বিচার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে তাকে হিসাববিজ্ঞান বলে।" 

Pyle and Larson- এর মতে, "একটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক উপাত্তসমূহের লিপিবদ্ধকরণ , শ্রেণিবদ্ধকরণ , প্রতিবেদন প্রণয়ন ও তার বিশ্লেষণের কৌশলই হলো হিসাববিজ্ঞান।" 

Kieso and Weygandt- এর মতে, "হিসাববিজ্ঞান হলো একাধারে একটি সেবা প্রদানমূলক কার্যক্রম, একটি বর্ণনা এবং সর্বোপরি একটি তথ্যব্যবস্থা যা একটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনসমূহকে পরিমাপ, লিপিবদ্ধ, শ্রেণিবদ্ধ এবং সংক্ষিপ্তকরণের মাধ্যমে তার ফলাফল ও চিত্র প্রদান করে এবং তার সাথে জড়িত আগ্রহী বিভিন্ন পক্ষ তথা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য প্রদান করে।" 

Financial Accounting Standard Board (FASB)- এর মতে, "হিসাববিজ্ঞান হলো আর্থিক তথ্যের বিভিন্ন ব্যবহারকারীদের নিকট একটি প্রতিষ্ঠানের অথবা ইউনিটের আর্থিক কার্যাবলির পরিমাপ এবং প্রতিষ্ঠানের কাজে ব্যবহৃত প্রক্রিয়া।" 

হিসাববিজ্ঞানী A.W. Johnson- এর মতে, “ব্যবস্থাপনায় সাহায্যকারী ব্যবসায়ের আর্থিক লেনদেনসমূহের সংগ্রহকরণ, সংঘবদ্ধকরণ, লিপিবদ্ধকরণ, আর্থিক প্রতিবেদনসমূহ প্রস্তুতকরণ, সেগুলোর বিশ্লেষণ ও বিশদ ব্যাখ্যাকরণকে হিসাববিজ্ঞান বলে।" 
"Accounting may be defined as tice collection , completing and systematic recording of business transactions in terms of money , the preparation of financial reports , the analysis and interpretation on these reports for the information and guidance of management." 

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, হিসাববিজ্ঞান হলো একটি ব্যাবহারিক জ্ঞান, যা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনসমূহ বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে লিপিবদ্ধকরণ, শ্রেণিবদ্ধকরণ, সংক্ষিপ্তকরণ, আর্থিক ফলাফল প্রস্তুতকরণ, বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্ট সকলকে তথ্য প্রদান করা বুঝায়। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে হিসাববিজ্ঞান একটি তথ্যভাণ্ডার যা সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষগুলোকে তথ্য সরবরাহ করে থাকে। 

হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

পৃথিবীতে হিসাববিজ্ঞানের যাত্রা কখন প্রথম শুরু হয় তার সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে মানব সভ্যতার ইতিহাসের মতো-ই হিসাববিজ্ঞানের ইতিহাস অতি প্রাচীন। বর্তমান যুগের হিসাববিজ্ঞান শুরুতে এ অবস্থায় ছিল না। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে বেড়েছে ব্যবসা - বাণিজ্য তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এই বর্ধিত চাহিদার প্রয়োজনের তাগিদে হিসাব ব্যবস্থাও ধাপে ধাপে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছেছে। হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তির সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও হিসাবের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলে মনে করেন যে হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তি প্রায় চার হাজার বছর আগে। হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাসকে নিম্নলিখিত চার ভাগে ভাগ করা যায়: 
১। আদি যুগ বা উন্মেষ পর্ব 
২। দ্বিতীয় যুগ বা প্রাক - বিশ্লেষণ পর্ব 
৩। তৃতীয় যুগ বা বিশ্লেষণ পর্ব 
৪। বর্তমান যুগ বা আধুনিক পর্ব । 

১। আদি যুগ বা উন্মেষ পর্ব (Development period): আদি যুগে হিসাব ব্যবস্থার উৎপত্তি শুরু হয়। আদি যুগে মানুষের জীবনযাত্রার পর্যালোচনা করলে হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তি সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। মানব সভ্যতার শুরু থেকে ১৪৯৪ সাল পর্যন্ত সময়কে আদি যুগ হিসেবে ধরা হয়। ১৪৯৪ সালে লুকা প্যাসিওলি নামে রোমে ফ্রানসিস সম্প্রদায়ভুক্ত এক ধর্মযাজকের লেখা হিসাব বিদ্যার প্রথম বই "Summa De Arithmetica Geometrica Proportionet Proportionalita" প্রকাশিত হয়। হিসাববিজ্ঞানের উন্মেষ পর্বকে আবার নিম্নলিখিত চার ভাগে ভাগ করা যায়: 
ক. প্রস্তর যুগ 
খ. প্রাচীন যুগ 
গ. বিনিময় যুগ 
ঘ. মুদ্রা যুগ।

ক. প্রস্তর যুগ (Stone age): এ যুগে মানুষ বনে - জঙ্গলে বা গুহায় বাস করত। তারা ফলমূল সংগ্রহ ও বন্য পশু শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত। সে সময় গণনার কাজে তারা পাথর ব্যবহার করত। কে কয়টা পশু শিকার করেছে বা কতটি ফলমূল সংগ্রহ করেছে গুহার অভ্যন্তরে পাথরের সাথে তা দাগ কেটে হিসাব রাখত। মনে করা হয় এ থেকে হিসাব ব্যবস্থার অগ্রযাত্রা শুরু।

খ. প্রাচীন যুগ (Ancient period): এ যুগে মানুষ পাহাড়ের গুহা ছেড়ে সমভূমিতে বসবাস শুরু করে। সাধারণত বলা হয়ে থাকে মানুষের সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করার ভিত্তিপ্রস্তর হয় এ যুগে। হিসাবরক্ষণের কৌশলের পরিবর্তনও সূচিত হয় এ যুগে। মানুষ এ যুগে দেয়ালে খোদাই করার পরিবর্তে দেয়ালে দাগ কেটে, রশিতে গিঁট বেঁধে, মাটির টিলা গণনা করে এবং আঙ্গুলের ছাপ রেখে গণনা আরম্ভ করে।

গ. বিনিময় যুগ (Exchanging era): পণ্যের বিনিময়ে পণ্য গ্রহণের প্রথা চালু হওয়ায় এ যুগকে 'পণ্য বিনিময় যুগ' বলে। একজন মানুষের পক্ষে প্রয়োজনীয় সবকিছু যোগাড় করা বা উৎপাদন করা অসম্ভব। কাজেই সমাজে শুরু হয় পণ্য দ্বারা বিনিময়ের লেনদেন। বিনিময় যুগে মানুষ দরজার কপাটে বিভিন্ন রঙের দাগ দিয়ে হিসাব রাখত।

ঘ. মুদ্রা যুগ (Coin Exchanging age): বিনিময় যুগে দ্রব্য বিনিময় প্রথা মানুষের প্রয়োজন মিটাতে সক্ষম হলেও পণ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে অসুবিধার সৃষ্টি হতে লাগল। যেমন- একটা গরুর বিনিময়ে কয় কেজি চাল পাওয়া যাবে তা নির্ধারণ করা যেত না। এ অসুবিধা দূর করার জন্য মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন হয়। তখন বণিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে এবং লিখন ব্যবস্থার সূত্রপাত হয়। হিসাবরক্ষণের বৈজ্ঞানিক প্রণালি চালু না থাকায় তখন মানুষ ব্যবসা সংক্রান্ত নানাবিধ তথ্য পশুর চামড়ায় কিংবা গাছের পাতায় নোট আকারে লিখে রাখত। বর্তমানে যা একতরফা দাখিলা পদ্ধতি নামে পরিচিত। 

২. দ্বিতীয় যুগ বা প্রাক - বিশ্লেষণ পর্ব (Pre - explanatory period): ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম হতে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত এ পর্ব বিস্তৃত। এসময় বিভিন্ন দেশে ব্যবসা - বাণিজ্যে প্রসার লাভ করে। এ সময় ছাপাখানার প্রচলন হওয়ায় হিসাববিজ্ঞান বিষয়ের অনেক বই প্রকাশিত হয়। ১৪৯৪ সালে ইতালির ভেনিস শহরে লুকা প্যাসিওলি নামক একজন গণিত শাস্ত্রবিদ তার 'Summa - De Arithmetica Geometrica Proportionet Proportionalita' নামক গ্রন্থে দুতরফা দাখিলা পদ্ধতিতে হিসাবরক্ষণের প্রণালি উল্লেখ করেন। এই সূত্র ধরে বর্তমানে আধুনিক হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তি হয়েছে। 

৩. তৃতীয় যুগ বা বিশ্লেষণ পর্ব (Explanatory Period): ১৮০০ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এই দেড়শ বছরকে বিশ্লেষণ পর্ব হিসেবে আখ্যা দেয়া যেতে পারে। এ সময়ে যৌথমূলধনী কোম্পানির আবির্ভাব, বৃহদায়তন উৎপাদন, শ্রমিক - মালিক সম্পর্কের জটিলতা, অধিক মুনাফা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। এ সময় হিসাববিজ্ঞানের বিভিন্ন নিয়ম - কানুন বিশ্লেষণ করা হয়। ১৮০০ সালে আর্থিক হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তি ঘটে। ১৮৮৭ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হিসাবরক্ষকদের মান উন্নয়নের জন্য আমেরিকায় বিভিন্ন পেশাদার হিসাব সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। 

৪. বর্তমান যুগ বা আধুনিক পর্ব (Modern period): ১৯৫০ সালের পরবর্তী সময়কে হিসাবরক্ষণ সংক্রান্ত কাজ ও তত্ত্বের উত্থায়নের আধুনিক কাল বলে অভিহিত করা হয়। বস্তুতপক্ষে এ পর্বে হিসাবরক্ষণ পদ্ধতিতে অভূতপূর্ব পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। উৎপাদন ব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক বেশি জটিল হতে থাকে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে এসবের প্রভাব অসীম। বর্তমানে হিসাবশাস্ত্র শুধু লেনদেন লিপিবদ্ধকরণ ও ফলাফল নির্ণয়করণ ছাড়াও সমাজ ও কল্যাণধর্মী রাষ্ট্রের শিল্প - বাণিজ্যের আর্থিক প্রশাসন ব্যবস্থার উৎকর্ষ সাধনে বিশেষভাবে অবদান রাখছে। এছাড়া বর্তমান শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি কী রকম হওয়া উচিত তা নিয়ে পত্র - পত্রিকায় বিষয়টি প্রচুর সমালোচিত হয়। অপরদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুধু মুনাফা অর্জনকারী সংস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, প্রতিষ্ঠানের সামাজিক মূল্যের স্বীকৃতিও দেওয়া হয়। এভাবে পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান - বিজ্ঞানের উন্মেষ ঘটে। হিসাববিজ্ঞানের বিভিন্ন পেশাদারী সংগঠন এর ব্যবহার আরও বৃদ্ধির লক্ষ্যে এখন গবেষণায় নিয়োজিত। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহে সহজে কাজ করার জন্য এখন কম্পিউটার অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। অদূর ভবিষ্যতে হিসাববিজ্ঞান সমাজের আরও অনেক কাজে যথা— জাতীয় আয় নির্ণয়, সামাজিক উপযোগ নির্ধারণ, মানব সম্পদ হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি কাজেও ব্যবহৃত হতে পারে। জ্ঞান যেমন প্রতিনিয়ত সচল অবস্থায় চলতে থাকে, কোথাও দাঁড়িয়ে থাকে না, তেমনি হিসাববিজ্ঞানও প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মাধ্যমে উন্নতির পথে অগ্রসর হবে- এটাই আশা করা যায়। 

হিসাববিজ্ঞান কলা ও বিজ্ঞান উভয়ই 

হিসাববিজ্ঞান কলা না বিজ্ঞান এ বিষয়ে হিসাবশাস্ত্রবিদদের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। কোনো কোনো হিসাবশাস্ত্রবিদ হিসাববিজ্ঞানকে কলা, আবার হিসাবশাস্ত্রবিদ একে বিজ্ঞান , আবার কারো মতে হিসাববিজ্ঞান একটি কলা এবং বিজ্ঞান উভয়ই। প্রকৃতপক্ষে হিসাববিজ্ঞানকে কলা এবং বিজ্ঞান উভয়ই বলা যেতে পারে। 
যার পক্ষে যুক্তিসমূহ নিম্নরূপ: 

হিসাববিজ্ঞান একটি কলা 

কোন বিশেষ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন, কৌশল এবং সূত্রের বাস্তব প্রয়োগকে কলা বলা হয়। হিসাববিজ্ঞান একটি কলা কারণ হিসাববিজ্ঞানের সাহায্যে কোনো ব্যবসায়ী তার ব্যবসায়ের একটি সুনির্দিষ্ট কৌশল বা পদ্ধতি অনুসারেও সুশৃঙ্খলভাবে সংরক্ষণ করতে পারেন। 

Pyle & Larson এরমতে, "Accounting is the arty of recording Classifying, reporting and interpreting the financial data of an Organization." লেখক সংজ্ঞায় হিসাববিজ্ঞানকে একটি সংগঠনের আর্থিক তথ্যের লিপিবদ্ধকরণ, শ্রেণিবদ্ধকরণ এবং বিশেষণের কলা কৌশল হিসেবে বর্ণনা করেছে। 
সুতরাং হিসাববিজ্ঞানের কার্যাবলি একটি বিশেষ রীতি, পদ্ধতি এবং কৌশল মোতাবেক লিপিবদ্ধ করা হয়। সুতরাং ইহা একটি কলা। 

হিসাববিজ্ঞান একটি বিজ্ঞান

 কোনো বিষয়ে গবেষণালব্ধ সুশৃঙ্খল জ্ঞানকেই বিজ্ঞান বলে। পরীক্ষা নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ দ্বারা এ জ্ঞানের সাহায্যে কতগুলি সাধারণ সূত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। কোনো বিষয় সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ, ফলাফল নির্ধারণ এবং বিচার বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যা দান করাই বিজ্ঞানের কাজ। হিসাববিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও লক্ষ করা যায় যে, কোনো ব্যাক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক কার্যাবলির প্রকৃতি ও ফলাফল নিরূপণ ও বিশ্লেষণ করার জন্য কতগুলো সূত্র নির্ধারণ করা হয়। হিসাববিজ্ঞান পর্যবেক্ষণ অভিজ্ঞতা, বিশ্লেষণ, গবেষণা, শ্রেণিবিভক্তকরণ প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক প্রণালি দ্বারা সে সকল সূত্রের প্রতিষ্ঠা করে। এ কারণে নিঃসন্দেহে হিসাববিজ্ঞানকে আমরা বিজ্ঞান বলতে পারি। 

হিসাববিজ্ঞান কলা ও বিজ্ঞান

 হিসাববিজ্ঞান একদিকে একটি বিজ্ঞান অপরদিকে একটি কলা। কারণ হিসাববিজ্ঞানে বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞানের প্রয়োগ অপরিহার্য, তাই নিঃসন্দেহে এটি একটি বিজ্ঞান। পক্ষান্তরে হিসাববিজ্ঞানে হিসাব পদ্ধতির সুনির্দিষ্ট ছক, হিসাব তত্ত্বেও সরবরাহ ও উপস্থাপনার কৌশল ইত্যাদিতে কলা বিষয়ক জ্ঞানের প্রয়োগ হয়। তাই হিসাববিজ্ঞান একটি কলা।

হিসাব তথ্য কি?

হিসাব তথ্য হল কোন কোন অর্থনৈতিক সম্পদের উৎপাদন, উদ্ভাবন ও ব্যয়ের তথ্য যা কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি সংগ্রহ করে রাখে এবং তা ব্যবসায়িক নির্ণয় ও যোগাযোগ করতে ব্যবহার করে। হিসাব তথ্য অর্থনৈতিক স্থিতি নির্ধারণ করার জন্য ব্যবহৃত হয়, যেমন কোন প্রতিষ্ঠানের লাভ বা ক্ষতি, প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক স্থিতি এবং প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সম্পদ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য। হিসাব তথ্য পরিচালনার জন্য কম্পিউটার সফ্টওয়্যার ও টুলস ব্যবহৃত হয়, যেগুলি হিসাব এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনার কাজকে সহজ এবং দ্রুত করে তুলে ধরে।

হিসাববিজ্ঞান ও হিসাবরক্ষণের মধ্যে পার্থক্য

হিসাববিজ্ঞান এবং হিসাবরক্ষণ উভয়ই একটি ব্যবসার আর্থিক রেকর্ড পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যদিও তারা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত, তারা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে কাজ করে এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়া জড়িত। হিসাবরক্ষণ হল আর্থিক লেনদেনগুলিকে নিয়মতান্ত্রিক এবং সংগঠিত পদ্ধতিতে রেকর্ড করার প্রক্রিয়া। এর মধ্যে রয়েছে সমস্ত আয় এবং ব্যয় রেকর্ড করা, প্রদেয় এবং প্রাপ্য অ্যাকাউন্টগুলি ট্র্যাক করা এবং ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্টগুলি সমন্বয় করা। হিসাবরক্ষণের মূল লক্ষ্য হল আর্থিক বিবৃতি তৈরির উদ্দেশ্যে আর্থিক লেনদেনের সঠিক রেকর্ড বজায় রাখা। 

 অন্যদিকে, হিসাববিজ্ঞান একটি বিস্তৃত শব্দ যা হিসাবরক্ষণের পাশাপাশি অন্যান্য আর্থিক ব্যবস্থাপনার কাজগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে যেমন আর্থিক বিবৃতি বিশ্লেষণ, বাজেট তৈরি করা, ট্যাক্স রিটার্ন প্রস্তুত করা এবং আর্থিক পরামর্শ প্রদান। অ্যাকাউন্টিং ব্যবসার মালিকদের জ্ঞাত সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করার জন্য আর্থিক ডেটা ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ জড়িত। সংক্ষেপে, হিসাবরক্ষণ হল আর্থিক লেনদেন রেকর্ডিং এবং সংগঠিত করার প্রক্রিয়া, যখন অ্যাকাউন্টিং হল একটি বিস্তৃত ক্ষেত্র যেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং পরামর্শ দেওয়ার জন্য আর্থিক তথ্য বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা করা জড়িত। হিসাবরক্ষণ হিসাব-নিকাশের একটি মৌলিক অংশ, কিন্তু অ্যাকাউন্টিংয়ে আরও জটিল এবং কৌশলগত আর্থিক ব্যবস্থাপনার কাজ জড়িত।

হিসাববিজ্ঞানের আধুনিক নিয়ম

2021 সালের সেপ্টেম্বরে আমার সর্বশেষ জ্ঞানের আপডেট হিসাবে, আমি আপনাকে অ্যাকাউন্টিংয়ের কিছু মৌলিক নিয়মের একটি ওভারভিউ প্রদান করতে পারি। যাইহোক, অনুগ্রহ করে মনে রাখবেন যে অ্যাকাউন্টিং মান এবং প্রবিধানগুলি সময়ের সাথে সাথে বিকশিত হতে পারে, তাই আপনার এখতিয়ারের প্রাসঙ্গিক অ্যাকাউন্টিং কর্তৃপক্ষের দ্বারা জারি করা সর্বশেষ নির্দেশিকাগুলির সাথে পরামর্শ করা সর্বদা একটি ভাল ধারণা। এখানে কিছু মূল নীতি এবং নিয়ম রয়েছে যা সাধারণত আধুনিক অ্যাকাউন্টিং অনুশীলনে অনুসরণ করা হয়:

সাধারণভাবে গৃহীত অ্যাকাউন্টিং নীতিমালা (GAAP): GAAP বলতে অ্যাকাউন্টিং নীতি, মান এবং পদ্ধতির একটি সেট বোঝায় যা আর্থিক প্রতিবেদনের জন্য স্ট্যান্ডার্ড ফ্রেমওয়ার্ক হিসাবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত এবং স্বীকৃত। এই নীতিগুলি রেকর্ডিং, রিপোর্টিং এবং আর্থিক তথ্য প্রকাশের জন্য নির্দেশিকা প্রদান করে।

অ্যাক্রুয়াল বেসিস অ্যাকাউন্টিং: অ্যাকাউন্টিংয়ের রোমাঞ্চিত ভিত্তিতে, যখন নগদ প্রাপ্তি বা অর্থ প্রদান করা হয় তা নির্বিশেষে, যখন এটি অর্জিত হয় তখন রাজস্ব স্বীকৃত হয় এবং ব্যয়গুলি যখন ব্যয় হয় তখন স্বীকৃত হয়। এই নীতি নিশ্চিত করে যে আর্থিক বিবৃতি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি ব্যবসার অর্থনৈতিক কার্যকলাপ প্রতিফলিত করে।

রাজস্ব স্বীকৃতি: রাজস্ব সাধারণত স্বীকৃত হওয়া উচিত যখন এটি অর্জিত হয় এবং উপলব্ধি করা যায় বা উপলব্ধি করা যায়। এটি সাধারণত উপার্জিত হিসাবে বিবেচিত হয় যখন পণ্য বা পরিষেবাগুলি গ্রাহকের কাছে সরবরাহ করা হয় এবং ব্যবসা যথেষ্ট পরিমাণে তার বাধ্যবাধকতা পূরণ করে।

মিলের নীতি: ম্যাচিং নীতির জন্য প্রয়োজন যে খরচগুলি একই সময়ের মধ্যে স্বীকৃত হওয়া উচিত যা তারা তৈরি করতে সাহায্য করে। এটি নিশ্চিত করে যে ব্যয়গুলি সংশ্লিষ্ট রাজস্বের সাথে সঠিকভাবে মেলে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নেট আয়ের সঠিক সংকল্প সক্ষম করে।

ঐতিহাসিক খরচ নীতি: এই নীতি অনুসারে, সম্পদ এবং দায়গুলি তাদের বর্তমান বাজার মূল্যের পরিবর্তে তাদের মূল ঐতিহাসিক খরচে রেকর্ড করা উচিত। যাইহোক, কিছু সম্পদ, যেমন বিপণনযোগ্য সিকিউরিটিজ এবং কিছু আর্থিক উপকরণ, ন্যায্য মূল্যে রিপোর্ট করা যেতে পারে।

বস্তুগততা: আর্থিক তথ্য এমনভাবে উপস্থাপন করা উচিত যা ব্যবহারকারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার উপাদান। বস্তুগততা একটি আইটেমের প্রকৃতি এবং পরিমাণের উপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা হয় এবং এটি প্রয়োজনীয় বিশদ এবং প্রকাশের স্তর নির্ধারণ করতে সহায়তা করে।

সামঞ্জস্যতা: অ্যাকাউন্টিংয়ে সামঞ্জস্য বলতে এক সময় থেকে অন্য সময়ে একই অ্যাকাউন্টিং পদ্ধতি এবং নীতিগুলি প্রয়োগ করা বোঝায়। এটি তুলনা করার অনুমতি দেয় এবং সময়ের সাথে সাথে আর্থিক বিবৃতি বিশ্লেষণের সুবিধা দেয়।

রক্ষণশীলতা: রক্ষণশীলতার নীতি পরামর্শ দেয় যে যখন একাধিক গ্রহণযোগ্য অ্যাকাউন্টিং বিকল্প থাকে, তখন এমন বিকল্পটি বেছে নেওয়া উচিত যা সম্পদ বা আয়কে অতিবৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। এই পদ্ধতিটি আর্থিক তথ্যের আরও বিচক্ষণ এবং নির্ভরযোগ্য উপস্থাপনা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে।

সম্পূর্ণ প্রকাশ: আর্থিক বিবৃতি ব্যবহারকারীদের সমস্ত প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করা উচিত, তাদের সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অ্যাকাউন্টিং নীতি, সম্ভাব্য পরিস্থিতি, সংশ্লিষ্ট পক্ষের লেনদেন এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্যের ব্যাপক এবং স্বচ্ছ প্রকাশ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে বিভিন্ন দেশের নিজস্ব নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টিং মান এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকতে পারে, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণভাবে স্বীকৃত অ্যাকাউন্টিং নীতিমালা (GAAP) বা অন্যান্য অনেক দেশে ব্যবহৃত ইন্টারন্যাশনাল ফিনান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (IFRS)। আর্থিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য সংস্থাগুলির জন্য এই মানগুলির সাথে সম্মতি অপরিহার্য।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url