পৌরনীতি কি?
উৎপত্তিগত অর্থে নগর ও নগরবাসী সম্পর্কিত রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে জ্ঞানের যে শাখা গড়ে উঠেছে তাই পৌরনীতি। সংস্কৃত ভাষায় নগরকে 'পুর' বা 'পুরি' এবং নগরের আদিবাসীদের 'পুরবাসী' বলা হতো। এ জন্যই বাংলায় নাগরিক জীবনের অপর নাম 'পৌর জীবন' এবং নাগরিক জীবন সম্পর্কিত বিদ্যার নাম 'পৌরনীতি'।
পৌরনীতি শব্দের অর্থ কি?
'পৌরনীতি' কথাটি দুটি অর্থে ব্যবহার করা যায়।
১. সংকীর্ণ অর্থে পৌরনীতি অধিকার ও কর্তব্য সংক্রান্ত বিজ্ঞান। নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করাই এর মূল লক্ষ্য।
২. ব্যাপক অর্থে পৌরনীতিকে 'নাগরিকতার বিজ্ঞান' (Science of Citizenship) বলে অভিহিত করা হয়।
কেননা, পৌরনীতি নাগরিকতা সঙ্গে জড়িত সব বিষয়ই পর্যালোচনা করে।
পৌরনীতির ইংরেজি প্রতিশব্দ কি?
পৌরনীতির ইংরেজি প্রতিশব্দ 'Civics'. 'Civics' শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে দুটি ল্যাটিন শব্দ- 'Civis' ও 'Civitas' থেকে। 'Civis' অর্থ 'নাগরিক', আর 'Civitas' অর্থ 'নগররাষ্ট্র'।
সুতরাং শাব্দিক অর্থে 'Civics' বা পৌরনীতি হলো নগররাষ্ট্রে বসবাসরত নাগরিকদের আচরণ ও কার্যাবলী সংক্রান্ত বিজ্ঞান।
পৌরনীতির উৎপত্তিগত অর্থ কি?
পৌরনীতির উৎপত্তিগত অর্থ হলো নগরসভার সংগঠিত রাজনৈতিক পদ্ধতি বা নিয়মাবলির উদ্ভব। এটি একটি প্রাচীন বিষয় এবং বিভিন্ন সভ্যতার পৌরাণিক গঠনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পৌরনীতির উৎপত্তি মূলত প্রজাদের নগরীর কার্যকলাপ এবং নিয়ামনের জন্য একটি পদ্ধতি ও সমন্বয় সৃষ্টি করার প্রয়োজনকে মানে রেখে উদ্ভবিত হয়েছে।
পৌরনীতি মূলত নগরের প্রশাসন, ন্যায়, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং সার্বজনীন সুরক্ষা সহ বিভিন্ন কার্যকলাপে বিভক্ত হয়ে থাকে। পৌরনীতির উদ্ভব বিশেষত প্রাচীন ইউরোপীয় সভ্যতাদের প্রভাবে হয়েছে, যেমন গ্রিস, রোম এবং মধ্যযুগের শহরগুলি।
এটি পৌরসভা বা নগর সরকারের মাধ্যমে চালিত হয় এবং নাগরিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও পৌরনীতি নাগরিকদের অধিকার এবং দায়িত্ব সম্পর্কে নির্দেশনা দেয় এবং নগরীয় সুবিধা ও উন্নয়নের জন্য নীতিমালা তৈরি করে।
পৌরনীতির উৎপত্তি এবং অবদান সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা ও নীতি বিশ্লেষণকারীদের মধ্যে বিবাদ থাকতে পারে, কারণ পৌরনীতি একটি বিশেষজ্ঞতায় আচরণ করে এবং নগরের সামরিক, আর্থিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রশ্নগুলির উপর প্রভাব ফেলে।
পৌরনীতির জনক কে?
এরিস্টটল (প্রাচীন গ্রিক ভাষায় Ἀριστοτέλης আরিস্তোতেল্যাস্) (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৪ – ৭ই মার্চ, খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২) বিশ্ববিখ্যাত গ্রিক বিজ্ঞানী ও দার্শনিক। তাঁকে পৌরনীতির জনক বলা হয়। এছাড়া, তাঁকে প্রাণিবিজ্ঞানের জনকও বলা হয়।
পৌরনীতির সংজ্ঞা
পৌরনীতি সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মতবাদ দিয়েছন। তা নিম্নরূপ:
এফ. আই. গ্লাউড (F.I.Gloud) এর মতে— 'যেসব প্রতিষ্ঠান, অভ্যাস, কার্যাবলি ও চেতনার দ্বারা মানুষ রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক সমাজের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন এবং অধিকার ভোগ করতে পারে , তার অধ্যয়নই পৌরনীতি।'
বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে পৌরনীতির সংজ্ঞা দিয়েছেন। 'London Country Council' এর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক, ই. এম. হোয়াইটের মতে, "পৌরনীতি মানবজ্ঞানের সেই মূল্যবান শাখা যা নাগরিকের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এবং স্থানীয়, জাতীয় ও মানবতার সাথে জড়িত প্রতিটি বিষয় পর্যালোচনা করে।''
তিনি আরও বলেছেন, ''যে শাস্ত্র নাগরিকতার সঙ্গে যুক্ত সব প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করে , তাই পৌরনীতি।"
'(Civics is the subject that deals with everything appertaining to citizenship)।
Webster's International Dictionary- তে পৌরনীতির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, 'পৌরনীতি হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সেই বিভাগ বা শাখা যা নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করে।'
Encyclopaedia Britannica- তে পৌরনীতির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘পৌরনীতিকে সামাজিক বিজ্ঞানের সেই শাখা বলে অভিহিত করা যায়, যেখানে সরকারের সংগঠন ও পদ্ধতি এবং নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যসমূহ আলোচনা করা হয়।'
পৌরনীতি শাস্ত্রের অন্যতম গবেষক চার্লস ক্লিনটন পিটার্স ( Charles Clinton Peters ) তার 'Objectives and Procedures in Civic Education ' (Longmans, Green and Company , England , 1930 ) গ্রন্থে বলেন, 'পৌরনীতি হলো সরকারের গঠন ও ক্রিয়া সম্পর্কিত বিস্তারিত পাঠ, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে নাগরিক জীবন ও আচরণ সহজতর করা।'
ইংরেজ লেখক এবং ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের পথিকৃৎ ফ্রেডরিক জেমস গুল্ড (Frederick James Gould) - এর মতে, 'পৌরনীতি হচ্ছে প্রতিষ্ঠান, আচরণ ও চেতনার অধ্যয়ন, যার মাধ্যমে একজন নারী বা পুরুষ রাজনৈতিক সংগঠনের সদস্য হিসেবে তার কর্তব্য পালন ও সুযোগ - সুবিধা ভোগ করতে পারে।'
পরিশেষে, সংক্ষেপে বলা যায়, জ্ঞানের যে শাখা নাগরিক জীবনের সাথে সম্পর্কিত স্থানীয়, জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করে তাকে পৌরনীতি বলে।
পৌরনীতির পরিধি ও বিষয়বস্তু
পৌরনীতির পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। বিভিন্ন সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে মানুষ যে সব কাজ করে তার সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। পৌরনীতি হলো নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান। এটি প্রধানত রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে মানুষের কার্যাবলি পর্যালোচনা করে। আর মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যাবলি বিশ্লেষণ করাই পৌরনীতির মূল পরিধি বা বিষয়বস্তু।
পৌরনীতির পরিধি বা বিষয়বস্তু কেবল সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, আরও বহুবিধ বিষয় এ শাস্ত্রে আলোচিত হয়। অর্থাৎ, নাগরিকের জীবন ও কার্যাবলি যতদূর বিস্তৃত এবং যা কিছু নাগরিক জীবনকে স্পর্শ করে, পৌরনীতির পরিধি ততদূর প্রসারিত। আবার মানুষের জীবনের বর্তমান সমস্যার সাথে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন বিষয় বা জটিলতা। তাই বিষয়টির পরিধি দিন দিন বেড়ে চলেছে। এ সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত উল্লেখ করা হলো-
ক. নাগরিকতা ও সমাজজীবন: নাগরিকতা এবং সমাজজীবন পৌরনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু। নাগরিক হিসেবে ব্যক্তির পদমর্যাদাই হচ্ছে নাগরিকতা। আর পৌরনীতি ও সুশাসন হচ্ছে নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান। নাগরিকতার সাথে জড়িত সব বিষয় (নাগরিকতার উদ্ভব, বিকাশ, বিবর্তন, সুনাগরিকতা, সুনাগরিকতার গুণাবলি; নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য ইত্যাদি) নিয়ে পৌরনীতি ও সুশাসন আলোচনা করে।
খ. মৌলিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত: পৌরনীতি নাগরিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ের পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন মৌলিক প্রতিষ্ঠান নিয়েও আলোচনা করে। কেননা সমাজের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্র বিকশিত হয়। সমাজের সবচেয়ে আদি প্রতিষ্ঠান 'পরিবার' নিয়ে পৌরনীতি গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করে। আবার সমাজ, সামাজিক পরিবর্তন, সামাজিক মূল্যবোধ; রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও বিকাশ, রাষ্ট্রের কার্যাবলি; জাতি, গোত্র, সম্প্রদায় ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা পৌরনীতির পরিধির অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং, পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র প্রভৃতি মৌলিক প্রতিষ্ঠান এর পরিধির মধ্যে পড়ে।
গ. নাগরিকতার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পর্যালোচনা: পৌরনীত নাগরিকের বর্তমান অবস্থা, অধিকার এবং কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করার পাশাপাশি নাগরিকের অতীত এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়েও আলোচনা করে। কীভাবে নাগরিকতার ধারণার উদয় হয়েছিল; কীভাবে এ ধারণাটি যুগে যুগে বিবর্তিত হয়েছে; কীভাবে রাষ্ট্রের ধারণা ও কার্যাবলি এবং নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যের ধারণা যুগে যুগে বিকশিত ও পরিবর্তিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেই বা নাগরিকতা ও রাষ্ট্রের ধারণা, ধরন ও কার্যাবলি কেমন হতে পারে সে আলোচনাও পৌরনীতির অন্তর্ভুক্ত।
ঘ. নাগরিকতার সাথে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পর্যালোচনা: পৌরনীতি স্থানীয় , জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নাগরিকতার ব্যাখ্যাও প্রদান করে। পৌরনীতি নাগরিকতার স্থানীয় , জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের যে দিকগুলো পর্যালোচনা করে সেগুলো হলো-
১. মানুষ কোনো না কোনো সংস্থার সদস্য: একজন নাগরিক তার পরিবার, গ্রাম, ইউনিয়ন কাউন্সিল বা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের (ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন প্রভৃতি) সদস্য। এসব প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে একজন নাগরিক যেসব কাজ সম্পাদন করে তা নাগরিকতার স্থানীয় বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
২. প্রত্যেক ব্যক্তিই রাষ্ট্রের নাগরিক: প্রত্যেক ব্যক্তিই কোনো না কোনো রাষ্ট্রের নাগরিক। নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের প্রতি পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য প্রকাশ, সরকারের কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করা, নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা, নিজেদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া এ সবকিছুই নাগরিকতার জাতীয় দিকের অন্তর্ভুক্ত। আবার নাগরিকতা সম্পর্কিত জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন- আইনসভা, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র প্রভৃতি নিয়ে পৌরনীতি বিস্তারিত আলোচনা করে।
৩. প্রত্যেক ব্যক্তিই বিশ্ব নাগরিক: রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে একজন নাগরিক বিশ্ব সমাজেরও সদস্য। আধুনিক যুগে নাগরিকের ভূমিকা স্থানীয় ও জাতীয় সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করেছে। তাই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নাগরিকের ভূমিকা কী হতে পারে তাও পৌরনীতি বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কোনো রাষ্ট্রের নাগরিক যখন বিশ্বসমাজের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রকার অধিকার ভোগ করে এবং বিনিময়ে বিশ্বসমাজের অপর নাগরিকের প্রতি কর্তব্য পালনে আগ্রহী হয় , তখন নাগরিকতা আন্তর্জাতিক রূপ পায়। সুতরাং, নাগরিকের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক (জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসি প্রভৃতি) ও আঞ্চলিক সংস্থার (সার্ক, আরব লীগ, আফ্রিকান ইউনিয়ন প্রভৃতি) উদ্ভব, বিকাশ, উদ্দেশ্য ও কার্যাবলি পৌরনীতির পরিধির আওতাভুক্ত।
ঙ. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের আলোচনা: রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ পৌরনীতির অন্যতম আলোচ্য বিষয়। রাষ্ট্রের সংজ্ঞা, প্রকৃতি ও উৎপত্তির ইতিহাস; রাষ্ট্রের উপাদানসমূহ (জনগণ, সরকার, সার্বভৌমত্ব, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড); সংবিধানের প্রকৃতি ও শ্রেণিবিভাগ; সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ বা বিভাগের প্রকৃতি; নির্বাচন ও নির্বাচকমণ্ডলী; রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ জনমত ইত্যাদি পৌরনীতির পরিধিভুক্ত।
চ. বিমূর্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের আলোচনা: রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পাশাপাশি পৌরনীতি ও সুশাসন বিমূর্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয় নিয়েও আলোচনা করে। মূল্যবোধ, আইন, নৈতিকতা, স্বাধীনতা, সাম্য প্রভৃতির ধারণা, প্রকৃতি, উৎস, প্রকারভেদ, প্রয়োজনীয়তা; আইনের সাথে নৈতিকতার সম্পর্ক; আইনের সাথে স্বাধীনতার সম্পর্ক; আইন, স্বাধীনতা ও সাম্যের পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিমূর্ত বিষয়গুলো পৌরনীতির আলোচনার পরিধিভুক্ত।
ছ. নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা: পৌরনীতির মুখ্য উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রের নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করা। নাগরিকের উত্তম জীবন নিশ্চিত করাই এর লক্ষ্য। উত্তম নাগরিক জীবন গঠনের উদ্দেশ্যে পৌরনীতি নাগরিকতা সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করে। কীভাবে যথাযথভাবে নাগরিকের অধিকার ভোগ ও কর্তব্য পালন করা যায় সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পৌরনীতির অন্তর্ভূক্ত।
জ. সাংবিধানিক অগ্রগতি সম্পর্কিত আলোচনা: পৌরনীতি সাংবিধানিক বিকাশ ও অগ্রগতির ধারা নিয়েও আলোচনা করে থাকে। এ ভূখন্ডে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসনামলের সাংবিধানিক বিকাশ সম্পর্কিত আলোচনার পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া, সংবিধানের বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন সময়ে আনা সংশোধনীসমূহ, জাতীয় সংসদের নির্বাচনসমূহের ফলাফল এবং বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালনকারী সরকারের মন্ত্রিসভার গৃহীত পদক্ষেপসমূহ, ১৯১৯ এবং ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন, ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন, ১৯৫৬ এবং ১৯৬২ সালের পাকিস্তানের সংবিধান, ১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধান ইত্যাদি পৌরনীতি আলোচনা করা হয়েছে।
ঝ. রাজনৈতিক ঘটনাবলি: প্রতিটি রাষ্ট্রেই রাজনীতিকে কেন্দ্র করে কিছু না কিছু ঘটনা সংঘটিত হয়। নাগরিক জীবনে ঘটে যাওয়া এসব রাজনৈতিক ঘটনা ও এর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করে পৌরনীতি। যেমন- ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, ১৯০৫ ও ১৯১১ সালে যথাক্রমে বঙ্গভঙ্গ ও তা রদ, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব, ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি ঘটনা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পৌরনীতির আলোচ্য বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্ত।
ওপরের আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায়, নাগরিক জীবনের যেসব দিক কোনো না কোনোভাবে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং যা কিছু নাগরিক জীবনকে স্পর্শ করে, সেগুলোই পৌরনীতির পরিধি বা বিষয়বস্তু।
পৌরনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা কেন?
পৌরনীতি অধ্যয়ন এবং অনুশীলনের গুরুত্ব অপরিসীম। যা কিছু নাগরিক জীবনকে স্পর্শ করে এবং নাগরিকতা বিষয়ে সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়, তার প্রায় সব কিছু নিয়েই পৌরনীতি আলোচনা করা হয়। আর তাই নাগরিকের অধিকার , কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে জানতে এবং সমাজ, রাষ্ট্র ও অন্যান্য মানবীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পৌরনীতি পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। এ বিষয়টি অধ্যয়নের গুরুত্ব নিচে আলোচনা করা হলো:
১. সুনাগরিক হওয়ার শিক্ষাদান: বর্তমান বিশ্বের সর্বত্রই গণতন্ত্র সবচেয়ে পছন্দনীয় সরকার ব্যবস্থা। আর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে নাগরিকের কর্মকান্ডের ওপর। কেননা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র ও নাগরিকের পারস্পরিক সম্পর্ক অধিকার ও কর্তব্য দ্বারা নির্ধারিত। এ অধিকার ও কর্তব্য পালনে নাগরিককে হতে হবে সুনাগরিক। সুনাগরিকতা অর্জনের তিনটি অপরিহার্য গুণ হচ্ছে আত্মসংযম, বুদ্ধি ও বিবেকবোধ। পৌরনীতির পাঠ নাগরিককে এ তিনটি গুণ লাভ করতে সহায়তা করে। একজন নাগরিকের মধ্যে এ গুণগুলির পরিপূর্ণ সমন্বয় ঘটলেই কেবল সে দেশ ও জাতি সম্পর্কে সচেতনতা অর্জনে সক্ষম হবে।
২. নাগরিক দৃষ্টিভঙ্গি উদার করে: পৌরনীতি পাঠ করে নাগরিকরা দায়িত্বশীল, কর্তব্যনিষ্ঠ, স্বচ্ছ ও উদার মানসিকতাসম্পন্ন হয়। তাদের মধ্যকার গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধবিশ্বাস, সংকীর্ণতা, কুসংস্কার প্রভৃতি দূর হয়। অর্থাৎ পৌরনীতি পাঠে নাগরিক দৃষ্টিভঙ্গি উদার হয়। এছাড়া দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যপরায়ণতা অর্জনের মাধ্যমে নাগরিকরা উপযুক্ত মানবসম্পদে পরিণত হয়।
৩. গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন: রাষ্ট্রীয় সংগঠনের মৌলিক প্রতিষ্ঠানসমূহ (পরিবার , সমাজ , সরকার , সংবিধান , রাজনৈতিক দল ইত্যাদি) পৌরনীতির প্রধান আলোচ্য বিষয়। কাজেই এ বিষয়টি পাঠের মাধ্যমে নাগরিকরা তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর গঠন কাঠামো , কার্যাবলি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে পারে।
৪. সুশাসন সম্পর্কে ধারণা লাভ: বর্তমানে পৌরনীতির ধারণার সাথে সুশাসন বিষয়টি যুক্ত হওয়ায় রাষ্ট্রব্যবস্থায় নতুন চিন্তাভাবনার উদয় হয়েছে। একটি রাষ্ট্র যদি সুশাসনের ভিত্তিতে পরিচালিত না হয় তাহলে সে রাষ্ট্র কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা , নাগরিকদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতার সুষম বণ্টন, বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, প্রশাসনিক দুর্নীতি হ্রাস, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা, কার্যকর আইনসভা, জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ইত্যাদি বিষয় সুশাসনের জন্য অপরিহার্য। পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয় পাঠের মাধ্যমে এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান লাভ করা সম্ভব।
৫. সুষ্ঠু সমাজ গঠনে সহায়ক: মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক রীতিনীতি মেনে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে জীবন পরিচালনা করা মানুষের কর্তব্য। এজন্য মানুষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানটি সৃষ্টি করেছে। আর এ রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকে থাকার অন্যতম শর্ত হলো সামাজিক শৃঙ্খলা এবং নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক। পৌরনীতির পাঠ গ্রহণের মাধ্যমে নাগরিকরা সুষ্ঠু ও সুসম্পর্কপূর্ণ একটি সমাজ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়।
৬. নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে শিক্ষাদান: একটি রাষ্ট্রে নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যের সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপর সেই রাষ্ট্রের মানবিক দিকটি ফুটে ওঠে। পৌরনীতির আলোচনার মাধ্যমে নাগরিকরা তাদের রাজনৈতিক অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে পারে।
৭. কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক: আধুনিক রাষ্ট্র মূলত জনকল্যাণমূলক। যুগের বিবর্তনের সাথে সাথে রাষ্ট্র তথা সরকারের কাজের পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ প্রয়োজন। আর এতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের জন্য জনগণকে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সাথে পরিচিত হতে হয়। পৌরনীতি ও সুশাসন পাঠ নাগরিকদের এ কাজে সহায়তা করতে পারে।
৮. রাষ্ট্র ও সরকারের নানা দিক সম্পর্কে জ্ঞান লাভ: পৌরনীতি রাষ্ট্র ও সরকারের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করে। এটা রাষ্ট্রের উৎপত্তি, বিকাশ, রাষ্ট্রীয় সংগঠনের গঠন কাঠামো ও রাষ্ট্রের কার্যাবলি সম্পর্কে জ্ঞান দান করে। এ বিষয় পাঠ করে সরকার, এর শ্রেণিবিভাগ , সরকারের বিভিন্ন রূপ , বৈশিষ্ট্য , দোষ , গুণ , সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন , সংবিধান , এর প্রকারভেদ, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা যায়। সুনাগরিক হওয়ার জন্য এসব বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা অত্যাবশ্যক।
৯. রাজনৈতিক উন্নয়নের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞান লাভ : রাজনৈতিক উন্নয়নের ধারণা থেকে নাগরিক উন্নত-অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়। পৌরনীতি এ সম্পর্কে ধারণা প্রদান করে। উন্নয়নের বিভিন্ন ধারা ও পদ্ধতি সম্পর্কে এ শাস্ত্র বিস্তারিত আলোচনা করে। আর রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে হলে উন্নয়নের ধারা ও পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন অপরিহার্য।
১০. সুযোগ্য নেতৃত্ব গঠনে উদ্বুদ্ধকরণ: একটি দেশকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য যোগ্য নেতৃত্বের প্রয়োজন। জাতিকে সঠিক নেতৃত্ব দিতে হলে নেতার অবশ্যই পৌরনীতি বিষয়ে যথাযথ ধারণা থাকতে হবে। নেতৃত্ব কী, কীভাবে নেতৃত্ব লাভ করা যায়, এর আবশ্যকীয় গুণাবলি কী কী, এটি অর্জনের ক্ষেত্রে সমস্যা ও এর সমাধানের উপায় সবকিছু নিয়ে পৌরনীতি আলোচনা করে।
১১. জাতি গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন: পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিকদের বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে পরিচিত করে। এভাবে জাতীয় চেতনা জাগ্রত করার মাধ্যমে নাগরিকদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। এভাবে পৌরনীতি পাঠ জাতি গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
পরিশেষে বলা যায়, সুনাগরিকতার শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে সফল ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন গড়ে তুলতে হলে পৌরনীতির জ্ঞান লাভের বিকল্প নেই। আবার আইন, স্বাধীনতা, সাম্য, নৈতিকতা, সমাজ, পরিবার, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে পৌরনীতি পাঠ অত্যাবশ্যক।
পৌরনীতি নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান
পৌরনীতি হলো সমাজের বিভিন্ন কর্মকান্ডের কাজকর্তারা বা নির্ধারিত কর্তব্য পালন করার নির্দেশনা প্রণালী। এর মধ্যে রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ, যা নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কযুক্ত রয়েছে। নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান একটি বিষয়বস্তু, যা নাগরিকদের অধিকার এবং দায়িত্ব, শাসন পদ্ধতি, নির্বাচন পদ্ধতি, লোকশাসন, কর্তব্য এবং সম্পদ বিভাগের জন্য প্রযোজনীয় জ্ঞান সরবরাহ করে। নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান এর মধ্যে রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ, যা নির্দেশ করে কীভাবে শাসন করতে হবে এবং লোকশাসন করতে হবে। নাগরিকদের মধ্যে শক্তি বিতরণ এবং শাসনের একটি নিদর্শন সেট করা হয়।
স্বেচ্ছাচারী অর্থ কি?
"স্বেচ্ছাচারী" শব্দটি সাধারণত এমন কিছুকে বোঝায় যা কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম বা যৌক্তিক যুক্তির পরিবর্তে ব্যক্তিগত পছন্দ, বাতিক বা এলোমেলো পছন্দের উপর ভিত্তি করে। এটি এমন কিছু বোঝাতে পারে যা একটি নির্দিষ্ট মান বা মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে নয় এবং তাই অন্যায্য বা কৌতুকপূর্ণ বলে মনে হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি নির্বিচারে সিদ্ধান্ত হতে পারে যেটি সমস্ত প্রাসঙ্গিক কারণের সতর্কতা বিবেচনা না করে বা পক্ষপাতদুষ্ট মতামতের ভিত্তিতে করা হয়। সাধারণভাবে, "স্বেচ্ছাচারী" শব্দটি পরামর্শ দেয় যে প্রশ্নে সিদ্ধান্ত বা কর্মের জন্য কোন স্পষ্ট বা উদ্দেশ্যমূলক ভিত্তি নেই।