ইভটিজিং || Eve Teasing
ইভটিজিং - এর ধারণা
আমাদের দেশে নানা রকম সামাজিক সমস্যার মাঝে ইভটিজিং অন্যতম। সাম্প্রতিককালে এ সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ইভটিজিং এর অপমানের দহনে জ্বলতে থাকা অনেক কিশোরী, তরুণীর মৃত্যুর পথ বেছে নেওয়া এবং তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে শিক্ষক এবং নিকটাত্মীয়দের মৃত্যুতে সৃষ্টি হয়েছে গভীর উদ্বেগ।
ইভটিজিং মূলত এক ধরনের প্রকাশ্য যৌন হয়রানি যা নারী নির্যাতনের একটি ধরণ। সাধারণত রাস্তাঘাটে, যানবাহনে বা প্রকাশ্যে চলাফেরারত বা অবস্থানরত নারীদের পুরুষ দ্বারা উত্ত্যক্ত করা এক ধরনের যৌন হয়রানি। Eve Teasing শব্দটি পশ্চিমা বিশ্ব থেকে এসেছে। Eve বা ইভ শব্দটি দ্বারা বাইবেলে বর্ণিত ইভকে (Eve) অর্থাৎ পবিত্র কুরআনে বর্ণিত প্রথম মানবী হাওয়াকে বোঝানো হয়। Eve হলেন সমগ্র নারী জাতির নির্দেশক শব্দ। অন্যদিকে, Teasing বা টিজিং অর্থ পরিহাস বা জ্বালাতন। ইভটিজিং বলতে কোনো নারীকে প্রকাশ্যে যেকোনো ধরনের জ্বালাতন বা পরিহাসকে নির্দেশ করে ।
কোনো মানুষকে বিশেষ করে কোনো নারী বা কিশোরীকে তার স্বাভাবিক চলাফেরা বা কাজকর্ম করা অবস্থায় অশালীন মন্তব্য করা, ভয় দেখানো, অকারণে তার নাম ধরে ডাকা এবং চিৎকার করা, বিকৃত নামে ডাকা, কোনো কিছু ছুঁড়ে দেওয়া, ব্যক্তিত্বে লাগে এমন মন্তব্য করা, ধিক্কার দেওয়া, তার যোগ্যতা নিয়ে অযৌক্তিক কথা বলা, তাকে নিয়ে অহেতুক হাস্যরসের উদ্রেক করা, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ধাক্কা দেওয়া, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা দেওয়া, সিগারেটের ধোঁয়া গায়ে ছোঁড়া, উদ্দেশ্যমূলকভাবে পিছু নেওয়া, অশ্লীলভাবে প্রেম নিবেদন করা, উদ্দেশ্যমূলকভাবে গান বা ছড়া বা কবিতা আবৃত্তি করা, চিঠি লেখা, পথরোধ করে দাঁড়ানো, প্রেমে সাড়া না দিলে হুমকি প্রদান ইত্যাদি ইভটিজিং - এর মধ্যে পড়ে। বর্তমানে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যুগে মোবাইল ফোন, ই - মেইল এবং সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর মাধ্যমেও ইভটিজিং হয়ে থাকে।
২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারিতে বিচারপতি ইমান আলী ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একটি ডিভিশন বেঞ্জ কর্তৃক ইভটিজিংকে 'যৌন হয়রানি' শব্দটি দ্বারা প্রকাশ করে। বিষয়টিকে আইনে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেন। মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ ইভটিজিং সম্পর্কিত এক ঐতিহাসিক রায়ে। যেসব বিষয় এর আওতায় আসবে তা উল্লেখ করেন। যেমন:
১. শারীরিক স্পর্শের মতো অপ্রত্যাশিত যৌনাকাঙ্ক্ষার ব্যবহার।
২. প্রশাসনিক কর্তৃত্বমূলক অথবা পেশাগত ক্ষমতার অপব্যবহার করে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ বা চেষ্টা।
৩. চিঠি, ই - মেইল, টেলিফোন, মোবাইল ফোন, এসএমএস, পোস্টার, নোটিশ, কার্টুন, বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল, নোটিশবোর্ড, দেয়াল লিখনের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করা।
৪. যৌন ইঙ্গিত, পর্নোগ্রাফি প্রদর্শন, অশালীন উক্তি, যৌন সম্পর্কের দাবি বা অনুরোধ।
৫. যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য বা রসিকতা এবং ব্লাকমেইলিং ও চরিত্র হনন - এর উদ্দেশ্যে স্থির বা ভিডিও চিত্র ধারণ।
৬. লিঙ্গীয় ধারণা থেকে বা যৌন হয়রানির উদ্দেশ্যে শিক্ষা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক তৎপরতায় বাধা প্রদান।
৭. প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া এবং প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কারণে চাপ সৃষ্টি ও হুমকি প্রদান।
৮. মিথ্যা আশ্বাস, প্রলোভন বা প্রতারণার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা।
ইভটিজিং - এর কারণ
বর্তমান সময়ে নারী নির্যাতনের অন্যতম মাধ্যম হলো ইভটিজিং। এটি নৈতিকতার চরম অবক্ষয় এবং সামাজিক বিপর্যয়, যা অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকেও গ্রাস করেছে। নৈতিক শিক্ষার অভাব, নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রভৃতি কারণে এ সমস্যাটি মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে।
বস্তুত নিজস্ব সাংস্কৃতিক বিকাশের অভাব যৌন হয়রানির মতো অপরাধকে বাড়িয়ে তোলে। তথাকথিত অত্যাধুনিক বিশ্ব আর বিশ্বায়নের সাথে আমরা একাত্মতা প্রকাশ করে ভিনদেশি সংস্কৃতির অবাধ গলাধঃকরণ নিশ্চিত করেছি। দিনশেষে দেখা যাচ্ছে, আমাদের অপ্রস্তুত তরুণ সমাজে তার বদহজম শুরু হয়েছে। ভালো - মন্দের প্রকৃত পার্থক্য করতে না পারায় অণসংস্কৃতির প্রতিক্রিয়ায় তারা বেড়ে উঠছে দূষিত মনোবৃত্তি নিয়ে। ফলে তাদের মাঝে তৈরি হচ্ছে হিংস্র ও পশুসুলভ আচরণ বেড়ে যাচ্ছে। বলি হচ্ছে শত শত কোমলমতি মেয়ে।
আমাদের দেশে সাধারণত যে সকল কারণে নারীরা ইভটিজিং - এর শিকার হয় তা হলো—
১. পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ও পরিবার কাঠামো এবং পরিবারে ছেলেমেয়ের মাঝে বৈষম্য;
২. সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়;
৩. পারিবারিক অস্থিরতা তথা নিরাপত্তাহীন পারিবারিক পরিস্থিতি;
৪. পিতামাতার বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক এবং সন্তানের প্রতি তাদের উদাসীনতা;
৫. দারিদ্র্য ও মাদকাসক্তি;
৬. ইভটিজিং বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণার অনুপস্থিতি এবং এই অপরাধ বিষয়ে অজ্ঞতা,
৭· পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা,
৮. আইনের কঠোর প্রয়োগের অভাব;
৯. প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষার অভাব;
১০. নারীকে পণ্য ও ভোগের বস্তু মনে করা;
১১. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রকৃত প্রশিক্ষণের অভাব;
১২. নারীর প্রতি সমাজের (পুরুষদের, অনেকক্ষেত্রে অন্য নারীদেরও) নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং
১৩. রাজনৈতিক , সামাজিক , পারিবারিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারী পুরুষের মধ্যে বৈষম্যমূলক সম্পর্ক।
ইভটিজিং প্রতিরোধের উপায়
ইভটিজিং - এর স্বীকার নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তারা ভয়, উদ্বেগ, দুঃশ্চিন্তা, আত্মহত্যার প্রবণতা, অসহায়ত্ব, হতাশা, আত্মসম্মান বোধের হ্রাস ইত্যাদি মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকে। পরিবার বা স্কুলে এ ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রেই তারা পর্যাপ্ত মনো - সামাজিক সহযোগিতা পায় না বা পাবার ব্যবস্থাও নেই। ফলে সমস্যাগুলো পর্যায়ক্রমে প্রকট হতে থাকে।
ইভটিজিংয়ের কারণে অনেক কিশোরী ও তরুণীর এবং তাদের পরিবারের স্বাভাবিক জীবন নষ্ট হচ্ছে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেকের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেক নারীকেই এ নিপীড়ন থেকে রক্ষা করার জন্য বাল্যবিবাহের নির্মম শিকার হতে হচ্ছে।
ইভটিজিং বন্ধের বিষয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কর্মপন্থা হতে পারে— পরিবারের সদস্যরা একে অপরকে সচেতন করতে পারেন; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক - শিক্ষিকাগণ ভূমিকা রাখতে পারেন; কর্মক্ষেত্রের সহকর্মীগণ ভূমিকা রাখতে পারেন; রাস্তাঘাটে চলাচলকারী যেকোনো নাগরিক এটা বন্ধে। কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিটি সদস্য সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন; সর্বোপরি আমরা সকলেই এই নোংরা ব্যাধির বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখতে পারি।
ইভটিজিং সম্পর্কে পরিবারের ভূমিকাই সর্বাধিক। এক্ষেত্রে পরিবার যেসব ভূমিকা পালন করতে পারে তা হলো:
১. পারিবারিকভাবে শিশুকাল থেকে নারী - পুরুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক পরিষ্কারভাবে ছেলেমেয়েদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে।
২. পরিবারে নারী সদস্যদের প্রতি পুরুষ সদস্যদের শ্রদ্ধা প্রদর্শন, তাদের যথাযথ মর্যাদা দান, কটূ ও অশ্লীল কথা না বলা, গালি - গালাজ না করা এবং অল্প বয়েসি সদস্যদেরও তা থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দেওয়া উচিত।
৩. পরিবারের সুষ্ঠু শিক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গিই মানুষ হয়ে মানুষকে উত্ত্যক্ত করা থেকে রক্ষা করতে পারে।
৪. উত্ত্যক্ত করা একটি নিম্নমানের ও গর্হিত কাজ এমনকি আইনের চোখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ বিষয়ে সন্তানদের বিশেষ করে ছেলে সদস্যদের অবগত করানো এবং মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা পরিবারের দায়িত্ব।
৫. পরিবারের সকল সদস্য বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের নানারকম সৃজনশীল কর্মকাণ্ড যেমন— বই পড়া, কবিতা পড়া, খেলাধুলা করা, ছবি আঁকা ইত্যাদিসহ বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত করার পরিবেশ তৈরি করা উচিত।
অত্যন্ত ভয়ানক হয়ে ওঠা ইভটিজিং ব্যাধিকে দ্রুত প্রতিরোধ করার জন্য কঠোর শাস্তির বিধানের কোনো বিকল্প নেই। এ ভয়াবহ সামাজিক অসুস্থতাকে প্রতিরোধ করার জন্য রাজনৈতিক মতৈক্য অপরিহার্য। ক্ষতিগ্রস্তদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করাও জরুরি। সেই সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সামাজিক বিকাশে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের যে দায়িত্ব রয়েছে সে সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। এ কথা অতীব সত্য যে , আজ যদি আমরা আমাদের মেয়েদের সহায়তা না করতে পারি, দিনশেষে আমরা সবাই চরম অসহায়ত্বের মধ্যে পড়ব। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন যৌন হয়রানি তথা ইভটিজিংয়ের বিষবাষ্পকে সমাজ থেকে সমূলে উৎখাত করা।
ইভটিজিং প্রতিরোধে সমাজের বেশ কিছু দায়িত্ব আছে। যেমন:
১. ইভটিজিং - এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ক্লাস রুমে এ সম্পর্কে আলোচনা করা এবং এর নেতিবাচক দিকটি তুলে ধরা।
৩. ইভটিজিং উৎসাহিত হয় এ ধরনের বক্তব্য, বিজ্ঞাপন গণমাধ্যমে প্রচার না করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ৪. ইভটিজিং বা এজাতীয় কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে আক্রান্তের পাশে সকল সামাজিক - সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে দাঁড়ানো এবং মানসিক ও অন্যান্য সাহস জোগানো।
৫. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যথাযথ প্রতিরোধ কার্যক্রমে সচেতন ও কার্যকর করা।
৬. সামাজিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে নারী - পুরুষের বৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
এছাড়া ইভটিজিং প্রতিরোধে আরও যে সকল পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে তা হলো-
১. নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা।
২ . পারিবারিকভাবে সন্তানকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা।
৩. অপসংস্কৃতি চর্চা রোধ করা।
৪. কুরুচিপূর্ণ স্যাটেলাইট চ্যানেলসমূহ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।
৫. ইভটিজিং প্রতিরোধে সকল স্কুল, কলেজ , বিশ্ববিদ্যালয়ে 'প্রতিরোধ কমিটি' গঠন করা।
৬. ইভটিজিং সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের মিডিয়াগুলোর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেওয়া।
৭. ইভটিজারদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা।
ইভটিজিং নারীকে আত্মবিশ্বাসহীন করে তোলে। তার মাঝে চিরস্থায়ী ভয় ও অসহায়তা তৈরি করে। এর ফলে গোটা জাতি ও সমাজ অসুস্থতার দিকে চলে যেতে শুরু করে। ইভটিজিং - এর আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেয়ে নারী ঘরের বাইরেও থাকুক নিরাপদে; খুঁজে পাক তার স্বপ্নময় জীবনের সন্ধান। এ প্রত্যাশায় আমরা ইভটিজিংসহ সকল নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুলবো এবং প্রতিষ্ঠা করবো মূল্যবোধ ও শৃঙ্খলাপূর্ণ এক পরিচ্ছন্ন সমাজ।