সুশাসন কী? || What is Good Governance?

সুশাসন

বর্তমান বিশ্বের একটি আধুনিক ও জনপ্রিয় ধারণা হলো সুশাসন। সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ, প্রচেষ্টা যেমন রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে, তেমনি তা দেশের মানুষের অধিকারে পরিণত হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার অগ্রযাত্রা শুরু হয়। তখন থেকেই রাষ্ট্র ও সরকারের একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে সুশাসন প্রত্যয়টি জোরেশোরে উচ্চারিত হতে থাকে। সভ্যতা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অগ্রগতি আর প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে রাষ্ট্রকে আরও কার্যকর ও কল্যাণমূলক করে তোলার চেষ্টা চলছে। আর এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে শাসনের মানদণ্ড নিরূপণ করতে সুশাসন প্রত্যয়টির সূচনা ঘটে। পৌরনীতি ও সুশাসন শাস্ত্র গভর্নেন্সকে এক কথায় 'শাসনের ব্যবস্থা' বলে আখ্যায়িত করে থাকে। 

সুশাসনের ইংরজি প্রতিশব্দ কী?

 বাংলা সুশাসন শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো "Good Governance''। সুশাসন বা ''Good Governance" প্রত্যয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে হলে প্রথমে গভর্নেন্স বিষয়টি ভালো করে বুঝতে হবে। গভর্নেন্স একটি বহুমাত্রিক ধারণা যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ, ক্ষেত্র এবং প্রেক্ষাপট থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা গভর্নেন্সকে নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে থাকে। Governance শব্দটি গ্রিক "kubernao" শব্দ থেকে এসেছে। ''kubernao" এর শাব্দিক অর্থ হলো জাহাজ পরিচালনা করা। উৎপত্তিগত অর্থ থেকে বোঝা যায়, গভর্নেন্সের সাথে শুধু সরকারের কর্তৃত্ব নয়, পাশাপাশি আরও অনেক বিষয় যুক্ত রয়েছে। 

সুশাসন কী?

সুশাসনের সংজ্ঞাসমূহ

অর্থনীতিবিদ পিয়ের ল্যান্ডেল মিলস্ (Pierre Landell Mills) এবং ইসমাইল সেরাজেলডিন (Ismail Serageldin) - Founding Director of the Bibliotheca Alexandria] তাদের 'Governance and the Eternal Factor' গ্রন্থে বলেন, ''গভর্নেন্স বলতে বোঝায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষমতার ব্যবহার, যা একটি রাষ্ট্রকে পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে জনগণের সুষ্ঠু চাহিদা এবং তাদের বৈধ অধিকার উপভোগের বাধ্যবাধকতা।''

জাতিসংঘের সংস্থা UNDP- এর মতে, ''একটি দেশের সার্বিক স্তরের কার্যাবলি পরিচালনার জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্বের চর্চার বা প্রয়োগের পদ্ধতিই হলো গভর্নেন্স।'' 
অর্থাৎ রাষ্ট্রের সার্বিক কার্যাবলি পরিচালনার যে প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি তাই গভর্নেন্স। সেই প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি অবশ্যই বৈধ কর্তৃপক্ষের অধীনে পরিচালিত হতে হবে। 

ব্রিটিশ দার্শনিক, রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ এবং আমলা জন স্টুয়ার্ট মিলের (John Stuart Mill) মতে, ''যে শাসনব্যবস্থায় জনগণ তাদের বিচারবুদ্ধি ও নৈতিকতার বিকাশ ঘটাতে পারে তা-ই সুশাসন।''

যুক্তরাষ্ট্রের ৭২ তম অর্থমন্ত্রী Paul Henry O'Neill- এর মতে, ''সুশাসন হলো ন্যায়সঙ্গত শাসন, আইন ও চুক্তির নিরপেক্ষ প্রয়োগ, মানবাধিকার ও সম্পদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা।"

অষ্টাদশ শতকের ইংরেজ কবি আলেকজান্ডার পোপ ( Alexander Pope ) তার 'An Essay on Man' রচনায় বলেন, "সরকারের গঠন ও নাম নিয়ে শুধু বোকারাই মাথা ঘামায়। যে সরকার উত্তম শাসন করে তাই সুশাসন।" 

১৯৯৪ সালে বিশ্বব্যাংক তাদের একটি প্রকাশনায় গভর্নেন্সকে সংজ্ঞায়িত করে। বিশ্বব্যাংকের মতে, "সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য ক্ষমতা প্রয়োগের পদ্ধতিই হলো গভর্নেন্স।"

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক মাহাবুবুর রহমান বলেন, ''গভর্নেন্স হলো এমন এক ধারণা যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নের জন্য কর্তৃত্বের চর্চা করা হয়।'' (Governance is such a concept when authorities exercise for the organizational management to sustain development)। 

The Social Encyclopaedia তে সুশাসন সম্পর্কে বলা হয়েছে, "এটি সরকার পরিচালনার চেয়ে ব্যাপকতর ধারণা, যা বিশেষ করে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সামাজিক নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষার্থে ও নির্বাহী ক্ষমতা চর্চায় রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ভূমিকার সাথে সম্পর্কযুক্ত।" 

সুশাসন প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মহব্বত খান বলেন , ''সুশাসন হলো একটি দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পদের কার্যকরী ব্যবস্থা , তবে এটি হবে উন্মুক্ত, স্বচ্ছ , জবাবদিহিমূলক এবং ন্যায্য সমতাপূর্ণ।"

পিয়ের ল্যান্ডেল মিলস্ এবং ইসমাইল সেরাজেলডিন সুশাসন সম্পর্কে বলেন, ''জনগণের সুষ্ঠু চাহিদা ও ন্যায্য অধিকার উপভোগের নিশ্চয়তা প্রদানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা চর্চার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রক্রিয়াই হলো সুশাসন।'' 

সবশেষে বলা যায়, সুশাসন হলো অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ, দায়িত্বশীল ও ন্যায়পরায়ণ শাসনব্যবস্থা। পাশাপাশি এটি আইনের শাসন নিশ্চিত করে। এছাড়া অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অগ্রগতিকে প্রাধান্য দেয়। এ ব্যবস্থায় উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে সব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাতে দরিদ্র এবং পিছিয়ে পড়া মানুষের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সুশাসনের ধারণায় শুধু রাষ্ট্র বা সরকার নয়, পাশাপাশি বেসরকারি খাত এবং সুশীল সমাজকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়।

সুশাসনের বৈশিষ্ট্য 

সুশাসন নাগরিকের মানবিক অধিকার নিশ্চিত করে। সচেতন নাগরিকগোষ্ঠী ও সুশীল সমাজ সুশাসনের জন্য বিভিন্ন মতামত দিয়ে থাকেন। জনগণের সন্তুষ্টিই সুশাসনের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত। বিশ্বায়নের সুফল পেতে এবং উন্নত বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে সুশাসনের বিকল্প নেই। এ দৃষ্টিকোণ থেকে সুশাসন প্রত্যয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুশাসনের ধারণার আলোকে এর যে সব বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় তা নিচে আলোচিত হলো-
১. অংশগ্রহণ: কোনো রাষ্ট্রে সুশাসনের ভিত্তি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ধর্ম - বর্ণ, নারী - পুরুষ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অংশগ্রহণের সুযোগ। UNDP (United Nations Development Programme) এর মতে , অংশগ্রহণ হচ্ছে মানবাধিকার। রাষ্ট্রীয় কাজে নাগরিকের অংশগ্রহণ সরাসরি অথবা মধ্যবর্তী কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হতে পারে। অর্থাৎ অংশগ্রহণ হতে পারে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নে নাগরিক ও তাদের সংগঠনগুলোর কার্যক্রমকে গতিশীল করা । আবার রাষ্ট্রের যেকোনো প্রতিনিধি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নাগরিকের সক্রিয় অংশগ্রহণ সুশাসনের উপস্থিতিকে নির্দেশ করে। 

এ অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হলে তা সুশাসনের অন্তরায় বলে গণ্য হবে। আবার অংশগ্রহণ হতে পারে সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে, দেশের সংকটকালে গণভোটের ক্ষেত্রে, নীতি প্রণয়ন বা নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে এবং দুর্নীতি হ্রাস করার ক্ষেত্রে। অংশগ্রহণের আরেকটি বড় উপাদান হচ্ছে নাগরিকের ক্ষমতায়ন। যখন একজন নাগরিক উপলব্ধি করে যে, সে চাইলে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে, তাহলে বোঝা যাবে যে নাগরিকের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়েছে। চারটি বিষয় কার্যকর হলে নাগরিকের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়। এগুলো হলো- মতামত প্রদানের ক্ষমতা, দক্ষতা, সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও বিচারক্ষমতা। 

২. আইনের শাসন: সুশাসনের অন্যতম দাবি হলো রাষ্ট্রে একটি স্বচ্ছ আইনি কাঠামো থাকবে এবং এটি প্রত্যেকের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য হবে। এক কথায় একেই আইনের শাসন বলে। আইনের শাসন ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় না। আইনের শাসনের অর্থ আইনের প্রাধান্য স্বীকার করা এবং আইনানুযায়ী শাসন পরিচালনা করা। 

অধ্যাপক এ. ভি. ডাইসি (Prof. A. V. Dicey)  আইনের শাসনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, আইনের শাসনের অর্থ হলো- 
ক. আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান 
খ. সবার জন্য একই প্রকার আইনের ব্যবস্থা থাকবে 
গ. কাউকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করা যাবে না এবং 
ঘ. বিনা বিচারে কাউকে আটক করা যাবে না। তাছাড়া অভিন্ন আদালতের ব্যবস্থাও এর অন্তর্ভুক্ত। 

আইনের শাসনের জন্য প্রয়োজন সরকারের ন্যায়পরায়ণ আচরণ, রাষ্ট্রের নিপীড়নমুক্ত স্বাধীন পরিবেশ এবং নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচার বিভাগ। আইনের শাসন যেখানে বিদ্যমান সেখানে নাগরিকদের স্বাধীনতা বহাল থাকে। এর স্বারা সাম্য, স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, শাসক ও শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এসব কারণে আইনের শাসনকে সুশাসনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

৩. স্বচ্ছতা: স্বচ্ছতা অর্থ পরিষ্কার, স্পষ্ট ও নির্ভুল হওয়া। যে কোনো ধরনের গোপনীয়তা পরিহার করে নিয়মনীতি মেনে কোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করাকে স্বচ্ছতা বলে। স্বচ্ছতা বলতে তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং তথ্য প্রাপ্তির সহজলভ্যতাকেও বোঝায়। স্বচ্ছতা বজায় থাকলে দুর্নীতির আশঙ্কা থাকে না এবং নাগরিকদের কোনো প্রকার হয়রানির শিকার হতে হয় না। সুশাসনে স্বচ্ছতা বলতে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের পাশাপাশি সব আধাসরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংস্থা এবং সংগঠনের স্বচ্ছতাকেও বোঝায়। এর ফলে শাসক - শাসিত, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ও তা পালনকারীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ থাকে না। এতে সুশাসনের পথ সুগম হয়। 

৪. সংবেদনশীলতা: ইংরেজি Responsiveness শব্দটি বাংলায় 'সংবেদনশীলতা' অথবা 'সাড়া' প্রতিশব্দ দিয়ে প্রকাশ করা হয়। সাধারণত কম্পিউটার সায়েন্সের একটি প্রত্যয় হিসেবে Responsiveness শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এ প্রত্যয়টি দিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রয়োগকৃত দায়িত্ব যৌক্তিক সময় কাঠামোর (Reasonable Time Frame) মধ্যে সম্পন্ন করাকে বোঝায়। সরকারের যেকোনো প্রতিষ্ঠান নাগরিকদের সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে দ্রুত সাড়া প্রদান করবে এবং সময়সীমা সম্পর্কে সচেতন থাকবে। নাগরিকদের বিভিন্ন প্রয়োজন ও চাহিদা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবগত থাকলে এবং সেবা প্রার্থীদের সময়ের মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে এটা নিশ্চিত করা যায়। নাগরিক সনদ (Citizen Charter) -এ বর্ণিত সময়সীমা যেখানে বর্ণিত নেই সেখানে স্বল্পতম সময়ে সেবা প্রদানের মাধ্যমে একটি সাড়াপ্রবণ বা সংবেদনশীল প্রশাসন গড়ে তোলা যায়।

৫. ঐকমত্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা: একটি সমাজে বা রাষ্ট্রে বহু গোষ্ঠী, দল ও মত ক্রিয়াশীল থাকে। এক্ষেত্রে সুশাসনের দাবি হলো, এ ভিন্ন ভিন্ন মত ও স্বার্থের মধ্যেও একটি বৃহৎ ঐকমত্য তৈরি করা যেখানে পুরো সমাজের প্রধান প্রধান দাবি ও স্বার্থের সমন্বয় ঘটবে। পাশাপাশি ঐকমত্যের বিষয়গুলোকে কীভাবে অর্জন করা যায় তার কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। যে সমাজ ও রাষ্ট্রে যত বেশি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে সেখানে সুশাসন তত বেশি নিশ্চিত হবে। বিশৃঙ্খলা দূর হয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। 

৬. সাম্য: সাম্যের সাধারণ অর্থ সমতা, একতা, সাদৃশ্য। তবে পৌরনীতিতে সাম্যের অর্থ হচ্ছে সুযোগ - সুবিধাদির সমতা। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি সদস্য যখন অনুভব করতে পারে যে, তার অধিকার অন্য কারও চেয়ে কম নয়; সুশাসনের দৃষ্টিকোণ থেকে সে অবস্থাকেই 'সাম্য' বলা হয়। 

উন্নত দেশগুলোয় সমতাভিত্তিক সেবা'র মাধ্যমে এর প্রতিফলন দেখা যায়। সুশাসন সাম্যকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ব্যক্তিগত, আইনগত অর্থাৎ নাগরিক জীবনের সব ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করে। রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, ন্যায্য মজুরি পাওয়া, সামাজিক নিরাপত্তা লাভ, আইনের সমান সুযোগ পাওয়া ইত্যাদি বিষয় সাম্যের অন্তর্ভুক্ত। সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই সবার সামনে যথাযথ সুযোগ - সুবিধার দ্বার উন্মুক্ত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য করা যাবে না। 

৭. কার্যকারিতা ও দক্ষতা: কার্যকারিতা ও দক্ষতার অর্থ হলো এমন প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং কার্যপ্রক্রিয়া গ্রহণ করা যা রাষ্ট্রীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে নাগরিকদের সর্বোচ্চ সেবা প্রদান করবে। সুশাসনে দক্ষতা প্রত্যয়টির সাথে প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার এবং পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কার্যকারিতা এবং দক্ষতার সাথে পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের বিষয়টিও যুক্ত। 

৮. লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান: লিঙ্গ বৈষম্য বলতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্যকে বোঝানো হয়। নারীদের প্রতি বহেলা, তাদের কাজের ন্যায্য মজুরি, মর্যাদা ও স্বীকৃতি না দেওয়া প্রথাগত পুরুষশাসিত সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । সুশাসন লিঙ্গ বৈষম্যকে সমর্থন করে না। তাই সুশাসন বিদ্যমান থাকলে নারী - পুরুষ নির্বিশেষে যোগ্য ব্যক্তিকে উপযুক্ত পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে সামাজিক উন্নয়ন ও প্রগতি ত্বরান্বিত হয়।

৯. সরকারের বৈধতা: সুশাসনের জন্য সরকারকে অবশ্যই বৈধ হতে হবে। সরকার হতে হবে যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত অর্থাৎ জনগণের সমর্থনপুষ্ট। সরকারের কার্যক্রম, নীতি ও সিদ্ধান্ত এবং প্রণীত আইনের প্রতি জনগণের সমর্থন ও স্বীকৃতি থাকা প্রয়োজন। কারণ সরকার বৈধ ও স্থিতিশীল না হলে সুশাসন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে অবৈধ সরকার স্বেচ্ছাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ হয়। সামরিক বা এ ধরনের কোনো অগণতান্ত্রিক শাসন কখনোই সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে না। কেননা সরকারের বৈধতা - অবৈধতার প্রশ্ন সুশাসনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। 

১০. জবাবদিহিতা: জবাবদিহিতা হলো সুশাসনের মূল চাবিকাঠি। জবাবদিহিতা বলতে বোঝায় নিজের কার্যকলাপ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দানের বাধ্যবাধকতা। সুশাসন ব্যবস্থায় সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের পাশাপাশি সব সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়। তবে আইনের শাসন ও স্বচ্ছতা না থাকলে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যাবে না। প্রশাসনিক বা আমলাতান্ত্রিক জবাবদিহিতাকে এখন বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। 

রাজনৈতিক জবাবদিহিতা যদি দুর্বল হয় তবে তা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উভয় দিককেই প্রভাবিত করে। জবাবদিহিতাকে কেবল আইনি কাঠামোর মধ্যে বন্দী না রেখে দায়িত্বশীলতায় পরিণত করতে পারলে প্রশাসন ও সমাজ নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হবে। এর ফলে শাসনের ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে, অর্পিত দায়িত্ব দ্রুত সম্পন্ন হবে, নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে এবং দুর্নীতি হ্রাস পারে। এতে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। 

১১. সুশীল সমাজ: সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সুশীল সমাজের ভূমিকাকে বর্তমানে খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। সুশীল সমাজ সাধারণত নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেন। নাগরিক সমাজের এই বিশিষ্ট প্রতিনিধিরা সংবাদপত্র , রেডিও, টিভিসহ গণমাধ্যম এবং নানা সামাজিক, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত থেকে বা মুখপাত্র হিসেবে যেসব বক্তব্য দেন তা সুষ্ঠু জনমত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

১২. বিকেন্দ্রীকরণ: বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনিক ব্যবস্থাকেও অনেকে সুশাসনের বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করে থাকেন। প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণ বলতে শুধু প্রশাসনের উচ্চ থেকে নিম্নস্তর পর্যন্ত প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রত্যর্পণ নয়, একই সাথে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অর্পণকেও বোঝায় । USAID (The United States Agency for International Development) এর মতে, কার্যকরী বিকেন্দ্রীকরণ স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক সুযোগ - সুবিধা প্রদান এবং জাতীয় পর্যায়ে সুশাসনের উন্নতিতে সাহায্য করে। 

বিকেন্দ্রীকরণের ফলে সরকারি কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া এর মাধ্যমে প্রশাসনের মূল্যবান সময়ের সাশ্রয় করা, স্থানীয় নাগরিক চাহিদা পূরণ বৃদ্ধি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। 

১৩. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা: গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকলে জনমত বাধাগ্রস্ত হয়। শক্তিশালী জনমত সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। বাক স্বাধীনতা ও সুশাসন নিশ্চিত করে গণতন্ত্রকে সফল করতে হলে গণমাধ্যমকে হতে হবে সরকারের হস্তক্ষেপমুক্ত। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান (সংবাদপত্র , রেডিও, টেলিভিশন) এবং ফেসবুক, টুইটারের মতো অনলাইন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সে বিষয়টি সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।

১৪. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সুশাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবে সুশাসন ব্যাহত হয় । থমকে যায় সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতি। 

১৫. মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ: জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা সুশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। মৌলিক অধিকারের বাস্তবায়ন সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। 

১৬. স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা: স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার উপস্থিতি সুশাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) মনে করেন, 'বিচার বিভাগের দক্ষতাই সরকারের শাসন ক্ষমতার দক্ষতা।' যে দেশের বিচার বিভাগ যত বেশি দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে পারে সে দেশে সুশাসনের ভিত তত বেশি মজবুত হয়। বিচার বিভাগ শাসন বিভাগকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করে এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করে ও আইনের শাসন অক্ষুণ্ন রেখে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সজীব রাখে। তাই সুশাসন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে বিবেচিত। 

১৭. কৌশলগত লক্ষ্য: সুশাসনের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হলো রাষ্ট্র এবং নাগরিকের উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি কৌশলগত লক্ষ্য স্থির করা। এ লক্ষ্য স্থির করার ক্ষেত্রে ঐ রাষ্ট্র এবং সমাজের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং নৃতাত্ত্বিক পটভূমিকে বিবেচনায় রাখতে হবে। 

সুশাসনের এ বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে এটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পুরোমাত্রায় সুশাসন অর্জন করা যেকোনো রাষ্ট্রের জন্যই বেশ কঠিন। তারপরও টেকসই মানব উন্নয়নের জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রেরই উচিত সুশাসন অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া। সুশাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জনের মাধ্যমে একটি দেশ কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে।

সুশাসনের ক্রমবিকাশ 

সুশাসন (Good Governance) প্রত্যয়টির ব্যবহার খুব বেশি দিনের নয়। তবে এ বিষয়টির উৎপত্তি নতুন নয়। সুশাসনের ধারণা প্লেটোর লেখনিতেও পাওয়া যায়। ইংরেজি 'Governance' শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ 'Kubernao' থেকে। এ শব্দটি সর্বপ্রথম রূপক অর্থে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ব্যবহার করেছিলেন। তাছাড়া রাষ্ট্র সম্পর্কে প্লেটো বলেছিলেন- 'রাষ্ট্র হবে ন্যায়ভিত্তিক ও আদর্শ। ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করা গেলে জনগণের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত হবে।'

প্লেটোর এ বক্তব্যের মধ্যেও সুশাসনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সুশাসন বিষয়টির ধারণা অ্যারিস্টটলের লেখনি থেকেও পাওয়া যায়। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, 'সর্বোৎকৃষ্ট কল্যাণসাধন রাষ্ট্রের লক্ষ্য । 'তিনি আরও বলেছিলেন, 'প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক উপায়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু রাষ্ট্র টিকে আছে উন্নত জীবন অব্যাহত রাখার জন্য।' অ্যারিস্টটল বর্ণিত উন্নত জীবন (Good life) কথাটি যদি ভালোভাবে অনুধাবন করি তাহলে বুঝব বর্তমানের সুশাসন প্রত্যয়ের মধ্যেও এটি নিহিত আছে। উন্নত জীবন কামনার মধ্য দিয়েই শুরু হয় জীবন রক্ষার নিশ্চয়তা, স্বাধীনতা, সাম্য প্রভৃতি বিষয়। 

অ্যারিস্টটল তার সংবিধানের আলোচনার মাধ্যমেও সুশাসনের বিষয়টিকে তুলে ধরেন। তিনি সংবিধানকে প্রকৃতিগত দিক থেকে দুটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। তার মতে, যে শাসন শুধু শাসকের স্বার্থে পরিচালিত না হয়ে সমাজের সাধারণ স্বার্থে (Common Good) পরিচালিত হয় তা হলো শূদ্ধ প্রকৃতির সংবিধান (The True ( Constitution)। 'আর যে শাসন সমাজের স্বার্থকে উপেক্ষা করে শুধু শাসকের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয় তা বিকৃত প্রকৃতির সংবিধান (The Perverted Constitution)। 

প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিত কৌটিল্য তার 'অর্থশাস্ত্র' নামক গ্রন্থে সুশাসন সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলেন। তিনি সুশাসন বলতে আইনের শাসন, জনবান্ধব প্রশাসন , যৌক্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনকে বুঝিয়েছিলেন। পরবর্তীতে টমাস হবস্ (Thomas Hobbes), জন লক (John Locke) ও জাঁ জ্যাক রুশোর (Jean Jacques Rousseau) রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি মতবাদের মধ্যেও সুশাসনের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। এক্ষেত্রে জন লক - এর বক্তব্যের উল্লেখ করা যেতে পারে। 

তিনি বলেছেন, মানুষের প্রাকৃতিক অধিকারসমূহের সংরক্ষণ ও যথাযথ বিকাশের জন্যই যেহেতু সরকারের জন্ম, সেহেতু কোনো সরকার যদি জনগণের উক্ত অধিকারসমূহ সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে সেক্ষেত্রে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার বৈধ অধিকার জনগণের রয়েছে।' জন লকের এ বক্তব্যের মধ্য দিয়েই গণতন্ত্রের ধারণা, সম্প্রীতির ভিত্তিতে শাসন এবং সুশাসনভিত্তিক সরকারের ধারণা তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজের বিকাশ ও সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে উন্নত জীবন (Good Life) এর শর্তসমূহেরও বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। 

উন্নত জীবনের শর্তসমূহ রাষ্ট্রসমূহের সংবিধান বিধিবদ্ধ আইনের আওতায় আসে এবং এগুলো সরকারের জন্য অবশ্যই পালনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। নাগরিকের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির ওপর আঘাত আসে এমন বিষয়কে বর্তমানে আইনের লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বর্তমানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে সরকার নির্বাচিত হয় নাগরিকদের দ্বারা এবং নাগরিকরা এটি কামনা করে যে, সরকার উত্তম প্রশাসনের দ্বারা স্বচ্ছতার সাথে সব কার্যক্রম সম্পন্ন করবে। নাগরিকদের এ অনুভূতির ফল হলো আইনের শাসন এবং প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ। আর এ বিষয়গুলোই হলো সুশাসনের মূল বক্তব্য। 

অর্থাৎ এ আলোচনা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে সুশাসন প্রত্যয়টি হঠাৎ বা দৈবভাবে সৃষ্ট কোনো বিষয় নয়, এটি ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে। তবে বর্তমানের সুশাসন তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে। ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সাল এ সময়ের মধ্যে আফ্রিকা অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাপক হারে কমে যায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যে বিশ্বব্যাংক ১৯৯১ সালে 'Sub Saharan Africa : From Crisis to Sustainable Development' নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। 

এ প্রতিবেদনের মূল বিষয় ছিল- 'শুধু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও নীতি প্রণয়ন করে উন্নয়নের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্র গঠন করতে হবে, যার জন্য প্রয়োজন সুশাসন বা Good Governance।' সুশাসনের ধারণার জন্য বিশ্বব্যাংক হয়টি সূচক চিহ্নিত করে এবং বিশ্বের সব দেশে এসব উপাদানের পরিমাপ করে তার ফলাফল প্রকাশের ব্যবস্থা করে। ছয়টি সূচক হলো-
১. বক্তব্য প্রকাশের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা (Voice and accountability), 
২. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহিংসতার অনুপস্থিতি (Political stability and absence of violence), 
৩. সরকারের কার্যকারিতা ( Government effectiveness) , 
৪. নিয়ন্ত্রণের মান (Regulatory quality), 
৫. আইনের শাসন (Rule of law) এবং 
৬. দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ (Control of corruption)। 

এই সূচকগুলো ধনাত্মক ২ দশমিক ৫ থেকে ঋণাত্মক ২ দশমিক ৫ - এর স্কেলে মাপা হয় । কোনো দেশের সূচকের পরিমাণ শূন্যের কাছাকাছি হলে ধরে নিতে হবে যে এ সূচক অনুসারে দেশটির সুশাসনের মোট অবস্থান গড় অবস্থানের কাছাকাছি। সূচক শূন্য হতে ধনাত্মক ২ দশমিক ৫ এর মধ্যে যত ঊর্ধ্বে হবে, তত এই সূচক অনুসারে সে দেশের সুশাসনের তুলনামূলক অবস্থান উঁচুমানের ধরা হবে। ১৯৯২ সালে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি) বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনটিকে গ্রহণ করে। 

পরবর্তী সময়ে তারা উন্নয়নে শরিকানা, গণতন্ত্রের ও বহুদলীয় সমাজের পরিপোষণ, স্বচ্ছ জবাবদিহিমূলক, সুষ্ঠু ও কার্যকর জাতীয় সরকার, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, স্বাধীন যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদ বিকিরণ, দুর্নীতিবিরোধী তৎপরতা এবং অত্যধিক সামরিক ব্যয়ের সংকোচনের সুপারিশ করে। 

পৃথিবীর যে কোনো দেশের সরকার সব সময়ই প্রত্যাশা করে যে, তাদের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হোক। সেই শাসনব্যবস্থাকে কীভাবে আরও উন্নত করা যায় সে ব্যাপারে সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে চিন্তারও পরিবর্তন ঘটেছে। উন্নত শাসন সংক্রান্ত চিন্তার বিবর্তনের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বর্তমানের সুশাসন সংক্রান্ত ধারণা। অর্থাৎ এক কথায় বলা যায় বর্তমানের সুশাসন ধারণাটি সময়ের বিবর্তনে গড়ে উঠা একটি বিষয়। 

পৌরনীতি ও সুশাসনের সম্পর্ক 

সামাজিক বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো পৌরনীতি। বর্তমানে সুশাসন প্রত্যয়টি এর সাথে যুক্ত হয়েছে। পৌরনীতি রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সম্পর্ক - সংক্রান্ত বিজ্ঞান; অর্থাৎ পৌরনীতি নাগরিক জীবনের সাথে জড়িত সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। নাগরিকদের উত্তম জীবনের দিকনির্দেশনা দেয় পৌরনীতি। অন্যদিকে সুশাসন একটি নতুন ধারণা। এটি নাগরিককে কল্যাণকর, গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থাসহ উত্তম জীবনের নিশ্চয়তাদানের একটি পন্থা। সুশাসন বলতে এমন একটি প্রক্রিয়াকে বোঝায় , যা দায়িত্বশীলতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, আইনি কাঠামো এবং অংশগ্রহণের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ সুশাসন পৌরনীতির একটি প্রায়োগিক অংশ। পৌরনীতির জ্ঞান সুশাসন নিশ্চিত করতে সহায়তা করে।

সম্পর্ক: পৌরনীতি ও সুশাসনের মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। নিচে পৌরনীতি ও সুশাসনের মধ্যকার সম্পর্ক উপস্থাপন করা হল-
১. পৌরনীতিতে নাগরিক জীবনের সামগ্রিক দিক ফুটে ওঠে। আর সুশাসন পৌরনীতির একটি অংশ, যাতে নাগরিক শাসন সম্পর্কিত দিক তুলে ধরা হয়। এদিক থেকে পৌরনীতি ও সুশাসন একই সূত্রে গাঁথা বলা যায়। 

২. পৌরনীতির উদ্দেশ্য হলো নাগরিককে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা এবং উত্তম নাগরিক জীবনের দিকনির্দেশনা দেওয়া। আর সুশাসনের উদ্দেশ্য হলো শাসনপ্রক্রিয়াকে উন্নত ও কল্যাণমুখী করে গড়ে তোলা এবং নাগরিকদের উত্তম জীবন নিশ্চিত করা। সুতরাং বলা যায়, পৌরনীতি ও সুশাসনের উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। 

৩. পৌরনীতি ও সুশাসন একে অপরের সহযোগী। উভয়ে একই লক্ষ্যার্জনের জন্য পরিচালিত হয়। পৌরনীতি ও সুশাসন উভয়ের প্রধান লক্ষ্য হলো নাগরিক জীবন ও রাষ্ট্রের সর্বাধিক কল্যাণ ও উন্নয়ন। 

৪. পৌরনীতি ও সুশাসন কতগুলো অভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। নাগরিকের অধিকার , দায়িত্ব, কর্তব্য, রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধান, আইন, আইনের শাসন, সাম্য, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, আমলাতন্ত্র ইত্যাদি পৌরনীতি ও সুশাসন উভয়েরই আলোচ্য বিষয়। 

৫. পৌরনীতি ও সুশাসন একে অপরের উপর নির্ভরশীল। বলা যায়, একটি ছাড়া অন্যটি অপূর্ণ। কেননা সুশাসনের জন্য যেমন পৌরনীতির জ্ঞান অপরিহার্য, তেমনি পৌরনীতির অগাধ জ্ঞান নিয়েও সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারলেও সেটি পূর্ণতা পায় না। 

৬. সুশাসন ও পৌরনীতি একে অপরের দ্বারা প্রভাবিত হয়। কারণ পৌরনীতির জ্ঞান সুনাগরিক তৈরি করে। আর এ সুনাগরিক ব্যতীত সুশাসন সম্ভব নয়। 

সুতারং পৌরনীতি ও সুশাসনের মধ্যে যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে, তা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। 

পার্থক্য: পৌরনীতি ও সুশাসনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও কিছু বিষয়ে পার্থক্যও পরিলক্ষিত হয়। পার্থক্যগুলো নিম্নরূপ — 
১. পৌরনীতি নাগরিকতার সাথে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়কে তার আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করে। অন্যদিকে সুশাসন শুধু নাগরিকের শাসনসংক্রান্ত বিষয়ে আলোকপাত করে। অর্থাৎ পৌরনীতির পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত। কিন্তু সে তুলনায় সুশাসনের ক্ষেত্র অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ। 

২. পৌরনীতি একটি প্রাচীন বিষয়। কিন্তু সুশাসন প্রত্যয়টি খুব বেশি পুরাতন নয়। রাষ্ট্রীয় শাসনপ্রক্রিয়ার নিয়মনীতি অপপ্রয়োগের ফলে সাম্প্রতিককালে একটি নতুন সংযোজন হিসেবে সুশাসন প্রত্যয়টি পৌরনীতির সাথে যুক্ত হয়। অর্থাৎ বয়সের দিক থেকে পৌরনীতি প্রবীণ আর সুশাসন নবীন। 

৩ . পৌরনীতির আলোচনায় নাগরিকের রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন দিককে গুরুত্ব দেওয়া হয়। অপরদিকে, সুশাসনে নাগরিকের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিকই গুরুত্ব দেওয়া হয়। 

৪. পৌরনীতির তুলনায় সুশাসন অধিক আদর্শমূলক। কেননা সুশাসনে আদর্শ শাসনব্যবস্থার দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। 

৫. পৌরনীতি একটি বর্ণনামূলক বিষয়। এটি শিক্ষার্থীদের কেবল তাত্ত্বিক শিক্ষাদান করে। কিন্তু সুশাসন পৌরনীতির জ্ঞানের বাস্তব প্রকাশ। কাজেই পৌরনীতিকে তাত্ত্বিক আর সুশাসনকে এর ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক দিক হিসেবে উল্লেখ করা যায়। 

উপরের আলোচনা শেষে বলা যায়, পৌরনীতি ও সুশাসনের মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকলেও এদের মধ্যকার পারস্পারিক সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও নিবিড়। পৌরনীতি ও সুশাসন একে অপরের পরিপূরক ও সহযোগী। তাই পৌরনীতি ও সুশাসনকে আলাদা করে চিন্তা করার কোনো উপায় নেই।

শাসন ও সুশাসনের মধ্যে পার্থক্য

শাসন বলতে সেই প্রক্রিয়া এবং কাঠামোকে বোঝায় যা একটি প্রতিষ্ঠান বা সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি সেই প্রক্রিয়াগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে যার দ্বারা ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয় এবং কীভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং বাস্তবায়িত হয়।

অন্যদিকে, সুশাসন হল এমন একটি ধারণা যা বোঝায় যে শাসনের প্রক্রিয়া এবং কাঠামোগুলি ন্যায্য, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, অংশগ্রহণমূলক এবং জনগণের চাহিদার প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল যা তারা পরিবেশন করে। অন্য কথায়, সম্পদের কার্যকর ও দক্ষ ব্যবহার, মানবাধিকার সুরক্ষা, আইনের শাসন এবং টেকসই উন্নয়নের প্রচার দ্বারা সুশাসনের বৈশিষ্ট্য।

যদিও শাসন যে কোনও সংস্থা বা সমাজে বিদ্যমান থাকতে পারে, সুশাসন হল একটি আদর্শ মান যা সমস্ত সরকার এবং সংস্থার অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা করা উচিত। গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য সুশাসন অপরিহার্য। এটি নাগরিক ও সরকারের মধ্যে আস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করে, স্থিতিশীলতা ও শান্তি বজায় রাখে এবং নাগরিক সম্পৃক্ততা ও অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করে।

সুশাসনের অন্যতম অন্তরায় কোনটি?

সুশাসনের অন্যতম বাধা দুর্নীতি। ঘুষ, আত্মসাৎ, স্বজনপ্রীতি এবং পক্ষপাতিত্বের মতো বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি ঘটতে পারে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তাদের বৈধতা ও কার্যকারিতা নষ্ট করতে পারে। এটি জনসাধারণের আস্থার ক্ষতি, জবাবদিহিতার অভাব এবং সম্পদের অসম বন্টনের কারণ হতে পারে। সুশাসনের অন্যান্য বাধার মধ্যে রয়েছে অপর্যাপ্ত সম্পদ, দুর্বল প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং তথ্যে সীমিত প্রবেশাধিকার এবং নাগরিক অংশগ্রহণ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url