আইনের ধারণা || Concept of Law

আইন কী?

আইনের ধারণ

সাধারণ অর্থে আইন বলতে বোঝায় সুনির্দিষ্ট কতগুলো নিয়ম কানুনকে। সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীব হিসেবে সমাজে বসবাস করার কারণে মানুষকে নানা প্রকার নিয়ম-নীতি, বিধি ও রীতিনীতি মেনে চলতে হয়। সমাজ গঠনের প্রারম্ভ থেকেই এ সকল বিধি-বিধানবলী মেনে চলা প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজবদ্ধ মানুষের আচার-ব্যবহার নিয়ন্ত্রণকারী সামাজিক প্রথা, রীতিনীতি, ঐতিহ্য প্রকৃতিকে সামাজিক আইন বলে অভিহিত করা হয়।

আইন শব্দের অর্থ কি?

"আইন" শব্দের অর্থ "স্থির" বা "অপরিবর্তনীয়। আইন সকলের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। ব্যাপক অর্থে "আইন" শব্দটি সমাজ জীবনের অসংখ্য নিয়ম কানুন ও বিধি-বিধানকে বুঝালেও সংকীর্ণ অর্থে আইন বলতে শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় আইনকে বুঝায়।

আইনের ইংরেজি প্রতিশব্দ কি?

"আইন" শব্দটি ফরাসি শব্দ থেকে বাংলায় এসেছে। আইনের ইংরেজি প্রতিশব্দ "Law" - এর উৎপত্তি টিউটনিক শব্দ "Lag" থেকে।

আইনের জনক কে?

আইনের জনক হলো মার্কাস টুলিয়াস সিসেরো। তিনি সর্বকালের অন্যতম সেরা একজন অর্থনীতিবিদ ছিলেন। রোম হতে প্রায় ৭০ মাইল দূরে অবস্থিত শহর আর্পিনামে ১০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। 

অন্যান্য আইনের জনক হলো-
১. আধুনিক আন্তর্জাতিক আইনের জনক হলো- হুগো গ্রোটিয়াস।
২. আইন বিজ্ঞানের জনক হলো- সম্রাট হাম্বুরাবি।

আইনের সংজ্ঞা 

বিভিন্ন লেখক বিভিন্নভাবে আইনকে ব্যাখ্যা করেছেন। 

জন অস্টিনের কথায়,"সার্বভৌম শাসকের আদেশই আইন।"

স্যার হেনরি মেইন বলেন, "সার্বভৌম শক্তির খেয়াল খুশি হতে উদ্ভূত অনুশাসনকে আইন বলা যায় না বরং পরিবর্তনশীল, ক্রমবর্ধমান সামাজিক প্রথার যোগফলকে বলা হয় আইন।"

অধ্যাপক গেটেল বলেন, "রাষ্ট্র যে সকল নিয়ম কানুন তৈরি করে, অনুমোদন দেয় এবং প্রয়োগ করে সেগুলোই আইনে পরিণত হয়।"

দার্শনিক থমাস হবস এর মতে, "প্রজাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম ক্ষমতা প্রাপ্ত ব্যক্তির আদেশই আইন।"

গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, "আইন হলো আবেগ বর্জিত যুক্তি।"

আইনের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য

আইন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে সুসংহত করে। এটি সমাজবদ্ধ মানুষের সুন্দর ও সুশৃংখল জীবন যাপনের একটা পথ প্রশস্থ করে। বস্তুত আইন সার্বজনীন ও সর্বগ্রাহী। আইন বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমুন্ডিত। নিচে আইনের বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করা হলো-
১. সামাজিক সংস্থায় প্রয়োগ: আইন সমাজ ও মানবীয় সংস্থায় প্রযুক্ত হয়। অতএব, উন্মাদ, শিশু কিংবা সন্ন্যাসীর কাছে আইন অর্থহীন। আইন মানবিক সংস্থায় প্রয়োগ ও কার্যকর হয়ে থাকে।

২. সর্বজনীনতা: আইন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের ওপর সমভাবে প্রযোজ্য হয়। এক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য করা হয় না। আইনের চোখে সকলেই সমান।

৩. বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ: আইন মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ ও বাস্তব কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের চিন্তা- ভাবনা, ধ্যান-ধারণা, অনুভূতির সাথে আইনের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই।

৪. সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টতা: আইনের ধারাসমূহ সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্টভাবে লিখিত থাকে। তাই আইন সকলের নিকট বোধগম্য হয়। আইনের ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলে উচ্চ আদালত সে ব্যাপারে ব্যাখ্যা প্রদান করে।

৫. রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ও সামাজিক স্বীকৃতি: আইন রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত ও সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত। রাষ্ট্রের অনুমোদন ও সমাজের সম্মতি ছাড়া কোনো বিধি-বিধান আইনে পরিণত হতে পারে না।

৬. বাধ্যবাধকতা: বাধ্যবাধকতা আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ, আইন মেনে চলা রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক। আইন ভঙ্গ করলে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হয়।

৭. পরিবর্তনশীলতা: আইন পরিবর্তনশীল। সময় ও জনগণের চাহিদা মোতাবেক অনেক পুরনো আইন বাতিল, নতুন আইন প্রণয়ন করা হতে পারে। অনেক সময় প্রচলিত আইনসমূহের সংশোধন, পরিবর্তন করা হয় সময়ের প্রয়োজনে, জনগণের কল্যাণে।

প্রাচীনকালের আইনগুলো ছিল ধর্মভিত্তিক। তাই ধর্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ আইন মেনে চলত। কিন্তু বর্তমানের আধুনিক যুগে মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাস্তির ভয়ে আইন মেনে চলে। এছাড়াও অধিকার সংরক্ষণের জন্য, ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য, ন্যায় প্রতিষ্ঠা, সম্প্রীতি বজায় রাখা প্রভৃতি কারণেও মানুষ আইন মেনে চলে।
 
এ প্রসঙ্গে হবস বলেছেন, "মানুষ ভালো করেই জানে যে আইন অমান্য করলে সমাজের মধ্যে পুনরায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হবে, এ সত্য উপলব্ধি থেকেই মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার শিক্ষা নেয়।'' 

জন অস্টিন মনে করেন, ''আইন রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত ও জনসাধারণ কর্তৃক সমর্থিত এবং প্রযুক্ত হয় বলে মানুষ আইন মেনে চলে।"

আইনের উৎস 

আইনের আনুষ্ঠানিক উৎস হলো সংবিধান। আইনের দুটি উৎস হলো- 
i. প্রথা, 
ii. আইনসভা। 

অধ্যাপক হল্যান্ড আইনের ছয়টি উৎসের কথা বলেছেন। যথা- প্রথা, ধর্ম, বিচারকের রায়, আইনবিদদের গ্রন্থ, ন্যায়বোধ, আইনসভা।

তবে উল্লিখিত ছয়টি উৎস ছাড়াও আইনের আরো কতিপয় উৎস রয়েছে। নিচে আইনের উৎসগুলো উল্লেখ করা হলো: 
১. প্রথা: সুদীর্ঘকাল ধরে সমাজে প্রচলিত আচার-ব্যবহার, রীতিনীতিকে প্রথা বলা হয়। প্রথা হলো আইনের প্রাচীনতম উৎস। কোনো এক সময়ে কোনো এক ব্যক্তি হয়তো বিশেষ একটি রীতি সমাজে প্রবর্তন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে যখন সমাজের অনেকেই সেই রীতি অনুসরণ করতে থাকে তখনই তাকে প্রথা বলা হয়। 
প্রাচীনকালে পরিবারের সঙ্গে পরিবারের, গোষ্ঠীর সঙ্গে গোষ্ঠীর বিরোধ দেখা দিলে পরিবারপ্রধান বা গোষ্ঠীপতি প্রচলিত প্রথা অনুসারে সেইসব বিরোধের নিষ্পত্তি করতেন। কালক্রমে সেইসব আচার-আচরণ জনসমর্থন লাভ করলে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে সেগুলো আইনের মর্যাদা লাভ করে। উদাহরণ হিসেবে ব্যাবিলনের সম্রাট হাম্মুরাবি তার সমাজের মূল্যবোধগুলো Coding (কোডিং) করে একটি আইনের বই লিখেছিলেন। 

আধুনিককালেও প্রতিটি রাষ্ট্রের আইনের মধ্যে প্রথাগত আইনের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তাছাড়া ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত হওয়ায় সেখানে প্রথাগত আইন ও শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতিগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।

২. ধর্মীয় বিধিবিধান: ধর্ম আইনের একটি প্রধান উৎস। ধর্মীয় অনুশাসন এবং ধর্মগ্রন্থ হতে আইনের উৎপত্তি হয়ে থাকে। মধ্য ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতা একই হস্তে পরিচালিত ছিল। শাসনকর্তা রাজ্য শাসন করতে গিয়ে ধর্মীয় বিধিবিধান প্রয়োগ করতেন। বর্তমানেও ধর্মীয় বিধিবিধান থেকে উৎপত্তিগত আইন অনেক দেশে কার্যকর রয়েছে। বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর পারিবারিক, সম্পত্তি ও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইনটি ইসলাম ধর্মীয় গ্রন্থ ও বিধিবিধান থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। ফলে এই আইনকে সবাই মেনে চলে ধর্মীয় শ্রদ্ধাবোধ থেকে, বাধ্য হয়ে নয়।

৩. বিচারকের রায়: বিচারক অনেক সময় বিচারকালে নতুন নতুন আইন সৃষ্টি করেন। যখন প্রচলিত কোনো আইন যারা কোনো মোকদ্দমার নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয় না তখন বিচারকদের নতুন আইন তৈরি করে তার নিষ্পত্তি করতে হয়। এভাবে প্রণীত আইনকে 'বিচারক প্রণীত আইন' (Judge Made Laws) বা বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা" (Judicial Review) বলা হয়।

৪. বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা: প্রখ্যাত আইনবিদদের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনাও আইনের অন্যতম একটি উৎস। আইনজ্ঞদের ব্যাখ্যা ও আলোচনা অনেক সময় আইনের প্রকৃত অর্থ প্রকাশ করে। এ ব্যাখ্যা আদালতে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে গৃহীত হয়ে থাকে। মুসলিম আইন গ্রন্থ 'হেদায়া' ও 'আলমগিরি'; ইংল্যান্ডের কোক (Coke) লিখিত 'ইনস্টিটিউটস', আলবার্ট ভ্যান ডাইসি (Albert Venn Diecy) লিখিত 'ল অব দি কনস্টিটিউশনস' ইত্যাদি গ্রন্থ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

৫. ন্যায়বোধ: ন্যায়রোধ আইনের অপর একটি মূল্যবান উৎস। বিচারকগণ অনেক সময় বিচারকার্য সম্পন্ন করতে গিয়ে সামাজিক ন্যায়বোধ ও বিচার-বুদ্ধির আশ্রয় গ্রহণ করে থাকেন। বিচারকদের ন্যায়বোধ হতে এভাবে নতুন আইন সৃষ্টি হয়।

৬. আইনসভা: আইনসভাকে আইনের আধুনিক উৎস বলা হয়ে থাকে। বর্তমানে প্রত্যেক দেশের আইনসভা রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনার জন্য যাবতীয় আইন প্রণয়ন করে। এক্ষেত্রে অবশ্য জনমতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে স্বীকৃত। আইনসভা প্রণীত আইন সামাজিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটায়

৭. জনমত: জনমত আইনের উৎসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইন প্রণয়নের সময় জনমতের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রেখে প্রণয়ন করা উচিত। বিশিষ্ট আইনজ্ঞ অপেন হেইমার এর ভাষায়, 'জনমত আইনের অন্যতম উৎস।'

৮. নির্বাহী ঘোষণা ও ডিক্রি: আধুনিককালে শাসনব্যবস্থার জটিলতার কারণে আইনসভা তার কর্তৃত্বের এক বিরাট অংশ শাসনবিভাগের কর্মকর্তাদের হাতে অর্পণ করে। এছাড়া শাসন বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে স্বীয় ক্ষমতাবলে প্রয়োজনীয় ঘোষণা ও ডিক্রি জারি করে থাকেন। এরূপ জারিকৃত সকল ঘোষণা বা আদেশকে প্রশাসনিক আইন বলা হয়।

আইনের শ্রেণিবিভাগ

ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানাদি সব কিছুই আইনের অধীন। আর তাই ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির, ব্যক্তির সাথে রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্কের ভিত্তিতে আইনজ্ঞ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং সমাজবিজ্ঞানিগণ আইনের শ্রেণিবিভাগ করেছেন।
আইনের ধারণা
নিম্নে আইনের প্রকারভেদ সম্পর্কে সবিস্তারে আলোকপাত করা হলো: আইন প্রধানত তিন প্রকারের। যথা:
ক. বেসরকারি আইন (Private law)
খ. সরকারি আইন (Public law) এবং 
গ. আন্তর্জাতিক আইন (International law)

ক. বেসরকারি আইন (Private law): সমাজে ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক রক্ষার জন্য যে সকল আইন প্রয়োগ করা হয় এবং মান্য করা হয় তাকে বেসরকারি আইন বলে। বেসরকারি আইনের প্রয়োগ ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে। চুক্তি, দলিল, দেওয়ানী বিধি এই আইনের অন্তর্ভুক্ত।

খ. সরকারি আইন (Public law): রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে আইন প্রবর্তিত ও প্রয়োগ করা হয় তাকে সরকারি আইন বলে। সরকারি আইনের দ্বারাই রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারিত হয়, রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন, কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন, নাগরিকদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা ইত্যাদি হয়ে থাকে। এই আইন আবার চার প্রকার যা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

১. সাংবিধানিক আইন (Constitutional law): যে সমস্ত বিধানাবলি লিখিত কিংবা অলিখিত অবস্থায় রাষ্ট্রের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয় তাই সাংবিধানিক আইন। সাংবিধানিক আইনকে মৌলিক আইনও বলা হয়। এই আইনের দ্বারাই রাষ্ট্রের তিনটি অপরিহার্য অঙ্গ-সংগঠন তথা— আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের গঠন ও কার্যাবলি নির্ধারিত হয় । শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয়, আঞ্চলিক ভিত্তিতে কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন ও সরকারের স্বরূপ নির্ধারিত হয় এই আইনের মাধ্যমে। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলোবী বলেন, "সাংবিধানিক আইন সেই সকল বিধান যা সরকারের স্বরূপ এবং সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন ও নিয়ন্ত্রণের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।"

২. প্রশাসনিক আইন (Administrative law): ব্রিটিশ শাসনতন্ত্র বিশেষজ্ঞ আইভর জেনিংস (Ivor Jennings) বলেন, “রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা সংক্রান্ত আইনকে প্রশাসনিক আইন বলে। এই আইনের মাধ্যমে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের সংগঠন, ক্ষমতা ও দায়িত্ব নিরূপিত হয়।” 

আবার অধ্যাপক রবসন মনে করেন, "লোকপ্রশাসন সংক্রান্ত আইনই প্রশাসনিক আইন।" কর্মচারী প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বসাধারণের কল্যাণমূলক কার্যাবলি পরিচালনার ক্ষেত্রে এই আইন প্রযুক্ত হয়।

৩. ফৌজদারি আইন (Criminal law): আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকল্পে রাষ্ট্র যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে সেগুলোর বিরোধিতা করা বা অমান্য করাকে রাষ্ট্র অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে। এহেন অপরাধের শাস্তি বিধান এবং কারও অধিকার ভঙ্গ করা থেকে বিরত রাখার জন্য রাষ্ট্র যে সমস্ত আইন প্রয়োগ ও বলবৎ করে, তাই ফৌজদারি আইন।

৪. ফৌজদারি আইন সংক্রান্ত বিধি (Criminal procedure): রাষ্ট্রের অধিকারের বিরুদ্ধে অথবা আইন-শৃঙ্খলার পরিপন্থী অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কোনো অপরাধীকে যে পদ্ধতিতে শাস্তি প্রদান করা হয়, তাই ফৌজদারি আইন সংক্রান্ত বিধি।

গ. আন্তর্জাতিক আইন (International law): যে সকল আইনের দ্বারা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাকে আন্তর্জাতিক আইন বলে। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ওপেনহেইম-এর মতে, "আন্তর্জাতিক আইন হলো সেই সব নিয়ম-কানুন ও চুক্তির সমষ্টি, যার আইনগত বাধ্যবাধকতা সভ্য রাষ্ট্রসমূহ পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মেনে চলে।"

আইন প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষের প্রকৃতির ভিত্তিতে আইনকে চার ভাগে ভাগ করা হয়। যথা: 
১. সংবিধি (Statute): আইনসভা কর্তৃক নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যে সকল আইন প্রণীত হয় সেগুলোকে সংবিধি বলে। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রেই সংবিধির উপস্থিতি লক্ষণীয়।

২. অধ্যাদেশ (Ordinance): শাসন বিভাগের প্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের জারিকৃত আদেশকে অধ্যাদেশ বলে। সাধারণত আইন সভা অধিবেশনরত না থাকলে বা ভেঙে গেলে রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক অধ্যাদেশ জারি হয়ে থাকে। পরবর্তীতে আইনসভা কর্তৃক অধ্যাদেশগুলো অনুমোদিত হলে তা আইনে পরিণত হয়।

৩. সাধারণ আইন (Common Law): সমাজে বহুল প্রচলিত প্রথা, রীতিনীতি, অভ্যাস, বোঝাপড়া, কলাকৌশল ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে যে সমস্ত বিধি-বিধান গড়ে ওঠে তাকে সাধারণ আইন বলে। সাধারণ আইনগুলো সমাজের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে চলে। সাধারণ আইন আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য নয়। ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় অধিকাংশ আইনই এভাবে প্রথা ও রীতিনীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

৪. সামরিক আইন (Martial Law): নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণকারী সামরিক জান্তা কর্তৃক জারিকৃত বিধান অথবা সাংবিধানিক উপায়ে রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক জারিকৃত সামরিক শাসনের বিধানকে সামরিক আইন বলে। সামরিক আইন কোনো স্থায়ী বিধান নয়। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসলে সামরিক আইনের বিলুপ্তি ঘটে।

মানুষ কেন আইন মেনে চলে?

কোন কোন যুক্তির নিরিখে সামাজিক মানুষ আইনকে মেনে চলে বা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে নানা মত রয়েছে । এসব মতামত বিশ্লেষণ করে মানুষ যেসব কারণে আইন মেনে চলে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :

১. ধর্মীয়বোধ: প্রাচীনকালে শাসককে ঈশ্বরের প্রতিনিধি মনে করা হতো। সুতরাং রাজা বা সম্রাটের আদেশ মেনে চলাকে মানুষ ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করত। তাই জনগণ আইন মেনে চলত।

২. সম্মতি: সামাজিক চুক্তিবাদী দার্শনিক যেমন- হবস, লক, রুশোর মতে, "মানুষের সম্মতিই আইন মেনে চলার কারণ।" জনগণের সম্মতি বা রায় নিয়েই রাষ্ট্রীয় আইন ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার আইন প্রণয়ন করে বলে জনগণ আইন মেনে চলে।

৩. শাস্তির ভয়: টমাস হবস, বেন্থাম, অস্টিন মনে করেন, শাস্তির ভয়ে মানুষ আইন মেনে চলে। প্রতিটি রাষ্ট্রে আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদানের বিধান রয়েছে। আইন ভঙ্গের পরিণতি সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা মানুষকে আইন মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করে।

৪. গুরুত্ব ও উপযোগিতা: আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ আইন মেনে চলার কারণ হিসেবে আইনের প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আইন ছাড়া সুশৃঙ্খল জীবনযাপন সম্ভব নয়। আইন না মানলে সমাজে নৈরাজ্য দেখা দিবে। মানুষের জীবন হয়ে ওঠবে দুর্বিষহ। তাই সুন্দর ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য মানুষ আইন মেনে চলে।

৫. নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষার জন্য: আইন সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনে নিরাপত্তা প্রদান করে। অধিকারকে করে সুসংহত। আইনের মাধ্যমে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। আর্নেস্ট বার্কার তাই বলেন, মানুষ আইন মেনে চলে কারণ আইন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে।

৬. সামাজিক কল্যাণ: সমাজের মানুষ সম্যকভাবেই উপলব্ধি করতে পারে যে, সমাজের কল্যাণ বিধান করাই হলো আইনের লক্ষ্য । তাছাড়া আইনের ভিত্তি হলো 'জনমত'। আবার, টি. এইচ. গ্রীন (T. H. Green) বলেন, "Will, not force, is the basis of the state." অর্থাৎ শক্তি নয়, ইচ্ছাই রাষ্ট্রের ভিত্তি। সুতরাং রাষ্ট্র সৃষ্ট আইনের বিরুদ্ধাচরণ করার অর্থ হলো নিজেদের বিরোধিতা করা। এ সত্যানুসন্ধান ও সত্যোপলব্ধি মানুষকে স্বাভাবিকভাবে আইন মেনে চলতে উৎসাহ যোগায়।

৭. শক্তি প্রয়োগ: মার্কসবাদী দার্শনিকদের মতে, আইন সমাজে একটি বিশেষ উৎপাদন সম্পর্ক (Relation of production) টিকিয়ে রাখে। সমাজের উৎপাদন যন্ত্র যখন যে শ্রেণির কর্তৃত্বাধীনে থাকে তখন আইন সেই শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে। আইনের পশ্চাতে আছে প্রভাবশালী শ্রেণির বল প্রয়োগকারী যন্ত্র তথা রাষ্ট্র। রাষ্ট্র বল প্রয়োগ করে থাকে সশস্ত্র বাহিনী ও বিচার বিভাগের মাধ্যমে। সুতরাং, রাষ্ট্র বল প্রয়োগ করে জনগণকে আইন মানতে বাধ্য করে।

পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজ ও ব্যক্তিজীবনকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করে গড়ে তুলতে আইনের কোনো বিকল্প নেই। মানুষের আচার-আচরণের প্রতি সহানুভূতিবশত একে অপরকে অনুসরণ করে আইন মেনে চলে। সেই সাথে আইন ভঙ্গের কারণে রাষ্ট্র যে শাস্তির বিধান করে এ সত্য উপলব্ধির কারণে মানুষ স্বভাবজাতভাবে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে।

আন্তর্জাতিক আইনের উৎস

আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হল সংস্থা ও চুক্তি যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে গঠিত হয়েছে। এই সংস্থা এবং চুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক কানুন গড়ে তোলা হয়। প্রথম আন্তর্জাতিক সংস্থা ছিল লিগ অফ নেশনস যা ১৯২০ সালে গঠিত হয়। লিগ অফ নেশনস সমস্ত দেশের মধ্যে শান্তি এবং সাম্প্রদায়িক সহযোগিতা স্থাপন করার লক্ষ্যে গঠিত হয়। এরপর বহুধা আন্তর্জাতিক সংস্থা ও চুক্তি গঠন করা হয়েছে, যেমন যুক্তরাষ্ট্র সংস্থা (UN), বিশ্ব ট্রেড অর্গানাইজেশন (WTO), আন্তর্জাতিক আইনগণিত ইকোসিস্টেম (ILCE) ইত্যাদি।

আইনের ভিত্তি কি?

আইনের ভিত্তি আইনি ব্যবস্থা এবং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে যা এটিকে অবহিত করে। যাইহোক, কিছু সাধারণ নীতি এবং উত্স রয়েছে যা প্রায়শই আইনের ভিত্তি হিসাবে কাজ করে: 
 আইন প্রণয়ন: আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আইন তৈরি করা যেতে পারে, যার মধ্যে সংসদ বা কংগ্রেসের মতো আইন প্রণয়নকারী সংস্থা দ্বারা আইন বা আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া জড়িত। আইন এমন নিয়ম ও প্রবিধান নির্ধারণ করে যা সমাজকে পরিচালনা করে এবং ফৌজদারি আইন, দেওয়ানী আইন, সাংবিধানিক আইন এবং প্রশাসনিক আইন সহ বিস্তৃত ক্ষেত্রকে কভার করতে পারে। 

 সাধারণ আইন: সাধারণ আইন হল একটি আইনি ব্যবস্থা যা বিচারিক সিদ্ধান্ত এবং সময়ের সাথে আদালত দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নজির থেকে উদ্ভূত হয়। এটি স্টেয়ার ডিসিসিসের নীতির উপর নির্ভর করে, যার অর্থ নিম্ন আদালতগুলি অনুরূপ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আইনি নীতিগুলি অনুসরণ করতে বাধ্য। সাধারণ আইন প্রায়ই বিচারিক ব্যাখ্যার একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিকশিত হয় এবং যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে প্রচলিত। 

 সাংবিধানিক আইন: অনেক আইনি ব্যবস্থা একটি সংবিধানের উপর ভিত্তি করে তৈরি, যা একটি মৌলিক দলিল যা সরকারের কাঠামো, ক্ষমতার বণ্টন এবং ব্যক্তির অধিকার ও স্বাধীনতা নির্ধারণ করে। সাংবিধানিক আইন মৌলিক নীতিগুলি প্রতিষ্ঠা করে যার দ্বারা একটি দেশ পরিচালিত হয় এবং অন্যান্য আইন তৈরি করার জন্য একটি কাঠামো প্রদান করে। 

 আন্তর্জাতিক আইন: আন্তর্জাতিক আইন এমন নিয়ম ও নীতি নিয়ে গঠিত যা সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক অভিনেতাদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করে। এটি মানবাধিকার, কূটনীতি, বাণিজ্য এবং সশস্ত্র সংঘাতের মতো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ন্ত্রণ করে এমন চুক্তি, চুক্তি, সম্মেলন এবং প্রথাগত অনুশীলনগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে। 

 আইনি নজির: নজিরগুলি অনেক আইনি ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে যেগুলি সাধারণ আইন দ্বারা প্রভাবিত হয়। নজির হল পূর্ববর্তী মামলাগুলিতে উচ্চ আদালতের দ্বারা নেওয়া সিদ্ধান্ত যা আইনি নীতি এবং ব্যাখ্যা প্রতিষ্ঠা করে। নিম্ন আদালতগুলি অনুরূপ মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এই নজিরগুলি অনুসরণ করবে বলে আশা করা হয়, আইনের প্রয়োগে ধারাবাহিকতা এবং পূর্বাভাসযোগ্যতা নিশ্চিত করে৷ 

 আইনি নীতি এবং নীতিশাস্ত্র: আইনি ব্যবস্থা প্রায়ই মৌলিক আইনী নীতি এবং নৈতিক বিবেচনাকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই নীতিগুলির মধ্যে ন্যায়বিচার, ন্যায্যতা, সমতা এবং ব্যক্তি অধিকারের সুরক্ষার মত ধারণা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। নৈতিকতা এবং নৈতিক মূল্যবোধগুলিও আইন গঠনে ভূমিকা পালন করে, কারণ আইন প্রণেতা এবং বিচারকরা প্রায়ই আইনি সিদ্ধান্তের নৈতিক প্রভাব বিবেচনা করে। 

 এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে বিভিন্ন আইনি ব্যবস্থা এবং বিচার বিভাগ বিভিন্ন উত্স এবং নীতিকে অগ্রাধিকার দিতে এবং জোর দিতে পারে এবং আইনের ভিত্তি সময়ের সাথে আইনি সংস্কার, সামাজিক পরিবর্তন এবং আইনি দর্শনে পরিবর্তনের মাধ্যমে বিকশিত হতে পারে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url