হিসাব || Account
হিসাবের ধারণা
ইংরেজি 'Account' শব্দটি প্রাচীন ফরাসি 'Accounter' হতে উদ্ভূত হয়েছে, যার অর্থ দাঁড়ায় গণনা করা বা হিসাব রাখা। ইংরেজিতেও "Account" শব্দটি হিসাব বা হিসাব খাতকে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। আভিধানিক অর্থে হিসাব শব্দটির অর্থ জমা-খরচের বিবরণী। লেনদেন সংঘটিত হওয়া মাত্র সংশ্লিষ্ট হিসাবপক্ষসমূহকে যথাযথ হিসাব শিরোনামের আওতায় আনা হয়। অর্থাৎ একজাতীয় হিসাব পক্ষসমূহকে স্ব-স্ব হিসাবে লিপিবদ্ধ করে হিসাবের উদ্বৃত্ত বের করা হয়। হিসাববিজ্ঞানের ভাষায় লেনদেনের সাথে সংশ্লিষ্ট পক্ষ বা খাতসমূহকে প্রকৃতি অনুযায়ী শ্রেণিবদ্ধ করে পৃথক শিরোনামে লিখে রাখার প্রক্রিয়াকে হিসাব বলা হয়।
সুতরাং ব্যবসায়ে সংঘটিত লেনদেনসমূহকে লিপিবদ্ধকরণ, শ্রেণিবদ্ধকরণ ও সংক্ষেপকরণের একটি মৌলিক প্রক্রিয়া হলো হিসাব। হিসাবসমূহের উদ্বৃত্ত (balance) দ্বারা আর্থিক ফলাফল (লাভ/ক্ষতি) ও আর্থিক অবস্থা (আর্থিক বিবরণী) নির্ণয় করা যায়। পরবর্তীতে প্রতিটি হিসাব খাত/খাতসমূহের উদ্বৃত্ত আর্থিক বিশ্লেষণেও কাজে লাগে। আধুনিক ও পূর্ণাঙ্গ হিসাব ব্যবস্থায় প্রতিটি লেনদেনে দুইটি পক্ষ বা হিসাব খাত জড়িত থাকে। কোনো লেনদেন সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথে দ্বৈতসত্তায় বিশ্লেষণ করে যথাযথ হিসাব শিরোনামে লেখা হয়। যেমন- মজুরি প্রদান করা হলো। এখানে একটি হলো মজুরি হিসাব, আরেকটি হলো নগদান হিসাব।
এভাবে প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য লেনদেন সংঘটিত হওয়ার প্রেক্ষিতে এ হিসাবসমূহের কতগুলো হয় আয় (Revenue) সংক্রান্ত, কতগুলো খরচ (Expense) সংক্রান্ত, কতগুলো সম্পদ (Asset) সংক্রান্ত, কতগুলো দায় (Liability) সংক্রান্ত, কতগুলো মালিকানা স্বত্ব (Owners equity) সংক্রান্ত এবং কতগুলো হয় বিলম্বিত/অ-সমন্বিত আয়/খরচ সংক্রান্ত। অতএব বলা যায়, কোনো প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট সম্পত্তি, দায় বা মালিকানা স্বত্বের লেনদেনে একটি হিসাবকালে যে পরিবর্তন আসে তা লিপিবদ্ধ করাই হচ্ছে হিসাব।
হিসাবের অর্থ ও সংজ্ঞা
হিসাবরক্ষণের নিয়মানুযায়ী উপযুক্ত শিরোনামের অধীনে সাজানো কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সম্পত্তি, আয় বা ব্যয় সংক্রান্ত লেনদেনগুলোর প্রকৃতি বা সত্তা বিশ্লেষণ করে যখন হিসাবের বইতে সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করা হয়, তাকে হিসাব বা হিসাব খাত বলে। যেমন- বেতন দেয়া হলো। এখানে একটি হলো বেতন হিসাব, অন্যটি হলো নগদান হিসাব। এভাবে প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত লেনদেনগুলোকে ব্যক্তিবাচক হিসাবে, সম্পত্তি সংক্রান্ত লেনদেনগুলোকে সম্পত্তিবাচক হিসাবে এবং আয়-ব্যয় সংক্রান্ত লেনদেনগুলোকে নামিক হিসাবে লিপিবদ্ধ করা হয়।
সুতরাং হিসাবশাস্ত্রের নীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী যথাযথভাবে লেনদেনসমূহকে বিশ্লেষণ করে সমজাতীয় আয়, ব্যয়, সম্পত্তি, দায় এবং ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী পৃথকভাবে সংক্ষিপ্ত আকারে সাজিয়ে হিসাবের বইতে উপযুক্ত শিরোনামের অধীনে পৃথক পৃথক স্থানে লিপিবদ্ধ করাকেই হিসাব বলে। প্রত্যেকটি হিসাব থেকেই একটি নির্দিষ্ট সময় পর উদ্বৃত্ত জানা যায়। যেমন- ব্রুয় হিসাবে ক্রয় হ্রাস-বৃদ্ধি লিপিবদ্ধ করা হয় এবং তা হতে মোট ক্রয়ের পরিমাণ জানা যায়। একইভাবে প্রাপ্য বিল হিসাবে প্রাপ্য বিলের হ্রাস- বৃদ্ধি, প্রদেয় বিল হিসাবে প্রদেয় বিলের হ্রাস-বৃদ্ধি যন্ত্রপাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতি হ্রাস-বৃদ্ধি ইত্যাদি হিসাবভুক্ত করা হয়।
উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, নির্দিষ্ট হিসাবকাল শেষে সমজাতীয় লেনদেনগুলোকে একত্র করে হিসাববিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট নীতি অনুসারে যথাযথভাবে পৃথক শিরোনামের মাধ্যমে যে তালিকা বা বিবরণী প্রস্তুত করা হয়, তাকে হিসাব বা হিসাব খাত বলে।
হিসাবের বৈশিষ্ট্য
প্রতিষ্ঠানে লেনদেনসমূহ সংঘটিত হওয়ার পর তার সাথে জড়িত পক্ষসমূহকে যখন উপযুক্ত শিরোনামে স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ করা হয় তখন তাকে হিসাব বলে। একটি হিসাবের সাধারণত নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ থাকে।
১. শিরোনাম (Title): প্রত্যেক হিসাবের জন্য একটি উপযুক্ত শিরোনাম থাকবে। যেমন- আসবাবপত্র হিসাব, ক্রয় হিসাব, 'বেতন হিসাব, মনিহারি হিসাব ইত্যাদি।
২. হিসাব কোড (Account Code): বর্তমানে আধুনিক হিসাব ব্যবস্থায় সহজ ও সুষ্ঠুভাবে হিসাব লিপিবদ্ধ ও তার ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে প্রতিটি হিসাবের জন্য একটি কোড ব্যবহার করা হয়। হিসাব কোড ব্যবহার করে খুব সহজেই হিসাব চিহ্নিত এবং লেনদেন হিসাবভুক্ত করা যায়।
৩. নির্দিষ্ট কাঠামো (Specific Structure): প্রতিটি হিসাব নির্দিষ্ট ছক বা কাঠামোতে সাজানো হয়। এই কাঠামোর বাম দিকে ডেবিট ও ডান দিকে ক্রেডিট অংশ থাকে।
৪. দুটি দিক (Two Sides): 'T' ছক সনাতন ছক অনুযায়ী হিসাবকে দুটি ভাগে ভাগ করে বামদিককে ‘ডেবিট' দিক এবং ডান দিককে ‘ক্রেডিট’.দিক ধরা হয়। তাছাড়া আবার প্রত্যেকটি দিকে তারিখ, বিবরণ, জাবেদা পৃষ্ঠা এবং টাকার পরিমাণ--এ চারটি কলামে বা ঘরে ভাগ করা হয়।
৫. তারিখ (Date): প্রতিটি হিসাবে তারিখ অনুযায়ী লেনদেনের সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ হিসাবভুক্ত হয়।
৬. দ্বৈতসত্তা অনুসরণ (Maintenance of Double Entity): লেনদেনগুলো হিসাবে লিপিবদ্ধ করতে দ্বৈতসত্তা অনুসরণ করা হয়। অর্থাৎ লেনদেনের দুটি পক্ষ নির্ণয়ের পর খতিয়ানের একটি হিসাবে ‘ডেবিট’ এবং অন্য হিসাবে ‘ক্রেডিট' করতে হয়।
৭. শ্রেণিবিন্যাস (Classification): একটি নির্দিষ্ট হিসাবকালে ব্যবসায়ের যে অসংখ্য লেনদেন সংঘটিত হয়, তাদের প্রকৃতি অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাস করে নির্দিষ্ট শিরোনামে লেখা হয় ৷
৮. ফলাফল নির্ণয় (Determination of Result): উপযুক্ত শিরোনামের অধীনে লিখিত লেনদেনগুলোর সমষ্টিকরণের মাধ্যমে ফলাফল নির্ণয় করা হয়। উদাহরণ- নগদান হিসাব প্রস্তুতের মাধ্যমে জমা এবং খরচ সম্পর্কীয় ফলাফলস্বরূপ হাতে নগদ টাকা নির্ণয় করা হয়। অনুরূপভাবে দেনাদার ও পাওনাদারের হিসাব প্রস্তুতের মাধ্যমে দেনা বা পাওনাদারের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়।
৯. জের টানা (Balancing): একটি নির্দিষ্ট সময় শেষে প্রতিটি হিসাবের সমতা বিধানের জন্য জের টানা হয়। ডেবিট দিক বড় হলে ডেবিট উদ্বৃত্ত এবং ক্রেডিট দিক বড় হলে ক্রেডিট উদ্বৃত্ত বলা হয়।
১০. রেফারেন্স (Reference): প্রতিটি হিসাবের একটি রেফারেন্স কলাম থাকে। এর মাধ্যমে জানা যায় সংশ্লিষ্ট লেনদেনটি প্রাথমিকভাবে অর্থাৎ জাবেদা বইয়ের কোথায় কত পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং তদানুযায়ী তার প্রামাণ্য দলিলসমূহ খুঁজে পাওয়া যায়।
১১. গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাই (Verification of Arithmetical Accuracy): হিসাবসমূহের ডেবিট ও ক্রেডিট Balance বা জের দ্বারা রেওয়ামিল প্রস্তুতের মাধ্যমে হিসাবের গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাই করা যায়।
১২. হিসাবের সমাপন (Ending of Account): আয়-ব্যয়বাচক হিসাবসমূহের জের আয় বিবরণীতে হিসাবে স্থানান্তর করে হিসাব বন্ধ করা হয়। অর্থাৎ এ জাতীয় হিসাবসমূহের জের পরবর্তী বছরে নেয়া হয় না। কিন্তু সম্পদ, দায় ও মালিকানাস্বত্ব জাতীয় হিসাবসমূহের জের পরবর্তী বছরে নেয়া হয় অর্থাৎ এ হিসাবসমূহ স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয় না। হিসাবকালের শেষে শুধু উদ্বৃত্ত জানার জন্য জের টানা হয়।
১৩. সমাপ্তি রেখা (Closing Lines): একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর হিসাবের জের বের করে সমাপ্তি রেখা টেনে ঐ সময়ের জন্য হিসাব বন্ধ করা হয়।
উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে আমরা সহজেই হিসাব খাত চিহ্নিত করতে পারব।