হিসাবচক্র || Accounting Cycle

হিসাবচক্রের ধারণা

হিসাবচক্র হলো কার্যকরভাবে হিসাব সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ শনাক্তকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও প্রকাশের একটি ধারাবাহিক কার্যক্রম যা একটি হিসাবকালে সম্পাদিত হয়।

হিসাববিজ্ঞান চলমান প্রতিষ্ঠান ধারণা (Going Concern Concept) অনুযায়ী একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশেষ কোনো ব্যতিক্রম ছাড়া অনন্তকাল পর্যন্ত চলতে থাকবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের মালিক বা এর সাথে জড়িত বিভিন্ন পক্ষসমূহ একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা তথা আয়, ব্যয়, দায়, সম্পত্তি প্রভৃতির অবস্থা জানতে চায়। এসব আর্থিক তথ্য ব্যবহার করে বিভিন্ন বিবরণী তৈরি করা হয় যা আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। এর জন্য ব্যবসায় বা কারবার প্রতিষ্ঠানের অনন্ত সময়কালকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে ঐ সময়ের আয় বিবরণী ও আর্থিক অবস্থার বিবরণী তৈরি করে প্রতিষ্ঠানের আয় বা ক্ষতি ও দায় সম্পত্তির মূল্য নিরূপণ করা হয়। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সময়কালকে বলা হয় এক একটি হিসাবকাল (Accounting period)। হিসাবকাল যেকোনো সময়ের জন্য হতে পারে তবে এক বছর সময়কালই সর্বজনস্বীকৃত ও প্রচলিত হিসাবকাল। প্রতিষ্ঠান চালু থাকলে একটি হিসাবকাল শেষ হলে আরেকটি হিসাবকাল চালু হয়ে যায়।

সুতরাং, দেখা যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানের লেনদেন চিহ্নিতকরণ ও লিপিবদ্ধকরণ হতে শুরু করে আর্থিক ফলাফল ও আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে তথ্য প্রদান সংক্রান্ত হিসাববিজ্ঞানের এই প্রক্রিয়াটি প্রতিটি হিসাবকালে পর্যায়ক্রমিক বিভিন্ন ধাপে চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকে। হিসাববিজ্ঞানের এ চক্রাকার প্রক্রিয়া, পর্যায় বা ধারাবাহিক আবর্তন মেনে চলাকেই হিসাবচক্র বলে। 

হিসাবচক্রের সংজ্ঞা 

হিসাবচক্র প্রসঙ্গে কয়েকজন হিসাববিজ্ঞানীর সংজ্ঞা প্রদত্ত হলো :
১. হারম্যানসন এবং অন্যান্যদের মতে, "Accounting Cycle is a Series of steps related to accumulating. Processing and reporting useful financial information that are performed during an accounting period." অর্থাৎ “হিসাবচক্র হলো, কার্যকরী আর্থিক তথ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও প্রকাশকরণের একটি ধারাবাহিক ধারা বা পর্যায় যা একটি হিসাবকালে সম্পাদিত হয়।”

২. J. R Batliboi -এর মতে, "The order on sequence in which the accounting procedures are performed is Known as accounting cycle. " অর্থাৎ “যে পদ্ধতিতে এবং ধারাবাহিকতার মধ্যে হিসাববিজ্ঞানের কার্যক্রম সম্পাদিত হয় তাকে হিসাবচক্র বলে।”

3. The institute of cost and works Accountants of India (ICWAI)-এর মতে, "The vanious steps in the total Processing of Accounting data." অর্থাৎ “হিসাবচক্র হলো হিসাববিজ্ঞানের উপর সামগ্রিক প্রক্রিয়াকরণের বিভিন্ন ধাপসমূহ।

একটি হিসাবকালের শেষে কারবারের আর্থিক ফলাফল ও আর্থিক অবস্থা জানার জন্য প্রথমেই লেনদেনগুলো চিহ্নিত -করে দুতরফা দাখিলার নিয়মানুসারে হিসাবের প্রাথমিক বই বা জাবেদায় লিপিবদ্ধ করা হয়। জাবেদা হতে হিসাবের প্রকৃতি অনুযায়ী হিসাবগুলোকে আলাদা করে পাকা পাকিভাবে লেখার কাজকে খতিয়ানভুক্তকরণ বলে। হিসাবকাল শেষে তথ্যসমূহকে আরও সংক্ষিপ্ত করে গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাইয়ের জন্য রেওয়ামিল তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে রেওয়ামিলের মুনাফাজাতীয় দফাগুলো নিয়ে আয় বিবরণী এবং সম্পত্তি, দায় ও মালিকানা স্বত্বের দফাগুলো নিয়ে আর্থিক অবস্থার বিবরণী তৈরি করা হয়। হিসাববিজ্ঞানের এই প্রক্রিয়াটি হলো আর্থিক বিবরণী প্রস্তুতকরণ। এভাবে হিসাব সংক্রান্ত কাজ চক্রাকারে চলতে থাকে। চলমান প্রতিষ্ঠান ধারণায় এটাই হিসাবচক্র। পরিশেষে বা যায় যে, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের লেনদেনগুলো সংঘটিত হওয়ার পর লিপিবদ্ধকরণ থেকে শুরু করে আর্থিক ফলাফল নির্ণয় পর্যন্ত যতগুলো ধাপ বা পর্যায় আবর্তিত হয় তাকে হিসাবচক্র বলে।

হিসাবচক্রের ধাপসমূহ:

(১) লেনদেনসমূহ চিহ্নিত ও পরিমাপকরণ; (২) জাবেদাভুক্তকরণ; (৩) খতিয়ানভুক্তকরণ; (৪) রেওয়ামিল প্রস্তুতকরণ; (৫) সমন্বয় ও ভুল সংশোধনী দাখিলা; (৬) সমন্বিত রেওয়ামিল; (৭) আর্থিক বিবরণী বা চূড়ান্ত হিসাব প্রস্তুতকরণ; (৮) নামিক হিসাবগুলোর সমাপনী দাখিলা; (৯) সমাপনীর রেওয়ামিল; (১০) বিপরীত দাখিলা। 
হিসাবচক্র

১. লেনদেনসমূহ চিহ্নিতকরণ ও পরিমাপকরণ (Identification & Measurement of Transactions): হিসাবচক্রের প্রথম কাজটি শুরু হয় লেনদেনসমূহ চিহ্নিত ও পরিমাপকরণের মাধ্যমে। যেকোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি দিনই ঘটনাবহুল। এসকল ঘটনার মধ্যে আর্থিক ঘটনাগুলোকেই লেনদেন হিসাবে চিহ্নিত করা হয় ও সে সকল লেনদেন নিয়েই পরবর্তী ধাপগুলোতে কাজ করা হয়। প্রামাণ্য দলিয় প্রস্তুত বা সংগ্রহ করে লেনদেন চিহ্নিত করা হয়। এসব প্রামাণ্য দলিলকে ব্যবসায়ের লেনদেনের প্রথম দলিল বলা হয়। এসব দলিলে সংশ্লিষ্ট লেনদেনের যাবতীয় তথ্যাদি থাকে এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর নাম অনুযায়ী দায়-দায়িত্ব স্পষ্ট করা থাকে। তাই এসব দলিল জাবেদা বা প্রাথমিক দাখিলার বইয়ে কোনো লেনদেন লিপিবদ্ধ করার ভিত্তি তৈরি করে, যা দ্বারা পরবর্তীতে প্রতিটি দাখিলার যাচাই করা যায়। এসব দলিলের ভিত্তিতে ভাউচার তৈরি করা হয়, যা পদস্থ কর্মকর্তা দ্বারা স্বাক্ষরিত হয়ে থাকে। লেনদেনের প্রামাণ্য দলিলগুলো নিম্নরূপ: 
i. বিক্রয় লেনদেনের প্রামাণ্য দলিল বিক্রয় চালান বা ক্যাশ রেজিস্ট্রার;

ii. ক্রয় লেনদেনের প্রামাণ্য দলিল— ক্রয় চালান;

iii. প্রাপ্য হিসাব ও প্রদেয় হিসাবের জেরের সমন্বয়ের দলিল ডেবিট ও ক্রেডিট মেমোরেন্ডাম বা স্মারকসমূহ; 

iv. নগদ অর্থ বিতরণের দলিল— চেক বইয়ের দ্বি-নকল বা (Duplicate Copy);

v. পরিচালনা পর্ষদের কার্য দ্বারা ক্ষমতা প্রদত্ত দাখিলাসমূহের দলিল (যেমন- লভ্যাংশ বিতরণ, অবচয় ধার্য, অশুদ্ধি' সংশোধন ইত্যাদি)।

vi. সমন্বয় বা সংশোধন দাখিলার দলিল—জাবেদা ভাউচার রা প্রমাণপত্র (Journal Voucher)।

২। জাবেদাভুক্তকরণ (Journalizing): লেনদেনসমূহ জাবেদাভুক্তকরণের মাধ্যমেই মূলত হিসাবচক্রের আনুষ্ঠানিক ধাপ শুরু হয়। লেনদেনসমূহ চিহ্নিতকরণের পর দুতরফা দাখিলা পদ্ধতি অনুযায়ী ডেবিট ও ক্রেডিট বিশ্লেষণ করে তারিখের ক্রমানুসারে একটি নির্দিষ্ট ছকে জাবেদা বইতে আওতাভুক্ত করা হয়, এটাই হলো হিসাবের প্রাথমিক বই।

৩. খতিয়ানভুক্তকরণ (Posting): এটি হিসাবচক্রের তৃতীয় ধাপ। জাবেদায় লেনদেনের হিসাব পক্ষের ডেবিট ও ক্রেডিটকে সংশ্লিষ্ট স্ব-স্ব হিসাব খাতের ডেবিট ও ক্রেডিট দিকে স্থানান্তর করা হয়। হিসাবসমূহ যে বইতে স্থায়ীভাবে রাখা হয় তাকে বলা হয় খতিয়ান। খতিয়ানে লেনদেনগুলোকে পৃথক পৃথক শিরোনামে শ্রেণিবিন্যাস করে লিপিবদ্ধ করা হয়।

৪. রেওয়ামিল প্রস্তুতকরণ (Preparation of Trial Balance): হিসাবচক্রের চতুর্থ ধাপে রেওয়ামিল প্রস্তুত করা হয়। হিসাব তথ্যসমূহকে আরও সংক্ষিপ্ত করা ও গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাই করার উদ্দেশ্যে হিসাবকাল শেষে ব্যয়বাচক, সম্পত্তিবাচক, আয়বাচক ও দায়বাচক হিসাব উদ্বৃত্তসমূহ নিয়ে যে তালিকা তৈরি করা হয় তা রেওয়ামিল। আয়, দায় ও মূলধন জাতীয় হিসাবসমূহের ক্রেডিট জের থাকে এবং সম্পত্তি ও ব্যয় জাতীয় হিসাবসমূহের ডেরিট উদ্বৃত্ত থাকে। এজন্য হিসাবের গাণিতিক শুদ্ধতা থাকলে রেওয়ামিলের ডেবিট ও ক্রেডিট পার্শ্বের যোগফল মিলে যায়।

৫. সমন্বয় ও ভুল সংশোধনী দাখিলা (Adjusting & Rectification of Errors Entries): এ পর্যায়ে হিসাবরক্ষণের বকেয়া ধারণা ও আয়-ব্যয় সংযোগ ধারণা প্রয়োগ দেখিয়ে সমন্বয় দাখিলা প্রস্তুত করা হয়। হিসাবের কোথাও ভুল থাকলে তাও সংশোধন করে নিতে হয়। এ সমস্ত সমন্বয় ও ভুল সংশোধনের জন্য জাবেদা দিতে হয়, যাকে বলা হয় সমন্বয় দাখিলা ও ভুল সংশোধন দাখিলা। সমন্বয় সাধারণত নিম্নরূপ হয়ে থাকে:
ক. বকেয়া ধারণা অনুসারে বকেয়া ব্যয় (যেমন- বকেয়া বেতন) ও বকেয়া আয় (যেমন- বিনিয়োগের অনাদায়ী সুদ) হিসাব বইতে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে হিসাবকালের মোট আয় ও ব্যয় নির্ণয় করা হয়।

খ. আয়-ব্যয় মিলকরণ ধারণা অনুসারে মুনাফা নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে আয়ের সাথে উক্ত আয় অর্জনের ব্যয় তুলনা করে ব্যয়গুলোকে (যেমন— অবচয়, অনাদায়ী পাওনা সঞ্চিতি ইত্যাদি) হিসাব বইতে সমন্বয় সাধন করা হয়।

৬. সমন্বিত রেওয়ামিল (Adjusted Trial Balance): হিসাবচক্রের ষষ্ঠ ধাপে সমন্বয় দাখিলা হতে সংশ্লিষ্ট হিসাবসমূহকে স্ব-স্ব হিসাবখাতে স্থানান্তর করে পুনরায় হিসাব খাতসমূহের সমন্বিত ও সংশোধিত জের নির্ণয় করা হয়। সমন্বিত জেরসমূহ নিয়ে পুনরায় যে রেওয়ামিল প্রস্তুত করা হয় তাকে সমন্বিত রেওয়ামিল বলে। 

৭. আর্থিক বিবরণী বা চূড়ান্ত হিসাব প্রস্তুতকরণ (Preparation of Financial Statement or Final Accounts): হিসাবচক্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে আর্থিক বিবরণী প্রস্তুতকরণ। এ পর্যায়ে এসে একটি প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করার জন্য কয়েকটি নির্দিষ্ট বিবরণীসমূহ প্রস্তুত করা হয়।

সমন্বিত রেওয়ামিলের আয় ও ব্যয় জাতীয় হিসাবসমূহ দ্বারা আয় বিবরণী তৈরি করা হয় যা হতে আর্থিক ফলাফল অর্থাৎ নিট লাভ-ক্ষতি জানা যায়। অপরদিকে সমন্বিত রেওয়ামিলের সম্পত্তি, দায় ও মূলধন জাতীয় হিসাবসমূহ দ্বারা আর্থিক বিবরণী তৈরি করা হয় যা হতে আর্থিক অবস্থা জানা যায়।

৮. নামিক হিসাবসমূহের সমাপনী দাখিলা (Closing Entries of Nominal Accounts): হিসাবচক্রের অষ্টম ধাপে আর্থিক বিবরণী প্রস্তুতের পর মুনাফা জাতীয় হিসাবসমূহ অর্থাৎ আয়-ব্যয়ের উদ্বৃত্তসমূহ বন্ধ করার জন্য যে জাবেদা দাখিলা প্রদান করা হয় তাকে সমাপনী দাখিলা বলে। যেহেতু আয়-ব্যয়বাচক অর্থাৎ নামিক হিসাবসমূহের দ্বারা নিট ফলাফল অর্থাৎ নিট লাভ-ক্ষতিকে মূলধন হিসাবে সমন্বয় করে দেখানো হয় তাই চলতি হিসাবকালে নামিক হিসাবসমূহকে পরবর্তী হিসাবকালে স্থানান্তর না করে চলতি হিসাবকালেই আয় বিবরণীর বিপরীতে বন্ধ করে দিতে হয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url