সমবায় সমিতি || Cooperative Society

সমবায় সমিতির ধারণা

অয়নের মতো তার গ্রামের সকল তাঁতিই তাদের তৈরি তাঁতের শাড়ি কম মূল্যে মহাজনদের কাছে বিক্রি করে দিতেন। এতে ন্যায্যমূল্য থেকে বর্ণিত হওয়া ছাড়াও পাওনা অর্থ সংগ্রহে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হতো। এক পর্যায়ে তারা একজোট হয়ে তাদের তৈরিকৃত শাড়ি সরাসরি বিভিন্ন এলাকায় শো- রুমের মাধ্যমে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি শুরু করেন। এতে তাঁতিরা ন্যায্যমূল্য পেয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করছেন। এ ঘটনায় সমবায় সমিতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

সমবায়ের শাব্দিক অর্থ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ও উদ্যোগে কাজ করা। মানবজীবনের প্রতিটি পর্যায়েই অন্যের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। এ কারণেই 'সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে', 'একতাই বল', 'প্রতিযোগিতা নয় সম্প্রীতি' প্রভৃতি নীতির ওপর ভিত্তি করে সমবায় সমিতির উৎপত্তি। সমবায়ের মাধ্যমে কিছু ব্যক্তি পরস্পরের সহযোগিতায় নিজেদের আর্থিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধান করে। এভাবে তারা সুন্দর ও সচ্ছল জীবনযাপন করতে পারে।

সমাজের শোষক শ্রেণির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিছু কম বিত্তসম্পন্ন, একই শ্রেণিভুক্ত এবং সমমনা ব্যক্তি সম- অধিকারের ভিত্তিতে স্বেচ্ছায় সমবায় সমিতি গঠন করেন। মুনাফা অর্জন সমিতির মূল উদ্দেশ্য নয়; সদস্যদের আর্থিক কল্যাণ সাধনই এর মূল লক্ষ্য। সদস্যগণের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা লাভ করার জন্য এটি একটি যৌথ প্রচেষ্টা । পারস্পরিক বিশ্বাস, সততা, মিতব্যয়িতা, সহযোগিতা প্রভৃতি আদর্শের ভিত্তিতে সমবায় সমিতি গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে সমবায় সমিতি ২০০১ সালের সমবায় আইন ও ২০০৪ সালের সমবায় বিধি অনুযায়ী গঠিত ও পরিচালিত হয়।

জে. কে. মিত্র (J. K. Mitra ) বলেন, 'A Cooperative society is a voluntary association of persons who join together to safeguard their own interests.' অর্থাৎ, 'সমবায় সমিতি হলো কিছু লোকের স্বেচ্ছামূলক সংগঠন, যারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় একত্র হন।'

হেনরি ক্যালডার্ট (Henry Calvert) বলেন, 'Cooperative is a form of organization where the persons voluntarily associate together as human being on a basis of equality for the promotion of economic interests of themselves.' অর্থাৎ, 'সমবায় সমিতি এমন একটি সংগঠন যেখানে কিছু লোক নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য স্বেচ্ছায় ও সমঅধিকারের ভিত্তিতে মিলিত হন।

উপরের আলোচনা ও সংজ্ঞাগুলো থেকে যে ধারণা পাওয়া যায় তা হলো-
১. সমবায় সমিতি কিছু লোকের স্বেচ্ছামূলক সংগঠন;
২. সমবায় সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য সদস্যদের অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধন।  
৩. সাধারণত নিম্ন আয়ের সমমনা ও সমশ্রেণির মানুষ এ সংগঠন গড়ে তোলেন;
৪. এটি সমবায় আইন অনুযায়ী গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়;
৫. সমবায় উপবিধি দ্বারা এর কাজের ক্ষমতার সীমা নির্ধারিত হয়।

অতএব, অর্থনৈতিক কল্যাণের লক্ষ্যে সমমনা ও সমশ্রেণিভুক্ত কিছু লোক সম-অধিকারের ভিত্তিতে মিলিত হয়ে দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় যে সংগঠন গড়ে তোলেন, তাকে সমবায় সমিতি বলে।
সমবায় সমিতি

সমবায় সমিতির ইতিহাস

প্রাচীন সমাজব্যবস্থা থেকে শুরু করে আধুনিক সমাজের প্রত্যেককে কোনো না কোনোভাবে একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বা একে অন্যকে সহযোগিতা করার মনোভাব থেকেই মূলত সমবায়ের উৎপত্তি। এর মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। নিচে সমবায়ের ইতিহাস বা ক্রমবিকাশের ধারা আলোচনা করা হলো-

প্রাচীন যুগ (Ancient period): অতি প্রাচীনকালে মানুষ যখন দলবদ্ধভাবে বনে-জঙ্গলে বসবাস করতো তখন থেকেই তাদের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব গড়ে ওঠে। তারা সে সময় একে অপরের সহযোগিতার মাধ্যমে হিংস্র জীবজন্তু, শত্রুপক্ষসহ প্রাকৃতিক বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করে টিকে থাকত। এভাবে সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং সভ্যতার বিকাশ হতে থাকে। আবার, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি হতে থাকায় সহযোগিতার ভিত্তিতে ধীরে ধীরে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যেরও প্রসার হতে থাকে।

মধ্য যুগ (Middle period): মূলত মধ্য যুগেই 'সমবায়' ধারণার আত্মপ্রকাশ হয়। ১৬৫৯ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকায় প্রথম সমবায় আন্দোলন শুরু হয়। সে সময় পি. সি. প্লক বয় (P. C. Plock Boy) কৃষক, শ্রমিক ও নাবিকদের নিয়ে একটি অর্থনৈতিক সংস্থা গঠনের উদ্যোগ নেন। এ সংস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল, সংস্থার উৎপাদিত পণ্যদ্রব্য সদস্যদের মধ্যেই কেনা-বেচা করা এবং এর মুনাফাও সদস্যদের মধ্যে বণ্টন করা। অনেক প্রচেষ্টার পরও তখন সমবায়ের এ উদ্দেশ্য সফল হয়নি। তবে এ ধারণার ওপর ভিত্তি করেই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সসহ আরও কয়েকটি দেশে এ আন্দোলন শুরু হয়। আর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে।

আধুনিক যুগ (Modern period): সমবায়ের এই সময়কে নিচের পর্যায়ে ভাগ করা যায়— 
১. শিল্পবিপ্লব যুগ (Industrial revolution period): আঠারো শতকের মাঝামাঝি (১৭৫০-১৮৫০) থেকে শুরু করে উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইংল্যান্ড তথা সমগ্র ইউরোপে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয়। কলকারখানা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন শুরু হয়। এর ফলে ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা এবং পুঁজিবাদ ও একচেটিয়া ব্যবসায়ের উদ্ভব হয়। এতে কৃষক ও ক্ষুদ্র শিল্পের মালিকগণ তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হতে থাকেন। এভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীগণ পুঁজিপতিদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ব্যর্থ হন। বিত্তবান শ্রেণির শোষণে শোষিত ও নিষ্পেষিত দরিদ্র শ্রেণির লোকজন তখন একত্র হতে থাকেন। 

একপর্যায়ে তারা সমবায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের চেষ্টা চালান। রবার্ট ওয়েন (১৭৭১-১৮৫৮) স্কটল্যান্ডের নিউ ল্যানার্ক এলাকার তুলা শ্রমিকদের দারিদ্র্য দূর করা ও ভাগ্য উন্নয়নে নিজেদের অন্ন- বস্ত্র নিজেদের উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করেন। এ লক্ষ্যে শ্রমিকদের নিয়ে তিনি 'সহযোগিতার গ্রাম' (Villages of Cooperation) গড়ে তোলেন। এজন্য রবার্ট ওয়েনকে (Robert Owon) সমবায় আন্দোলনের জনক বলা হয়। ১৮৪৪ সালের ২১ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের রচডেল (Rachdale) নামক স্থানে ২৮ জন তাঁত শ্রমিকের ২৮ পাউন্ড পুঁজি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় রচডেল সমিতি (Rochdale Equitable Pioneers Society)। 

একে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের সর্বপ্রথম সমবায় সমিতি মনে করা হয়। উক্ত তাঁতিরা এর মাধ্যমে ছোট্ট একটি দোকান চালু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য – মাখন, চিনি, ময়দা ও কিছু মোমবাতি সংগ্রহ করে ন্যায্যমূল্যে সদস্যদের কাছে সরবরাহ করতেন। তিন মাস পরে তারা চা ও তামাকসহ অন্যান্য পণ্য যোগ করা শুরু করেন। এতে একদিকে সদস্যগণ উপকৃত হতেন, অন্যদিকে অর্জিত মুনাফা সমিতির শক্তি ও সামর্থ্য বাড়াতে ব্যবহৃত হতো। তাদের এ সমিতির সুফল দেখে মাত্র ১০ বছরের মধ্যে ঐ এলাকায় প্রায় ১,০০০ সমিতি এই আদর্শে গড়ে ওঠে।

২. উপমহাদেশে সমবায় আন্দোলন (Cooperative movement of subcontinent): শিল্পবিপ্লবের গতিধারায় ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে আমাদের এ উপমহাদেশ কৃষি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮৪৪ সালে কৃষকদের কৃষি ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যে কৃষি ঋণ আইন' প্রবর্তন করে। কৃষকদের দেওয়া ঋণের কার্যকারিতা বাড়ানোর উপায় উদ্ভাবনের জন্য ব্রিটিশ সরকার উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ফ্রেডারিক নিকলসন বিট্স (Frederick Nicholson Betts)-কে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে। 

উক্ত কমিটি ১৮৯৫ সালে সমবায়ের পক্ষে রিপোর্ট পেশ করে। উক্ত রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী ১৯০৪ সালে এ উপমহাদেশে সর্বপ্রথম সমবায় সমিতি আইন (Cooperative Society Act) পাস করা হয়। এই আইন পাস করার পরই মূলত এ উপমহাদেশে সমবায় সমিতি আন্দোলন বেগবান হয়। ১৯১২ সালে কো-অপারেটিভ সোসাইটিজ অ্যাক্ট জারি করা হয়। ১৯৪০ সালে বেঙ্গল কো-অপারেটিভ সোসাইটিজ অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়। সমবায় নিয়মাবলি প্রণয়ন করা হয় ১৯৪২ সালে।

৩. বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলন (Cooperative movement of Bangladesh): ১৯৫৯ সালে বিখ্যাত সমাজসেবক ও সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা ড. আখতার হামিদ খানের প্রচেষ্টায় পল্লী উন্নয়ন একাডেমি স্থাপিত হয়, কুমিল্লায় কোটবাড়িতে। এ একাডেমির মূল উদ্দেশ্য ছিল সমবায় আন্দোলনকে গতিশীল করা। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠান 'বাংলাদেশ 'পল্লী উন্নয়ন একাডেমি' নামে পরিচিত। এ সময় তার উদ্ভাবিত দ্বি-স্তর ভিত্তিক সমবায় কাঠামো কুমিল্লা পদ্ধতি এর পরীক্ষামূলক যাত্রা শুরু হয়। 

এছাড়াও সেই সময়ের সরকার 'সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেয়, যা বর্তমানে 'বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড-এ রূপান্তরিত হয়েছে। এর প্রধান কাজ ছিল দরিদ্র জনগণকে প্রাথমিক সমবায় সমিতির মাধ্যমে সংগঠিত করা। এরপর উক্ত সমিতিকে সমবায় ফেডারেশনের অধীনে নিবন্ধন দেওয়া। এভাবে সমবায় আন্দোলন চলতে থাকে। তবে পাকিস্তানি শাসকদের ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এদেশে সমবায় আন্দোলন তেমন গতি লাভ করেনি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় সমবায় ব্যাংক কাজ শুরু করে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের দুগ্ধ চাহিদা পূরণের জন্য সমবায়ের ভিত্তিতে দুগ্ধ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনের লক্ষ্যে মিল্কভিটা প্রতিষ্ঠা করেন। 

এরপর থেকে দেশের সব সমবায় সমিতি ১৯৮৪ সালের সমবায় সমিতি অর্ডিন্যান্স ও ১৯৮৭ সালের সমবায় নিয়মাবলি দ্বারা গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। পরবর্তীতে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের সমবায় সমিতি গড়ে উঠেছে। যেমন: বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লি., মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি বাংলাদেশ লিমিটেড প্রভৃতি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে নিবন্ধিত মোট সমবায় সমিতির সংখ্যা ছিল ১,৭৫, ৩১০টি। এর মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে ২২টি, কেন্দ্রীয় ১,১৯১টি এবং প্রাথমিক সমবায় সমিতি ১,৭৫, ৩১০টি। 
বর্তমানে বাংলাদেশে সমবায় সমিতিগুলো সমবায় আইন ২০০১ (সংশোধিত ২০১৩) ও সমবায় সমিতি বিধিমালা-২০০৪ অনুযায়ী গঠিত ও পরিচালিত হচ্ছে। সমবায় কার্যক্রম স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি পৃথক সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে। দেশের প্রতিটি জেলা এমনকি উপজেলা পর্যায়ে এর অফিস আছে।

সমবায় সমিতির বৈশিষ্ট্য

সমবায় সমিতি হলো কিছু সমমনা ও সমশ্রেণিভুক্ত ব্যক্তির একটি স্বেচ্ছামূলক সংগঠন। এখানে তারা সমতার ভিত্তিতে মূলধন বিনিয়োগ করে ও সুযোগ-সুবিধা নেয়। আবার, গণতান্ত্রিক রীতিতে সমবায় সংগঠন পরিচালনা করা হয়। নিচে সমবায় সমিতির বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো-

১. লক্ষ্য (Goals): সদস্যদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার লক্ষ্যে সমবায় সমিতি গঠিত হয়। তাই মুনাফা অর্জন করাই এর প্রধান উদ্দেশ্য নয়। সদস্যদের সেবা, কল্যাণ সাধন ও বিবিধ সমস্যা সমাধান করাই এর মূল লক্ষ্য। এন. সি. রায় চৌধুরী (N. C. Roy Chowdhury) এর মতে, 'It is a gospel of self sufficiency. অর্থাৎ, 'স্বনির্ভরতা অর্জন ও সেবা করার জন্য অনন্য প্রতীক হচ্ছে সমবায় ।

২. গঠন (Formation) : সমবায় সমিতি গঠনের সময় দেশে প্রচলিত সমবায় আইনের বিধানসমূহ যথারীতি মেনে চলতে হয়। এটি গঠনের জন্য ন্যূনতম সংখ্যক সদস্য একত্রিত হতে হয়। এছাড়া উপবিধি তৈরি করে ফি দিয়ে নির্দিষ্ট ফরমে নিবন্ধকের কাছে আবেদন করতে হয়। এরপর কমপক্ষে ছয় মাসের পরীক্ষাকাল (Probation period) পার করতে হয়। সব আইনি আনুষ্ঠানিকতা পালন করে নিবন্ধকের সন্তুষ্টি অনুযায়ী এরূপ সংগঠনের নিবন্ধন সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশে সমবায় আইন ২০০১ (সংশোধিত-২০১৩) এবং সমবায় বিধিমালা ২০০৪ অনুসরণ করা হয়।

৩. সদস্য সংখ্যা (Number of members): বাংলাদেশে প্রচলিত ২০০১ সালের সমবায় সমিতি আইনের ৮(১ক) ধারা অনুযায়ী প্রাথমিক সমবায় সমিতি গঠনের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২০ জন ব্যক্তি সদস্য এবং কেন্দ্রীয় ও জাতীয় সমিতির ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১০ জন প্রাতিষ্ঠানিক সদস্য থাকতে হয়। তবে সমিতির সর্বোচ্চ সদস্য সংখ্যা কত হবে, তা আইনে বলা হয়নি। তাই ধরা যায়, এরূপ সংগঠনের সর্বোচ্চ সদস্য সংখ্যা হবে প্রতিষ্ঠানের শেয়ার সংখ্যা পরিমাণ । 

৪. সদস্যদের প্রকৃতি (Nature of members): যেকোনো সমমনা বা সমশ্রেণির ব্যক্তি সমবায় সমিতির সদস্য হতে পারেন। নতুন কেউ সমিতির সদস্য হতে চাইলে শেয়ার কেনার আবেদন করতে হয়। শেয়ার কেনার মাধ্যমে সদস্য হতে ইচ্ছুক ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ সমিতির সদস্য হতে পারেন।

৫. উপবিধি প্রণয়ন (Preparing the bylaws): সমবায় সমিতি গঠনের সময় উদ্যোক্তাদের উপবিধি তৈরি করতে হয়। এতে প্রস্তাবিত সমিতির নাম, ঠিকানা, উদ্দেশ্যাবলি, পরিচালনার নিয়ম-নীতি, সদস্যদের অধিকার, ক্ষমতা প্রভৃতি বিষয় লিপিবদ্ধ থাকে। সমিতি নিবন্ধনের সময় এর উপবিধির দুটি কপি নিবন্ধকের কাছে দাখিল করতে হয়। এরূপ উপবিধি প্রবর্তক বা প্রথম পরিচালকমণ্ডলীর দ্বারা স্বাক্ষরিত হতে হয়। 

৬. ব্যবস্থাপনা কমিটি (Managing committee): একটি নির্বাচিত পরিষদ বা কমিটির মাধ্যমে সমবায় সমিতি পরিচালিত হয়। এই কমিটির সকল সদস্য সাধারণ সদস্যদের মধ্য থেকেই তাদের ভোটে নির্বাচিত হন। ব্যবস্থাপনার সব দায়িত্ব কমপক্ষে ৬ জন ও সর্বোচ্চ ১২ জন সদস্যবিশিষ্ট কমিটির ওপর থাকে। প্রথম কমিটির মেয়াদ হয় ১ বছর। পরবর্তী সময়ে এর মেয়াদ ৩ বছরের জন্য হয়। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণ/ প্রণয়নের জন্য সাধারণ সভায় সদস্যদের অনুমতি নিতে হয়। 

৭. সদস্যদের দায় (Liability of members): সীমিত দায়সম্পন্ন সমবায় সমিতির সদস্যদের দায় তাদের কেনা শেয়ারের মূল্য দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে। অতিরিক্ত দায়ের জন্য এরূপ সদস্যদের দায়বদ্ধ করা যায় না। সীমিত দায়সম্পন্ন সমিতির নামের সাথে 'লিমিটেড' যুক্ত করা হয়। অসীম দায়সম্পন্ন সমিতির ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়।

৮. মূলধন সংগ্রহ (Collection of capital): সমবায় সমিতির মূলধন সদস্যরাই সরবরাহ করে থাকেন। সমবায় সমিতির উপবিধিতে মোট শেয়ারের পরিমাণ ও প্রতিটি শেয়ারের মূল্য উল্লেখ করা থাকে। সমবায় সমিতি এসব শেয়ার বিক্রি এবং সদস্যদের কাছ থেকে চাঁদার মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ করে থাকে।

৯. কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা (Artificial personal entity): সমবায় সমিতি একটি আইনসৃষ্ট সংগঠন। সমবায় আইন অনুযায়ী এটি নিবন্ধিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। এ কারণে এ সংগঠনের পৃথক ও স্বাধীন সত্তা বিরাজমান থাকে। নিজ নাম ও সিলমোহর ব্যবহার করে এরূপ সংগঠন পরিচালিত হয়ে থাকে।

১০. মুনাফা বণ্টন (Distribution of profit): বাংলাদেশে সমবায় আইন ২০০১ অনুযায়ী, সমবায় সমিতির অর্জিত মুনাফা সদস্যদের মধ্যে নিম্নোক্তভাবে সংরক্ষণ ও বণ্টন করা হয়- 
ক. সংরক্ষিত বা সঞ্চিতি তহবিলে ন্যূনতম ১৫%;
খ. সমবায় উন্নয়ন তহবিলের চাঁদা ৩% (যার ২% প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধ করার জন্য);
গ. উপবিধিতে উল্লেখ থাকলে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে সর্বোচ্চ আরও ১০% সংরক্ষণ;
ঘ. ঋণদানকারী বা অর্থায়নকারী সমবায়ের ক্ষেত্রে কুঋণ বা সন্দেহজনক ঋঋণ তহবিলে ১০% সংরক্ষণ; 
ঙ. অবশিষ্ট মুনাফা সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে লভ্যাংশ আকারে সদস্যদের মধ্যে বণ্টন করা যায়;

১১. তহবিলের ব্যবহার (Use of fund): সমবায় সমিতি বিধিমালা, ২০০৪ এর বিধি-৮২ অনুযায়ী সমবায় সমিতির সংরক্ষিত তহবিল নিম্নোক্তভাবে সমিতির ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করা যাবে—
ক. সমিতির নিজস্ব মূলধন ঋণকৃত মূলধনের চেয়ে কম হলে তহবিলের সর্বোচ্চ শতকরা ২৫ ভাগ; 
খ. সমিতির নিজস্ব মূলধন ঋণকৃত মূলধনের সমান বা বেশি হলে তহবিলের সর্বোচ্চ ৫০%;
গ. সমিতির ঋণকৃত মূলধন না থাকলে তহবিলের ১০০%।

১২. শেয়ার ক্রয় ও হস্তান্তর (Purchase and transfer of share): সমবায় সমিতির শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য হতে হবে ১০ টাকা। একজন সদস্য সমিতির শেয়ার মূলধনের সর্বাধিক ২০% বা ১/৫ ভাগ শেয়ার কিনতে পারেন। আর সমবায় সমিতির শেয়ার অবাধে হস্তান্তর করা যায় না। তবে সীমিত দায়সম্পন্ন সমবায়ের ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের অনুমতি নিয়ে সদস্যগণ শেয়ার হস্তান্তর করতে পারেন।

১৩. স্থায়িত্ব (Stability): সমবায় সমিতি আইনসৃষ্ট প্রতিষ্ঠান। এজন্য এটি অনেকটাই চিরন্তন অস্তিত্বের অধিকারী। সদস্যদের মৃত্যু, পাগল বা দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় এরূপ সংগঠন বিলুপ্ত হয় না। আইনের পাশাপাশি সদস্যদের ইচ্ছা, সততা, পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস প্রভৃতি সমবায়ের স্থায়িত্ব বাড়াতে সহায়তা করে ।

১৪. সমভোটাধিকার (Equal right of vote): সাম্যতা সমবায় সমিতির অন্যতম মূলমন্ত্র বা মূল ভিত্তি। সমিতিতে ভোটের ক্ষেত্রেও এর প্রয়োগ হয়। এতে প্রত্যেক সদস্য একটি মাত্র ভোট দিতে পারেন। কোনো সদস্য একাধিক শেয়ার কিনলেও তিনি একটি ভোট দিতে পারবেন।

১৫. সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও পৃষ্ঠপোষকতা (Government control and patronage): সমবায় আইনসৃষ্ট প্রতিষ্ঠান। তাই স্বভাবতই সমবায় অধিদপ্তরের মাধ্যমে সরকার এর নিয়ন্ত্রণ করে। সমবায়ের উন্নতির জন্যও সরকার বিভিন্ন সভা, অনুষ্ঠান, কমিটি গঠন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পরিচালনা, হিসাবপত্র রক্ষণ প্রভৃতি বিষয় তত্ত্বাবধান করে। তাছাড়া সরকার নিজ দায়িত্বে সমবায়ীদের প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন আর্থিক অনার্থিক সহযোগিতা করে থাকে।

তাই বলা যায়, সমবায় সমিতি আইনসৃষ্ট পৃথক সত্তাসম্পন্ন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত একটি স্বেচ্ছামূলক সংগঠন। সমাজের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণে এটি গঠিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। সদস্যদের আর্থ-সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করাই সমবায় সমিতির মূল লক্ষ্য।

সমবায় সমিতির উদ্দেশ্য

সাধারণত নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষ নিজেদের টিকিয়ে রাখা বা অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে সমবায় সমিতি গড়ে তোলেন। মুনাফা অর্জন করা এর মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। সদস্যদের আর্থিক সমস্যা দূর করে সচ্ছলতা নিয়ে আসা ও তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করাই সমবায় সমিতির মুখ্য উদ্দেশ্য। নিচে সমবায় সমিতির উদ্দেশ্যাবলি বর্ণনা করা হলো-

১. আর্থিক কল্যাণ (Economic welfare): মুনাফা অর্জন নয়, বরং সদস্যদের আর্থিক কল্যাণ করা সমবায় সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য। মূলত এ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্যই সমবায়ের উৎপত্তি। তাই সদস্যদের অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধনে সমিতির সব কাজ পরিচালিত হয়ে থাকে।

২. পুঁজি গঠন (Formation of capital): শিল্পের জন্য পুঁজি গঠন করা সমবায়ের একটি উদ্দেশ্য। পুঁজির অভাবে স্বল্প আয়ের মানুষ বড় কোনো উদ্যোগ নিতে পারেন না। তারা পুঁজিপতিদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েন। তাই সমবায় সমিতির মাধ্যমে তারা পুঁজির সংকট সমাধান করে থাকেন।

৩. সম্পদের সুষম বণ্টন (Equal distribution of wealth): সমবায়ের মাধ্যমে দরিদ্র জনগণের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা যায়। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে পুঁজিপতিদের কারণে সমাজে ধনবৈষম্য সৃষ্টি হয়। সমবায়ের মাধ্যমে এটি দূর করা যায়। এভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পদ সমভাবে বণ্টন করা হয়।

৪. সংগঠিত হওয়া (To be organized): সমবায়ের অর্থ হলো মিলন (To be united)। অর্থাৎ, কিছু লোক কোনো উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য মিলিত হওয়াই হলো সমবায়। এক্ষেত্রে স্বপ্নবিত্তের কিছু লোক নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে মিলিত হয়ে কাজ করেন। তাই সদস্যদের আর্থিক সচ্ছলতা আনা সমবায়ের অন্যতম উদ্দেশ্য ।

৫. কর্মোদ্যম সৃষ্টি করা (Motivation to work): সদস্যদের মধ্যে কাজের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা সমবায়ের উদ্দেশ্য। সদস্যগণ নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে মিলিত হলে তাদের মধ্যে কাজের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এতে তাদের মানসিক শক্তি বাড়ে। তারা সাহসী হয়ে ওঠেন। মূলত সহায়-সম্বলহীন মানুষকে একত্রিত করে তাদের জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সমবায় সমিতি সাহায্য করে থাকে।

৬. আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন (To achieve self dependency): সমবায় সমিতি সদস্যদের আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করে। সমবায়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ হয়। এ থেকে সদস্যগণ প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। পরবর্তীতে তারা নিজেরাই ব্যবসায় বা ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে আত্মনির্ভরশীল হতে পারেন।

৭. শোষণ থেকে রক্ষা (To save from exploitation): পুঁজিপতি ও মধ্যস্থব্যবসায়ীদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য সমবায় সমিতি গঠন করা হয়। এ উদ্দেশ্যে সদস্যগণ জোটবদ্ধ হয়ে পণ্য উৎপাদন করেন। এছাড়াও সরাসরি উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করে ন্যায্যমূল্যে সদস্যদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। তাই সমবায়কে নিম্নবিত্ত মানুষ বা শোষিতদের আত্মরক্ষার দুর্গ মনে করা হয়।

৮. সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলা (Creating saving mentality): সমিতির সদস্যদের বাধ্যতামূলকভাবে নিয়মিত অর্থ সঞ্চয় করতে হয়। তাদের এই সঞ্চিত অর্থই সমবায় সমিতিতে বিনিয়োগ করা হয়। এভাবে সমবায় সমিতিতে বিনিয়োগের তাগিদে সদস্যদের মধ্যে সখ্যয়ের অভ্যাস গড়ে ওঠে।

৯. কর্মসংস্থান সৃষ্টি (Creating employment): সমবায় সমিতি গড়ে তোলার আরেকটি উদ্দেশ্য হলো পর্যাপ্ত কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে বেকারত্ব দূর করা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমবায়ের মাধ্যমে নানা ধরনের প্রকল্প নিয়ে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। এর মাধ্যমে অনেক লোক আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ পান।

১০. সহযোগিতার উন্নয়ন (Developing cooperation): সদস্যদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো সমবায় সমিতির একটি উদ্দেশ্য। সমবায়ের মাধ্যমে সদস্যদের মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। তারা পরস্পর ঘনিষ্ঠ থাকে ও পারস্পরিক সাহায্যে এগিয়ে আসেন। এভাবে সবার মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব গড়ে ওঠে।

১১. নৈতিকতার উন্নয়ন (Development of morality): সমবায়ের মাধ্যমে সদস্যদের মধ্যে নৈতিকতার উন্নয়ন সাধন করা হয়। সদস্যদের সমিতির স্বার্থে সৌহার্দ্য, সাম্য, সংহতি, শৃঙ্খলাবোধ, শ্রদ্ধাবোধ, সুআচরণ প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এভাবে তারা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠেন।

১২. সামাজিক সমস্যা মোকাবিলা (Facing social problem): সমবায়ের মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার মোকাবিলা করা সহজেই সম্ভব হয়। সমবায়ের সকল সদস্য একই নীতিতে বিশ্বাসী। তারা একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। তাই বড় বড় সামাজিক সমস্যা; যেমন: মহামারী, বন্যা, খরা, পরিবেশের বিপর্যয়, ঘূর্ণিঝড়, স্বাস্থ্য ঝুঁকি প্রভৃতি অতি সহজেই মোকাবিলা করা যায়।

১৩. ন্যায্যমূল্যে পণ্যসামগ্রী সরবরাহ (Supply of goods at reasonable price): সাধারণত দরিদ্র জনগণ তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সমবায় সমিতি গঠন করেন। সমবায় সমিতির মাধ্যমে সদস্যদের মধ্যে স্বল্পমূল্যে বা ন্যায্য মূল্যে পণ্য সরবরাহ করা হয়। এর ফলে একচেটিয়া ব্যবসায়ের শোষণ থেকে তারা রক্ষা পেয়ে থাকেন।

১৪. কৃষিতে সহায়তা (Help in agriculture): কৃষিকাজে সমবায়ের মাধ্যমে সদস্যদের মধ্যে উন্নত বীজ, সার, যন্ত্রপাতি প্রভৃতি সহজ শর্তে সরবরাহ করা হয়। কৃষিজাত পণ্য বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রেও সমবায় সমিতি ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়াও সময়মতো সদস্যদের মধ্যে কৃষিঋণ সরবরাহ, কৃষিবিষয়ক উপদেশ দেওয়া, প্রশিক্ষণ দেওয়া, যৌথ খামার ব্যবস্থা গঠন প্রভৃতি ক্ষেত্রেও সমবায়ের ভূমিকা প্রশংসনীয়।

১৫. ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উন্নয়ন (Developing small and cottage industries): সমবায়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কুটির শিল্প গড়ে তোলা হয়। স্বল্প বিত্তসম্পন্ন জনসাধারণ সমবায়ের মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ করে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপন করে থাকেন। এর মাধ্যমে সদস্যদের বিভিন্ন শিল্প ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া, শিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ এবং পণ্য বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করা হয়।

১৬. জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন (Development of living standard): সমবায়ের মাধ্যমে সদস্যদের আর্থিক সচ্ছলতা আসে। ফলে তাদের মাথাপিছু আয় বাড়ে। এতে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। তারা ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে ও ভোগ করতে পারেন। আর এভাবে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপনের সুযোগ পান।

১৭. মানবসম্পদ উন্নয়ন (Development of human resource): মানবসম্পদ উন্নয়নের উপায় হলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতির উন্নয়ন করা। সমবায়ের মাধ্যমে এসব বিষয়ের উন্নয়ন করা হয়। সমিতির সদস্যদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা হয়, যেন তারা সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারেন। এভাবে দেশের জনগণ বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিণত হয়। তাই, মানবসম্পদ উন্নয়ন সমবায়ের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য।

তাই বলা যায়, সমবায় হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংগঠন। তাদের ভাগ্য উন্নয়নের প্রচেষ্টাই হলো যেকোনো সমবায় সমিতির মূল লক্ষ্য। উপরের উদ্দেশ্যাবলি অর্জনের মাধ্যমে স্বপ্নবিত্তের মানুষের কল্যাণ সাধন করা হয়।

সমবায় সমিতির প্রথম ব্যবস্থাপনা কমিটির মেয়াদ কত বছর?

একটি সমবায় সমিতির প্রথম ব্যবস্থাপনা কমিটির মেয়াদ সমবায় সমিতি কর্তৃক নির্ধারিত নিয়ম ও প্রবিধানের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে।  যাইহোক, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, প্রথম পরিচালনা কমিটিকে স্বল্প সময়ের জন্য নিযুক্ত করা হয়, যেমন 6 মাস থেকে 1 বছরের জন্য, একটি মসৃণ উত্তরণের অনুমতি দেওয়ার জন্য এবং নবগঠিত সমবায় সমিতি কার্যকরভাবে তার ক্রিয়াকলাপ এবং পদ্ধতিগুলি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম তা নিশ্চিত করতে।

 একবার প্রাথমিক মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে, সমবায় সমিতির সদস্যরা তাদের উপ-বিধি অনুসারে দীর্ঘ সময়ের জন্য, সাধারণত 2-5 বছরের জন্য একটি নতুন ব্যবস্থাপনা কমিটি নির্বাচন করতে পারে।  এটি লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যবস্থাপনা কমিটির সঠিক মেয়াদ নির্দিষ্ট সমবায় সমিতি এবং এর পরিচালনা আইনের উপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হতে পারে।

সমবায় অধিদপ্তর এর কাজ কি?

সমবায় অধিদপ্তর একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান যা সমবায় সংস্থাগুলির নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন করে। এই অধিদপ্তরের কাজ হলো সমবায় সংস্থাগুলির প্রতিষ্ঠান, সম্পাদন, পরিচালনা এবং উন্নয়ন সংক্রান্ত নীতি ও নির্দেশাবলী তৈরি ও প্রদত্ত করা। এছাড়াও, এই অধিদপ্তর সমবায় সংস্থাগুলির সমস্যার সমাধান ও তাদের সহায়তা করে যাতে সমবায় সংস্থাগুলি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে। এছাড়াও সমবায় সংস্থাগুলির লিটিগেশন প্রক্রিয়ায় এবং প্রয়োজনে আইনগত সহায়তা প্রদান করা হয়।

কেন্দ্রীয় ঋণ সমবায় সমিতি

একটি কেন্দ্রীয় ক্রেডিট কোঅপারেটিভ সোসাইটি (CCCS) হল এক ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান যা একটি সমবায় হিসাবে কাজ করে, তার সদস্যদের ঋণ ও আর্থিক পরিষেবা প্রদান করে। এটি সাধারণত কেন্দ্রীয় স্তরে সংগঠিত হয় এবং স্থানীয় ঋণ সমবায় সমিতিগুলির একটি ফেডারেশন হিসাবে কাজ করে। একটি CCCS এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল এর সদস্যদের সাশ্রয়ী এবং অ্যাক্সেসযোগ্য ঋণ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক মঙ্গলকে উন্নীত করা। এই সোসাইটিগুলি মালিকানাধীন এবং তাদের সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত হয়, যারা সাধারণত ব্যক্তি বা ছোট ব্যবসা। সদস্যরা তাদের আর্থিক সংস্থান সংগ্রহ করে এবং একটি সাধারণ তহবিলে অবদান রাখে, যা সদস্যদের চাহিদা মেটাতে ঋণ এবং অন্যান্য আর্থিক পরিষেবা প্রদানের জন্য ব্যবহৃত হয়। CCCSs সেভিংস অ্যাকাউন্ট, ফিক্সড ডিপোজিট, লোন, বীমা পণ্য এবং অন্যান্য সম্পর্কিত পরিষেবা সহ বিস্তৃত আর্থিক পরিষেবা অফার করে। তারা সাধারণত প্রথাগত ব্যাঙ্ক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় কম সুদের হারে সদস্যদের ঋণ প্রদানের দিকে মনোনিবেশ করে। সমবায় কাঠামো সদস্যদের স্কেল এবং যৌথ দর কষাকষির ক্ষমতার অর্থনীতি থেকে উপকৃত হতে দেয়, যা ঋণ এবং অন্যান্য আর্থিক পরিষেবার জন্য অনুকূল শর্তাবলী প্রদানে সহায়তা করে। একটি CCCS এর শাসন সাধারণত গণতান্ত্রিক, সদস্যদের ভোটাধিকার এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার ক্ষমতা থাকে। তারা একটি পরিচালনা পর্ষদ বা প্রতিনিধি নির্বাচন করে যারা সমাজের কার্যক্রম পরিচালনা এবং কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দায়ী। CCCSs আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রচারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে গ্রামীণ এবং সুবিধাবঞ্চিত এলাকায়, ব্যক্তি ও ব্যবসায় যাদের আনুষ্ঠানিক ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠানে সীমিত অ্যাক্সেস থাকতে পারে তাদের ক্রেডিট এবং আর্থিক পরিষেবার অ্যাক্সেস প্রদান করে। তারা তাদের সম্প্রদায়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখে সঞ্চয়ের সংস্কৃতি গড়ে তুলে, দায়িত্বশীল ঋণ গ্রহণের প্রচার করে এবং উদ্যোক্তা কার্যক্রমকে সমর্থন করে। এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে CCCS-এর নির্দিষ্ট বিধিবিধান এবং কাঠামো দেশগুলির মধ্যে পরিবর্তিত হতে পারে, কারণ সমবায় ব্যাঙ্কিং মডেলগুলি এখতিয়ার জুড়ে আলাদা হতে পারে। তাই, সেই নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে CCCS সম্পর্কে আরও সঠিক এবং আপ-টু-ডেট তথ্য পেতে একটি নির্দিষ্ট দেশের প্রাসঙ্গিক নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের দ্বারা নির্ধারিত প্রবিধান এবং নির্দেশিকাগুলি উল্লেখ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।




Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url