নেতৃত্ব || Leadership
নেতৃত্বের ধারণা
তাশফিন আহমেদ একজন উৎপাদন ব্যবস্থাপক। তার অধীনে ৫ জন সহকারী ব্যবস্থাপক, ১৫ জন সুপারভাইজার ও ৩০০ জন কর্মী নিয়োজিত আছেন। তিনি তাদের কাজের সুস্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেন। সময়মতো প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। সবার সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে খোঁজ-খবর নেন। সবার কাজকর্ম তদারকিও করেন। উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়ে তিনি সবাইকে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে সব সময় আন্তরিক রাখেন। ফলে, প্রতিষ্ঠানটি উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ঘটনায় তাশফিন আহমেদ তার প্রতিষ্ঠানে যে ধরনের ভূমিকা পালন করছেন, তা-ই নেতৃত্ব। অর্থাৎ, নেতৃত্ব হলো দলীয় সদস্য বা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত কর্মপ্রচেষ্টাকে কৌশলে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া।নেতৃত্ব শব্দের উৎপত্তি
ইংরেজি 'Leadership' শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে নেতৃত্ব। ইংরেজি 'Lead' থেকে 'Leadership' শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। ‘Lead' শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো পথ দেখানো (To guide), পরিচালনা করা (To conduct), প্ররোচিত করা (To persuade), প্রভাবিত করা (To influence) প্রভৃতি।দল বা গোষ্ঠীর আচরণ ও কাজকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টাকে নেতৃত্ব বলে। এ দায়িত্ব পালনকারীই হলেন নেতা। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক তার অধীনস্থ কর্মীদের কাজকে লক্ষ্য অর্জনের দিকে পরিচালনা করেন। এজন্য ব্যবস্থাপককেও ক্ষেত্রবিশেষে নেতা বলা যায়। এভাবে, যিনি পরিবার চালান তাকে পরিবারের নেতা বলা যায়। সুতরাং, নেতৃত্ব বলতে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য সদস্য বা কর্মীদের পরিচালনা করার কৌশলকে বোঝায়। এর মাধ্যমে সদস্যরা তাদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে লক্ষ্য অর্জনে নিয়োজিত হন। তাছাড়া এর দ্বারা সদস্যদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করা হয়।
■ যুক্তরাষ্ট্রের ভান্ডারবান্ট বিশ্ববিদ্যালয়-এর ব্যবস্থাপনার অধ্যাপক রিচার্ড এল. ডাফ্ট (Rechard L. Daft) বলেন, ''Leadership is the ability to influence people toward the attainment of organizational goal.' অর্থাৎ 'প্রতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনে লোকজনকে প্রভাবিত করার সামর্থ্যই হলো নেতৃত্ব।"
Investopedia.com, অনুযায়ী, ''প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য প্রতিষ্ঠা ও অর্জন, দ্রুত ও চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়া, প্রতিযোগীদের ছাড়িয়ে যাওয়া এবং অন্যদের সুন্দরভাবে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতাকে নেতৃত্ব বলে।"
searchio.techtarget.com, অনুযায়ী, ''নেতৃত্ব বলতে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ দ্বারা তাদের অনুসারী বা প্রতিষ্ঠানের অন্য সদস্যদের প্রভাবিত করা ও নির্দেশনাদানের যোগ্যতাকে বোঝায়।''
অতএব, দলের কর্মী বা সদস্যদের প্রভাবিত করে তাদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য কাজে লাগানোর কৌশলকে নেতৃত্ব বলে।
নেতৃত্বের গুরুত্ব
সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে অধীনস্থ বা অনুসারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনে নিয়োজিত হয়। ব্যবস্থাপক তথা নেতাকে ঘিরেই প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কাজ সম্পাদিত হয়। সঠিক নেতৃত্বের ওপরই নির্ভর করে প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য । এছাড়াও নেতৃত্ব নিম্নোক্ত কারণে গুরুত্বপূর্ণ-২. দলীয় প্রচেষ্টা জোরদারকরণ (Enhancing group effort): ব্যক্তি ও দলীয় প্রচেষ্টাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে পরিচালনা করাই নেতার মূল কাজ। এটি নির্ভর করে নেতার গুণ ও কাজের দক্ষতার ওপর। নেতৃত্বের মান দুর্বল হলে প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় ও দলবদ্ধ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। নেতার সঠিক নেতৃত্ব কৌশলের মাধ্যমেই সুশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাই, দলবদ্ধ প্রচেষ্টা জোরদারকরণে দক্ষ নেতৃত্ব অপরিহার্য।
৩. সহযোগিতা বৃদ্ধি (Increasing cooperation): কর্মীদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। কার্যকর নেতৃত্ব সংগঠনের অভ্যন্তরে সহযোগিতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। একে ঘিরেই জনশক্তি ঐক্যবদ্ধ হয় এবং পারস্পরিক সহযোগিতায় কাজ করে থাকে।
৪. ঐক্য সৃষ্টি (Creating unity): লক্ষ্য অর্জনে সবাই একমত হওয়াকে ঐক্য বলে। ব্যবস্থাপনার অন্যতম দায়িত্ব হলো প্রতিষ্ঠানের জনশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে পরিচালনা করা। ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া কখনও প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠানে কার্যকর নেতৃত্ব থাকলে নেতাকে ঘিরে কর্মীরা একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করে থাকে।
৫. সুষ্ঠু সমন্বয় (Proper coordination): একজন যোগ্য নেতা তার কর্মীদের প্রকৃতি, যোগ্যতা, চাহিদা প্রভৃতি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত থাকেন। ফলে কীভাবে, কাকে, কোন দায়িত্ব কতটুকু দিলে ভালো ফল পাওয়া যাবে, তা নেতা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারেন। তাই, নেতৃত্বের কৌশল ব্যবস্থাপনাকে যথাযথভাবে কর্তৃত্ব অর্পণে সহায়তা করে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানের কাজে সুষ্ঠু সমন্বয় সহজ হয়।
৬. দক্ষতা বৃদ্ধি (Increasing efficiency): সময়, অর্থ ও শ্রমের অপচয় না করে সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জন করার সামর্থ্যকে দক্ষতা বলে। যোগ্য নেতৃত্ব প্রাতিষ্ঠানিক সব কাজের দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করে। এটি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে জনশক্তির সব কর্মপ্রচেষ্টাকে ধাবিত করে বলে কাজে গতি বাড়ে।
৭. উৎসাহ সৃষ্টি (Creating inspiration): ব্যবস্থাপনার অন্যতম প্রধান কাজ হলো কর্মীদের দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে কাজ করিয়ে নেওয়া। যোগ্য নেতৃত্বের ফলে অধীনস্থ কর্মীরা কাজ করতে সব সময়ই উৎসাহবোধ করে। ফলে, তাদের মনোবলও বাড়ে। তাছাড়া, তাদের উচ্চ মনোবল উত্তম কাজের পরিবেশ সৃষ্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৬. পরিবর্তনে সহায়তা (Help to change): পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে মিল রেখে প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নেওয়া নেতার অন্যতম দায়িত্ব। এজন্য তাকে অনেক সময় পরিকল্পনা ও কাজের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হয়। তবে যেকোনো পরিবর্তন অধীনস্থরা সহজে মেনে নিতে পারে না। যোগ্য নেতৃত্ব সেক্ষেত্রে কর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সহজেই পরিবর্তন আনতে পারে।
নেতৃত্বের প্রকারভেদ বা ধরন
নেতৃত্বের ধরন বলতে নেতৃত্ব দেওয়ার বিভিন্ন উপায় বা পদ্ধতিকে বোঝায়। নেতার দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, অধীনস্থদের যোগ্যতা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও কাজের কৌশলে পার্থক্য থাকায় নেতৃত্বের ধরনেও পার্থক্য দেখা যায়। এগুলোর ভিত্তিতে নেতৃত্বকে নিম্নোক্ত ভাগে ভাগ করা যায়-১. স্বৈরতান্ত্রিক নেতৃত্ব (Autocratic leadership): যে নেতৃত্বে নেতা সব ক্ষমতা নিজের কাছে কেন্দ্রীভূত করে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেন, তাকে স্বৈরতান্ত্রিক নেতৃত্ব বলে। এক্ষেত্রে নেতা যা ভালো মনে করেন, তা-ই করে থাকেন। তিনি কাজের জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন না। এক্ষেত্রে, নেতা কর্মীদের ভয়-ভীতি দেখানো ও শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে কাজ আদায়ের চেষ্টা করেন। কর্মীরা এরূপ নেতৃত্বকে সন্তুষ্টচিত্তে নিতে পারেন না। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে এরূপ নেতৃত্ব সাময়িকভাবে কার্যকর প্রতীয়মান হলেও আধুনিক ব্যবস্থাপনায় এ ধরনের নেতৃত্বকে নিরুৎসাহিত করা হয়। Genghis Khan, Napoleon Bonaparte, Muammar Gaddafi, Idi Amin, Bashar al- Assad” প্রমুখ ব্যক্তি এরূপ নেতৃত্ব দানের জন্য ইতিহাসে আলোচিত হয়ে আছেন।
২. পিতৃসুলভ নেতৃত্ব (Paternalistic leadership): যে নেতৃত্বে নেতা কর্মীদের ওপর বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ হলেও পিতার মতো সদয় ও কল্যাণকামী হয়ে থাকেন, তাকে পিতৃসুলভ নেতৃত্ব বলে। এক্ষেত্রে নেতা কর্মীদের মনে শ্রদ্ধাবোধ জাগাতে চেষ্টা করেন। স্বৈরতান্ত্রিক নেতৃত্বের উন্নত ও ইতিবাচক সংস্করণই হলো পিতৃসুলভ নেতৃত্ব। এরূপ নেতৃত্বেও কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা নেতার হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। এক্ষেত্রে নেতা তার কাজের জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন না। শ্রমিক আন্দোলন নিরসনে এরূপ নেতৃত্ব বেশ ফলদায়ক। Henry Ford, Fidel Castro, Nelson Mandela প্রমুখ ব্যক্তি এরূপ নেতৃত্বদানের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন।
৩. গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব (Democratic leadership): যে নেতৃত্বে নেতা সব কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা নিজের কাছে কেন্দ্রীভূত না রেখে সদস্য বা কর্মীদের সাথে আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শ করে কাজ পরিচালনা করেন, তাকে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব বলে। গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব পরামর্শমূলক নির্দেশনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি মূলত স্বৈরতান্ত্রিক নেতৃত্বের বিপরীত। এ নেতৃত্বে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সদস্যদের সাথে আলাপ-আলোচনা করা হয়। তাই এরূপ নেতৃত্বের প্রতি কর্মীরা সন্তুষ্ট থাকেন এবং মনোবল বাড়ে। এতে কর্মীদের মনে স্বতঃস্ফূর্ততা বজায় থাকে। অধীনস্থ কর্মীরা অধিক দক্ষ ও যোগ্য হলে এরূপ নেতৃত্ব বেশি কার্যকর হয়ে থাকে। আধুনিক বিশ্বে এরূপ নেতৃত্ব অনেক তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয়। George Washington, Abraham Lincon, Jimmy Carter, Larry Page (Google), Muhtar Kent (Coca-Cola) প্রমুখ ব্যক্তি এরূপ নেতৃত্বদানের মাধ্যমে সফলতা বয়ে এনেছেন।
৪. মুক্ত বা লাগামহীন নেতৃত্ব (Free-rein or laissez faire leadership): লাগামহীন নেতৃত্বে নেতা কর্মীদের ওপর দায়িত্ব দিয়ে নিজে কর্মবিমুখ থাকেন। তিনি কর্মীদের প্রতি সুনির্দিষ্টভাবে আদেশ-নির্দেশ দেন না বা কাজে হস্তক্ষেপ করেন না। এক্ষেত্রে কর্মীরা নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করে থাকেন। এরূপ নেতৃত্বে নেতা শুধু লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়ে নিজে দাায়িত্ব এড়িয়ে চলেন। উক্ত লক্ষ্য বাস্তবায়নে তার প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা থাকে না। নেতার অবহেলা ও কর্মবিমুখতার কারণে এরূপ নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানে প্রায় সব সময়ই বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে। এছাড়া কর্মীরা অনেক সময় স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন। কর্মীরা কী কাজ করবেন, কীভাবে করবেন সে সিদ্ধান্ত নেতা নেন না, কর্মীরাই ঠিক করেন। নেতা তার অনুসারীদের দ্বারা নেওয়া সিদ্ধান্তের অনুমোদন দেন মাত্র। Herbert Hoover, Ronald Regan, Steve Jobs, Queen Victoria প্রমুখ ব্যক্তি এ ধরনের নেতৃত্বের উদাহরণ রেখে গেছেন।
খ. আনুষ্ঠানিকতাভিত্তিক নেতৃত্ব (Formality based leadership): একটি প্রতিষ্ঠানের সংগঠন কাঠামোতে নেতার অন্তর্ভুক্তির ভিত্তিতে অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকতার বিচারে নেতৃত্বকে নিম্নোক্ত ভাগে ভাগ করা যায়-
১. আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব (Formal leadership): প্রতিষ্ঠানের সংগঠন কাঠামোগত পদমর্যাদা থেকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে যে নেতৃত্ব দেওয়া হয়, তাকে আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব বলে। প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম অনুসারে এক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তার অধীনস্থ কর্মীর নেতা হিসেবে গণ্য হন। সাংগঠনিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বলেই এরূপ নেতা অধীনস্থদের পরিচালনা করেন এবং অধীনস্থরা ঊর্ধ্বতনকে মানতে বাধ্য থাকেন। কোম্পানির চেয়ারম্যান, কলেজের অধ্যক্ষ, ক্লাবের সেক্রেটারি, দলের প্রেসিডেন্ট, দেশের রাষ্ট্রপতি বা রাষ্ট্রনায়ক প্রমুখ ব্যক্তি তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে যে নেতৃত্ব প্রদান করেন, তা আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব বলে বিবেচিত হয়।
২. অনানুষ্ঠানিক নেতৃত্ব (Informal leadership): সাংগঠনিক কাঠামোর বাইরে নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম-নীতি অনুসরণ না করে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে যে নেতৃত্বের সৃষ্টি হয়, তাকে অনানুষ্ঠানিক নেতৃত্ব বলে। বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানে অনেক লোক একত্রে কাজ করে। এরূপ অনেক ক্ষেত্রে গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, জন্মস্থান, রাজনৈতিক মতাদর্শ, ইচ্ছা - অনিচ্ছা প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে এক ধরনের অনানুষ্ঠানিক নেতৃত্বের সৃষ্টি হয়।
এরূপ নেতৃত্বের কোনো বিধিবদ্ধ কর্তৃত্ব না থাকলেও কর্মীদের ওপর নেতাদের যথেষ্ট প্রভাব দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে, প্রতিষ্ঠানের একজন সৎ, ধার্মিক, বয়োজ্যেষ্ঠ, জ্ঞানী বা বুদ্ধিমান ব্যক্তির কাছ থেকে যেকোনো ঊর্ধ্বতন, অধস্তন বা সহকর্মী পরামর্শ নিয়ে থাকেন। আবার আত্মীয়তা বা পারিবারিক সম্পর্কের কারণেও কারও কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া বা আলাপ-আলোচনা করা হয়। এগুলো অনানুষ্ঠানিক নেতৃত্বের উদাহরণ।
গ. প্রেষণাভিত্তিক নেতৃত্ব (Motivation based leadership): নেতা নেতৃত্ব দেওয়ার সময় সদস্যদের মাঝে বিভিন্নভাবে উৎসাহ ও উদ্দীপনা তৈরি করে থাকেন। অধীনস্থরা এ উৎসাহের কারণে নেতার নেতৃত্ব অনুসরণে নিয়োজিত হন। এ উৎসাহ সৃষ্টির পদ্ধতির ভিত্তিতে নেতৃত্বকে নিম্নোক্তভাবে ভাগ করা যায়—
১. ইতিবাচক নেতৃত্ব (Positive leadership): নেতা যখন কর্মীদের উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টির মাধ্যমে নেতৃত্ব দেন, তাকে ইতিবাচক নেতৃত্ব বলে। এক্ষেত্রে কর্মীদের কাজের প্রশংসা করা হয় এবং স্বীকৃতিস্বরূপ তাদের আর্থিক বা অনার্থিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। এরূপ নেতৃত্ব অধীনস্থ কর্মীদের মাঝে সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব ফেলে ।
২. নেতিবাচক নেতৃত্ব (Negative leadership): এ ধরনের নেতৃত্ব ইতিবাচক নেতৃত্বের বিপরীত হয়ে থাকে। এতে নেতা তার অধীনস্থ কর্মীদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে অথবা শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে জোর করে কাজ করিয়ে থাকেন। এটি সাময়িকভাবে কার্যকর বলে মনে হলেও এর ফলে অনেক সময় কর্মীদের মনোবল ও কাজের প্রতি আগ্রহ কমে যায়। এর মাধ্যমে শ্রম ঘূর্ণায়মানতাও বাড়ে।
ঘ. দৃষ্টিভঙ্গিভিত্তিক নেতৃত্ব (Outlook based leadership): নেতা তার নেতৃত্ব দেওয়ার সময় কোন বিষয়কে প্রাধান্য বা গুরুত্ব দিচ্ছেন, তার ভিত্তিতে নেতৃত্বকে নিম্নোক্ত ভাগে ভাগ করা যায়-
১. কর্মকেন্দ্রিক নেতৃত্ব (Function oriented leadership): যে নেতৃত্বে নেতা কর্মীর চেয়ে কাজকে বেশি প্রাধান্য দেন, তাকে কর্মকেন্দ্রিক নেতৃত্ব বলে। এক্ষেত্রে নেতা মনে করেন, কাজ সম্পাদনই মূল বিষয়। এজন্য নেতা সব সময় কর্মীদের কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেন এবং সর্বোচ্চ মাত্রায় কাজ আদায়কেই সাফল্য মনে করেন। অর্থাৎ, কর্মীদের থেকে বেশি কাজ আদায়কেই নেতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।
২. কর্মীকেন্দ্রিক নেতৃত্ব (Employee oriented leadership): যে নেতৃত্বে নেতা কাজের পাশাপাশি কর্মীদের মানসিক দিকটি বিবেচনা করেন, তাকে কর্মীকেন্দ্রিক নেতৃত্ব বলে। এ নেতৃত্বে নেতা সহানুভূতির সাথে কর্মীদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন, এক্ষেত্রে কর্মীদেরকে সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা দিয়ে তাদের সন্তুষ্ট করে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। অর্থাৎ, এরূপ নেতৃত্বে কর্মীর কল্যাণের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।