অংশীদারি ব্যবসা || Partnership Business
অংশীদারি ব্যবসায়ের ধারণা
সারা, জাকিয়া ও ওয়াহিদা তিনজন ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। তারা একত্রে ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ে পড়াশোনা করছে। ব্যবসায়ের সুযোগ- সুবিধা সম্পর্কে তারা জানে। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসায় শুরু করার চিন্তা করে। তবে তাদের সময়ের স্বল্পতা, অর্থের সীমাবদ্ধতা ও একক দক্ষতার অভাবের কথা চিন্তায় আসে। এজন্য তিনজন সমঝোতার ভিত্তিতে তাদের কলেজের কাছে 'সাজাও গিফট শপ' নামে একটি দোকান চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুযায়ী প্রত্যেকে ২০ হাজার টাকা করে মূলধন আনে। দোকান ভাড়াসহ ডেকোরেশনের কাজও সম্পন্ন হয়। দোকান পরিচালনার জন্য তারা নিজেদের মধ্যে সময়ও ভাগ করে নেয়। তাদের ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিক প্রচেষ্টায় ব্যবসায়টি বেশ ভালোই চলছে। উক্ত ঘটনার মাধ্যমে একটি বিশেষ ধরনের ব্যবসায় সংগঠনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এখানে একাধিক ব্যক্তি চুক্তির ভিত্তিতে ব্যবসায় গড়ে তুলেছে। এটিই হলো অংশীদারি ব্যবসায়। অর্থাৎ, একাধিক ব্যক্তি নিজেদের পুঁজি ও সামর্থ্য একত্র করে চুক্তির ভিত্তিতে যে ব্যবসায় গড়ে তোলে, তাকে অংশীদারি ব্যবসায় বলে। ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইন অনুযায়ী এ ব্যবসায়ের সদস্য সংখ্যা সর্বনিম্ন ২ জন, ব্যাংকিং ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ জন এবং অন্য সব ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২০ জন হতে পারে।
■ ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইনের ৪ ধারায় বলা হয়েছে, 'Partnership is the relation between persons who have agreed to share the profit of a business carried on by all or any of them acting for all.', 'সকলের দ্বারা বা সকলের পক্ষে একজনের দ্বারা পরিচালিত ব্যবসায়ের মুনাফা নিজেদের মধ্যে বণ্টনের উদ্দেশ্যে চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যকার সম্পর্ককে অংশীদারি ব্যবসায় বলে।'
■ ১৮৯০ সালের ব্রিটিশ অংশীদারি আইনের ধারা (১) অনুযায়ী, 'Partnership is the relation which subsists between persons carrying on business in common with a view of profit.' অর্থাৎ, 'মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে একত্রিত ভাবে পরিচালিত ব্যবসায়ে লিপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সম্পর্ককে অংশীদারি ব্যবসায় বলে।'
উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে অংশীদারি ব্যবসায় সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায় তা হলো-
১. এ ব্যবসায় দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যকার চুক্তিবদ্ধ সম্পর্ক;
২. এ ব্যবসায় গঠন করে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মুনাফার লক্ষ্যে;
৩.অংশীদারদের মধ্যে চুক্তিবদ্ধ সম্পর্ক থাকতে হবে; অংশীদাররা একে অন্যের প্রতিনিধি;
৪. এতে অধিক পুঁজি ও দক্ষতার সমাবেশ হয়।
অতএব, ২ থেকে ২০ জন ব্যক্তি (ব্যাংকিং ব্যবসায়ে সর্বোচ্চ ১০ জন) চুক্তির ভিত্তিতে যে ব্যবসায় গড়ে তোলে, তাকে অংশীদারি ব্যবসায় বলে।
অংশীদারি ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য
একমালিকানা ব্যবসায়ের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্য অংশীদারি ব্যবসায়ের উদ্ভব হয়েছে। এমন কিছু বৈশিষ্ট্য অংশীদারি ব্যবসায়ে বিদ্যমান, যা এরূপ ব্যবসায়কে অন্যান্য ব্যবসায় থেকে পৃথক করেছে। যেমন-
১. সদস্য সংখ্যা ও যোগ্যতা (Number of members and capabilities): অংশীদারি ব্যবসায়ে কমপক্ষে ২ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয়। সাধারণ অংশীদারির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২০ জন এবং ব্যাংকিং ব্যবসায়ে সর্বোচ্চ সদস্য ১০ জন।
২. চুক্তিবদ্য সম্পর্ক (Contractual relation): চুক্তিবদ্ধ সম্পর্কের আলোকেই অংশীদারি ব্যবসায় গঠন করা হয়। চুক্তি অনুযায়ীই ব্যবসায় পরিচালনা করা হয়। আইনে বলা হয়েছে, 'অংশীদারি সম্পর্ক চুক্তি থেকে উদ্ভূত, কোনো পদমর্যাদা থেকে নয়।' এ চুক্তি হতে পারে মৌখিক, লিখিত বা লিখিত ও নিবন্ধিত। তবে, ব্যবসায়ে কোনো অংশীদারের দায় সীমিত থাকলে উক্ত ব্যবসায়কে অবশ্যই নিবন্ধন করতে হবে।
৩. অসীম দায় (Unlimited liability): একমালিকানা ব্যবসায়ের মতো অংশীদারি ব্যবসায়ের সব অংশীদারের দায় অসীম। অর্থাৎ, ব্যবসায়িক দায়ের জন্য অংশীদারদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিও দায়বদ্ধ হতে পারে। আইন অনুযায়ী তারা ব্যক্তিগতভাবে ও যৌথভাবে ব্যবসায়িক সব দায়-দেনার জন্য দায়ী থাকবেন। দায় পরিশোধে কেউ অক্ষম বা দেউলিয়া হলে, অন্য সদস্যদের ওপর তা বর্তায়।
৪. আস্থা ও বিশ্বাস ( Trust and faith): পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের মাধ্যমে এ ব্যবসায় গঠিত ও পরিচালিত হয়। ব্যবসায়ের স্থায়িত্ব ও সফলতার জন্য এরূপ আস্থা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অংশীদারদের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব দেখা দিলে ব্যবসায়ের সাফল্যের পরিবর্তে বিলুপ্তির সম্ভাবনা দেখা দেয়।
৫. মূলধন সরবরাহ (Supply of capital): অংশীদারি ব্যবসায়ে সমান পরিমাণে বা চুক্তি অনুযায়ী অংশীদাররা মূলধন সরবরাহ করেন। তবে অংশীদারদের সম্মতিক্রমে কোনো ব্যক্তি মূলধন হিসেবে অর্থ সরবরাহ না করেও এ ব্যবসায়ের অংশীদার হতে পারেন। এক্ষেত্রে তিনি সুনাম, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা প্রভৃতি মূলধন হিসেবে বিনিয়োগ করেন।
৬. লাভ-লোকসান বণ্টন (Distribution of profit and loss): ব্যবসায়ের লাভ-লোকসান চুক্তি অনুযায়ী অংশীদারদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। চুক্তিতে এ ব্যাপারে কিছু উল্লেখ না থাকলে অংশীদাররা তা সমানভাবে পান।
৭. গঠন ও পরিচালনা (Formation and operating): আইনসম্মতভাবে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি স্বেচ্ছায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে এ ব্যবসায় গঠন করতে পারেন। সিটি কর্পোরেশন বা পৌর এলাকায় ব্যবসায় পরিচালনার জন্য সরকারি নিয়মানুসারে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হয়। এ ব্যবসায় সব অংশীদার বা সবার পক্ষে একজন ব্যবসায় পরিচালনা করতে পারে [৪ (ধারা)]। সীমিত দায়সম্পন্ন অংশীদার ব্যবসায় পরিচালনায় অংশ নিতে পারে না।
৮. আইনগত সত্তার অনুপস্থিতি (Absence of legal entity): অংশীদারি ব্যবসায় নিবন্ধিত হোক বা না হোক, তাতে এর কোনো আইনগত সত্তার সৃষ্টি হয় না। ফলে, ব্যবসায় নিজস্ব নামে পরিচিত ও পরিচালিত হতে পারে না। এটি অংশীদারদের নামেই পরিচিত ও পরিচালিত হয়। আইনগত সত্তার অভাবে এরূপ ব্যবসায়ের নামে মামলা করা যায় না এবং স্থায়িত্ব অনিশ্চিত হয়।
৯. প্রতিনিধিত্বের সুযোগ (Opportunity of represent): এরূপ ব্যবসায়ে প্রত্যেক অংশীদার একে অপরের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য হন। ফলে যেকোনো অংশীদার অন্য অংশীদারের পক্ষে কাজ পরিচালনা করতে পারেন। এতে ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাধাহীনভাবে চলতে পারে। প্রত্যেকের কৃতকার্যের জন্য অপর অংশীদার দায়বদ্ধ হন।
১০. বিলোপসাধন (Dissolution): অংশীদারি ব্যবসায়ের পৃথক আইনগত সত্তা না থাকায় এর বিলোপসাধন বা স্থায়িত্বের বিষয়টি অংশীদারদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। তাছাড়া, কোনো অংশীদারের মৃত্যু, স্থায়ী অক্ষমতা প্রভৃতি কারণেও এরূপ ব্যবসায়ের বিলোপসাধন হয়ে থাকে।
সুতরাং বলা যায়, অংশীদারি ব্যবসায় হলো চুক্তির ভিত্তিতে গঠিত কিছু লোকের সংগঠন। উপরের বৈশিষ্ট্যের কারণে এ ব্যবসায়কে অন্যান্য ব্যবসায় সংগঠন থেকে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র বলে বিবেচনা করা হয়।
অংশীদারি ব্যবসায়ের গঠন প্রণালি
অংশীদারি ব্যবসায় গঠন করা অনেক সহজ। এরূপ ব্যবসায় গঠন করতে তেমন কোনো আইনগত আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয় না। বাংলাদেশে বহাল ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইনের আলোকে এ ব্যবসায় গঠন করা হয়। নিচে অংশীদারি ব্যবসায়ের গঠন প্রণালি চিত্রের সাহায্যে বর্ণনা করা হলো -
চিত্র: অংশীদারি ব্যবসায়ের গঠন প্রণালি
১. সদস্য সংগ্রহ (Collecting the members): দুই বা ততোধিক প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্কের ব্যক্তি একত্রে অংশীদারি ব্যবসায় গঠন করতে পারেন। অর্থাৎ, এতে স্বর্বনিম্ন ২ জন এবং সর্বোচ্চ ২০ জন সদস্য থাকতে পারেন। তবে ব্যাংকিং অংশীদারি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সদস্য ১০ জন হতে পারে। তাই, অংশীদারি ব্যবসায় গঠনের শুরুতে ২ থেকে ২০ জন (ব্যাংকিং-এর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ জন) ব্যক্তিকে স্বেচ্ছায় একত্র হতে হয়।
২. চুক্তিবদ্ধ সম্পর্ক সৃষ্টি বা চুক্তি সম্পাদন (Preparing contract): চুক্তি অংশীদারি ব্যবসায়ের মূল ভিত্তি। তাই, ভবিষ্যতে বিবাদ এড়াতে কে কতটুকু মূলধন সরবরাহ করবে, লাভ-লোকসান কী হারে বণ্টন করা হবে, যার যা দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকবে তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করে চুক্তি সম্পাদন করতে হয়। এ চুক্তি লিখিত, মৌখিক বা লিখিত ও নিবন্ধিত যেকোনো রকম হতে পারে। তবে চুক্তি লিখিত হওয়াই ভালো। চুক্তিপত্র এমনভাবে তৈরি করা উচিত যাতে এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সব পরিস্থিতি ও সমস্যার মোকাবিলা করা যায়।
৩. নিবন্ধন ( Registration): বাংলাদেশে বহাল ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইনে এরূপ ব্যবসায়ের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়নি। তবে, নিবন্ধিত ব্যবসায় অনিবন্ধিত ব্যবসায়ের চেয়ে কিছু বেশি সুবিধা পেয়ে থাকে। নিবন্ধনের জন্য আবেদন ফরম সংগ্রহ করে তা পূরণ করার পর নির্দিষ্ট ফিসহ নিবন্ধকের কাছে জমা দিতে হয়। নিবন্ধক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সন্তুষ্ট হলে উক্ত ব্যবসায়ের নিবন্ধন দেয়।
৪. অনুমতিপত্র সংগ্রহ (Collecting the trade licence): ইউনিয়ন পর্যায়ে হলে চুক্তি সম্পাদনের পরই অংশীদারি ব্যবসায়ের কার্যক্রম শুরু করা যায়। এক্ষেত্রে, তেমন কোনো আইনি আনুষ্ঠানিকতা পালনের প্রয়োজন হয় না। পৌরসভা থেকে ট্রেড লাইসেন্স বা অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হয়।
৫. ব্যবসায়িক কার্যক্রম আরম্ভ (Commencing the business activities): নিবন্ধিত ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে পৌর কর্তৃপক্ষ থেকে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করা হয়। এরপর অংশীদাররা তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করতে পারেন । এক্ষেত্রে, চুক্তিপত্রই ব্যবসায়ের মূল সংবিধান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। কোনো বিষয় সম্পর্কে চুক্তিতে সুস্পষ্ট কিছু উল্লেখ না থাকলে পারস্পরিক সমঝোতায় সমস্যার সমাধান করা হয়।
তাই বলা যায়, অংশীদারি ব্যবসায় হলো সহজ প্রকৃতির সংগঠন। বিশেষ কোনো আইনি আনুষ্ঠানিকতা পালন ছাড়াই এটি গঠন করা যায়। এক্ষেত্রে, উল্লিখিত পদক্ষেপ অনুসরণ বা কাজ সম্পাদন করা হয়ে থাকে। তবে, সদস্য সংগ্রহ ও চুক্তি সম্পাদনের পরবর্তী পদক্ষেপগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরি নয়।
অংশীদারি ব্যবসায়ের সুবিধা
অংশীদারি ব্যবসায় সাধারণত ছোট বা মাঝারি আয়তনের হয়ে থাকে। এতে অংশীদারদের পারস্পরিক সহযোগিতা, সমঝোতা এবং চিন্তাধারার সমাবেশ হয়ে থাকে। তাই, একমালিকানা ব্যবসায়ের তুলনায় এতে বাড়তি কিছু সুবিধা দেখা যায়। নিচে এরূপ ব্যবসায়ের সুবিধাগুলো আলোচনা করা হলো-
১. সহজ গঠন (Easy formation): অংশীদারি ব্যবসায় গঠন করা অনেক সহজ। এতে কোনো আইনগত আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয় না। ২ থেকে ২০ জন (ব্যাংকিং-এর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ জন) ব্যক্তি যেকোনো সময় মৌখিক বা লিখিতভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এ ব্যবসায় গঠন করতে পারে।
২. অধিক মূলধন (Large capital): একাধিক অংশীদার মূলধন সরবরাহ করায় এরূপ ব্যবসায়ে বেশি মূলধন সংগ্রহ করা যায়। প্রয়োজনে নতুন অংশীদার নিয়েও মূলধনের পরিমাণ বাড়ানো যায়। এছাড়া অতিরিক্ত মূলধনের যোগান দিতে পরিচিত লোকজনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া যেতে পারে।
৩. দক্ষ পরিচালনা (Efficient administration): অংশীদারি ব্যবসায় ব্যক্তি সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা দূর করে থাকে। সবার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে দলগতভাবে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতেই অংশীদারি ব্যবসায়ের উৎপত্তি । সাধারণত, অংশীদারদের যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফলে, দক্ষতার সাথে ব্যবসায় পরিচালনা করা যায়।
৪. গণতন্ত্রের অনুশীলন (Practice of democracy): অংশীদারি ব্যবসায়ে সব সদস্যের স্বার্থ এক ও অভিন্ন হয়ে থাকে। এজন্য, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও সব অংশীদারের মত প্রকাশের সুযোগ থাকে। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ দলগতভাবে হয়ে থাকে।
৫. দলবদ্ধ প্রচেষ্টা (Group effort): এ ব্যবসায়ে একজন ব্যক্তির আবেগ ও সীমাবদ্ধতা দূর করে সকলে মিলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অংশীদারদের সম্মিলিত চেষ্টায় উক্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করাও সহজ হয়ে থাকে।
৬. ঝুঁকি বণ্টন (Distributing risk): অংশীদাররা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ব্যবসায়ের যেকোনো ক্ষতি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। ফলে, একক ঝুঁকির মাত্রা কমে যায়। এছাড়া, এ ব্যবসায়ে দায় অসীম হওয়ায় তারা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ব্যবসায় পরিচালনার চেষ্টা করে।
৭. পরিচালনাগত স্বাধীনতা (Freedom in operation): সমবায় ও যৌথ মূলধনী ব্যবসায়ের মতো অংশীদারি ব্যবসায়ের হিসাব প্রতিবেদন আকারে বাধ্যতামূলকভাবে দাখিল করতে হয় না। পরিচালনার ব্যাপারে সরকারের সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলার বাধ্যবাধকতাও নেই। ফলে অংশীদাররা স্বাধীনভাবে ব্যবসায় পরিচালনা করতে পারে।
৮. জনসংযোগের সুযোগ ( Scope of public relations): এরূপ ব্যবসায়ে একাধিক মালিক থাকায় অধিক সংখ্যক লোকজনের সাথে যোগাযোগ রাখা যায়। এতে সহজেই পরিচিতি অর্জন, ক্রেতা সন্তুষ্টি অর্জন ও ব্যবসায়ের সুনাম বাড়ে। ফলে সাফল্য অর্জনও সহজ হয়।
৯. নমনীয়তার সুযোগ (Scope of flexibility): সীমিত সংখ্যক অংশীদার, পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও প্রত্যক্ষ যোগাযোগের ফলে অংশীদারি ব্যবসায়ে সহজেই যেকোনো পরিবর্তন আনা যায়। এতে যেকোনো ব্যবসায়িক সুযোগ কাজে লাগানো সম্ভব হয় ।
উপসংহারে বলা যায়, একমালিকানা ব্যবসায়ের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে অংশীদারি ব্যবসায়ের উদ্ভব হয়। আবার, সুবিধাগুলো থাকায় অংশীদারি ব্যবসায়ের প্রচলন ও বিস্তার বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
অংশীদারি ব্যবসায়ের সীমাবদ্ধতা
অংশীদারি ব্যবসায়ের মাধ্যমে বিভিন্ন সুবিধা লাভ করা যায়। তবে, এতে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও দেখা যায়। এ কারণে বর্তমানে এরূপ ব্যবসায় সব ক্ষেত্রে সফল ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। নিচে এরূপ ব্যবসায়ের সীমাবদ্ধতাগুলো আলোচনা করা হলো—
১. অসীম দায় (Unlimited liability): অংশীদারি ব্যবসায়ের প্রধান অসুবিধা হলো এর সদস্যদের দায়ের কোনো সীমা নেই। প্রত্যেক অংশীদার ব্যবসায়ের সব দেনার জন্য আলাদাভাবে দায়ী থাকেন। কোনো অংশীদার দেনা পরিশোধে অক্ষম হলে অন্য অংশীদাররা তার দেনা পরিশোধে বাধ্য থাকেন।
২. সীমিত সদস্য (Limited member): এ ব্যবসায়ের সদস্য সংখ্যা বেশি থাকায় অনেক সময় যোগ্য ও অভিজ্ঞ সদস্য নতুন করে নেওয়ার সুযোগ থাকে না। এজন্য, ব্যবসায় সম্প্রসারণের সুযোগ থাকলেও সদস্য সংখ্যা বাড়াতে না পারায় সে সুযোগ কাজে লাগানো যায় না।
৩. স্বল্প মূলধন (Limited capital): অংশীদারি ব্যবসায়ের সদস্য সংখ্যা সীমিত থাকে বলে তাদের আর্থিক সামর্থ্যও কম হয়ে থাকে। এজন্য, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণ মূলধন সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। তাই, কোম্পানির তুলনায় এতে মূলধনের পরিমাণও কম হয়ে থাকে। এতে বৃহদায়তন ব্যবসায়ের সুবিধা পাওয়া যায় না ।
৪. অদক্ষ ব্যবস্থাপনা (Inefficient management): সব অংশীদারের পরিচালনায় অংশগ্রহণের অধিকার থাকায় অদক্ষ এবং অযোগ্য লোক ব্যবসায় পরিচালনার সুযোগ পায়। ফলে, পরিচালনায় অদক্ষতা আরও বাড়ে।
৫. বিশ্বাস ও আস্থার ও অভাব (Lack of trust and faith): পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস অংশীদারি ব্যবসায়ের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পারস্পরিক বিশ্বাসের উপরই সাধারণত এরূপ ব্যবসা গড়ে ওঠে। কিন্তু, বিভিন্ন কারণে তাদের এই বিশ্বাস ও আস্থার পরিবর্তন হতে পারে। ফলে, ব্যবসায় পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়ে।
৬. গোপনীয়তা প্রকাশ (Disclose of secrecy): অনেক সময় অংশীদার নিজ স্বার্থে বা অসতর্কতাবশত ব্যবসায়ের গোপন বিষয় প্রকাশ করে দেয়। এতে, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়াসহ বিভিন্ন ক্ষতির আশঙ্কা বেড়ে যায়।
৭. দায়িত্ব এড়ানোর প্রবণতা (Tendency to avoid responsibility): এরূপ ব্যবসায়ে সব অংশীদারের ওপর পরিচালনার দায়িত্ব থাকে। যৌথ দায়িত্বের কারণে কখনো কখনো দায়িত্ব পালনে অনীহা দেখা দেয়। এছাড়া, অন্যের ওপর দায় চাপানোর প্রবণতাও এরূপ ব্যবসায়ে দেখা যায়। এতে, ঝুঁকিবহুল কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
৮. সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব (Delay in decision making): সব অংশীদারের মত অনুযায়ী অংশীদারি ব্যবসায় পরিচালনা করতে হয়। এজন্য, এরূপ ব্যবসায়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হয়। এতে, গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হলে তা সম্ভব হয় না।
৯. পৃথক সত্তার অভাব (Lack of seperate entity): এ ব্যবসায় আইনসৃষ্ট নয় বলে এর পৃথক কোনো সত্তা নেই। ব্যবসায়টি নিজ নামে কোনো লেনদেন ও চুক্তি সম্পাদন করতে পারে না। এক্ষেত্রে, অংশীদারদের নামে লেনদেন ও চুক্তি সম্পাদন করতে হয়। ফলে, ব্যবসায়ের প্রতি ক্রেতাদের আস্থা সৃষ্টি হয় না।
১০. মালিকানা হস্তান্তরে বাধা (Obstacles in transfer of ownership): অংশীদারি ব্যবসায়ের মালিকানা অবাধে হস্তান্তরযোগ্য নয়। সব অংশীদারের সম্মতি ছাড়া কোনো অংশীদার তার মালিকানা অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করতে পারে না। এতে অংশীদারিত্ব হারানোর সম্ভাবনা দেখা দেয়।
তাই বলা যায়, অংশীদারি ব্যবসায়ে সঠিক পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের অভাব হলে এতে উল্লিখিত সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে। এজন্য এরূপ ব্যবসায় গঠন, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে অংশীদারদের বেশ সচেতন হতে হয়।
অংশীদারি ব্যবসায়ের হিসাব
অংশীদারি ব্যবসার অ্যাকাউন্ট হল আর্থিক বিবৃতি যা একটি অংশীদারি ব্যবসার আর্থিক কার্যকলাপ এবং অবস্থান রেকর্ড করে। এই অ্যাকাউন্টগুলিতে বেশ কয়েকটি মূল উপাদান রয়েছে, যেমন:
১. মূলধন অ্যাকাউন্ট: এই অ্যাকাউন্টটি প্রতিটি অংশীদারের করা প্রাথমিক বিনিয়োগ এবং বছরে যে কোনও অতিরিক্ত অবদান বা তোলার ট্র্যাক করে।
২. আয় বিবরণী: আয় বিবরণী বছরে ব্যয়ের সাথে অংশীদারিত্ব দ্বারা অর্জিত রাজস্ব দেখায়। ফলে নিট আয় বা ক্ষতি অংশীদারিত্ব চুক্তির শর্তাবলীর উপর ভিত্তি করে অংশীদারদের জন্য বরাদ্দ করা হয়।
৩. ব্যালেন্স শীট: ব্যালেন্স শীট বছরের শেষে অংশীদারিত্বের সম্পদ, দায় এবং ইক্যুইটি সংক্ষিপ্ত করে। এই বিবৃতি অংশীদারিত্বের সম্পদের মূল্য দেখায়, যেমন সম্পত্তি, জায়, এবং বিনিয়োগ, সেইসাথে এর দায়, যেমন ঋণ এবং প্রদেয় অ্যাকাউন্ট।
৪. নগদ প্রবাহ বিবৃতি: এই বিবৃতি বছরে অংশীদারিত্বের জন্য নগদ প্রবাহ এবং বহিঃপ্রবাহ দেখায়। এটি নগদ উৎস যেমন বিক্রয় এবং ঋণ, এবং নগদ ব্যবহার, যেমন জায় ক্রয় এবং বেতন প্রদানের মত ট্র্যাক করে।
৫. ট্যাক্স রিটার্ন: অংশীদারি ব্যবসায় প্রতি বছর ট্যাক্স রিটার্ন ফাইল করতে হবে, যা অংশীদারিত্বের আয়, কর্তন এবং ট্যাক্স দায় রিপোর্ট করে।
সামগ্রিকভাবে, অংশীদারিত্ব ব্যবসার অ্যাকাউন্টগুলি অংশীদারিত্বের আর্থিক কর্মক্ষমতা ট্র্যাক করার জন্য এবং অ্যাকাউন্টিং এবং ট্যাক্স প্রবিধানগুলির সাথে সম্মতি নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য।
অংশীদারি ব্যবসায় চুক্তি
একটি অংশীদারিত্ব চুক্তি হল একটি আইনি দলিল যা দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বা সত্তার মধ্যে অংশীদারিত্বের শর্তাবলীর রূপরেখা দেয়। ব্যবসার পরিচালনা, লাভ-লোকসানের বরাদ্দ এবং বিলুপ্তি ঘটলে সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রে সমস্ত অংশীদার একই পৃষ্ঠায় রয়েছে তা নিশ্চিত করার জন্য একটি অংশীদারিত্ব চুক্তি থাকা গুরুত্বপূর্ণ৷
এখানে কিছু মূল উপাদান রয়েছে যা একটি অংশীদারি চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত:
১. অংশীদারিত্বের নাম এবং উদ্দেশ্য: চুক্তিতে অংশীদারিত্বের নাম এবং এর উদ্দেশ্যের একটি বিবৃতি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
২. অবদান: চুক্তিতে উল্লেখ করা উচিত যে প্রতিটি অংশীদার অংশীদারিত্বে কি অবদান রাখবে, কোন অর্থ, সম্পত্তি বা পরিষেবা সহ।
৩. বরাদ্দ: চুক্তিতে অংশীদারদের মধ্যে কীভাবে লাভ এবং ক্ষতি বরাদ্দ করা হবে তার রূপরেখা দেওয়া উচিত।
৪. ব্যবস্থাপনা: অংশীদারিত্ব কীভাবে পরিচালিত হবে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কারা দায়ী থাকবে তা চুক্তিতে উল্লেখ করা উচিত।
৫. কর্তৃত্ব এবং বিধিনিষেধ: চুক্তিতে প্রতিটি অংশীদারের কর্তৃত্ব এবং তাদের কর্মের উপর কোন সীমাবদ্ধতার রূপরেখা দেওয়া উচিত।
৬. সিদ্ধান্ত গ্রহণ: চুক্তিতে উল্লেখ করা উচিত যে কীভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং বড় সিদ্ধান্তের জন্য কোন স্তরের চুক্তি প্রয়োজন।
৭. বিরোধ নিষ্পত্তি: চুক্তিতে অংশীদারদের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
৮. মেয়াদ এবং সমাপ্তি: চুক্তিতে অংশীদারিত্বের মেয়াদ এবং সমাপ্তির শর্তাবলী উল্লেখ করা উচিত।
৯. বাইআউট এবং বিলুপ্তি: চুক্তিতে অংশীদার কেনার প্রক্রিয়া এবং বিলুপ্তির ঘটনায় সম্পদের বন্টনের রূপরেখা দেওয়া উচিত।
একটি অংশীদারিত্ব চুক্তির খসড়া তৈরি করার সময় এটি সমস্ত আইনি প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে এবং জড়িত সমস্ত পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে তা নিশ্চিত করার জন্য একজন আইনি পেশাদারের সাথে পরামর্শ করা গুরুত্বপূর্ণ ৷
অংশীদারি ব্যবসায় পরিচালনা করেন কে?
অংশীদারি ব্যবসা পরিচালনা করা হলো দুটি বা ততোধিক ব্যবসাধীনের মধ্যে সমঝোতা এবং সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি ব্যবসার পরিচালনা করা। এই ব্যবসায় প্রতিটি অংশীদার একটি নির্দিষ্ট হারে অর্থ বা সম্পদ বিনিময় করে এবং ব্যবসার নির্দিষ্ট পরিমাণের অংশ মালিকানাধীন করে।
অংশীদারি ব্যবসার পরিচালনা করার জন্য একটি স্বস্তিপ্রাপ্ত ও প্রফেশনাল ব্যবসা পরিচালক প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়াও, অংশীদারদের মধ্যে ভাগ পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ বিনিময় এবং নির্ধারিত বিষয়ে সমঝোতা হতে হবে। অংশীদারি ব্যবসা পরিচালনার জন্য কোন একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তি নেই। অংশীদারি ব্যবসা একটি ব্যবসায়িক মডেল যেখানে কয়েকটি ব্যক্তি একসঙ্গে একমত হয় এবং পরিচালনার জন্য একটি নিয়মিত নিবন্ধনপত্র এবং নীতিমালা হয়। অংশীদারি ব্যবসা পরিচালনার জন্য একজন ব্যবসায়ি ব্যক্তি অথবা একটি ব্যবসায় পরিচালনা পরিষদ ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট নির্দেশিকা অনুসরণ করে।
১৯৩২ সালের অংশীদারি আইন
১৯৩২ সালের অংশীদারি আইন বাংলাদেশের মূলনীতি বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন। এই আইনটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বিশেষ একটি উভয় আদর্শ দিয়ে নির্দেশ করে। প্রথমত, এই আইনটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পদ্ধতির আদর্শস্বরূপ কেন্দ্রীভূত আইন হিসেবে পরিচিত। দ্বিতীয়ত, এই আইনটি বাংলাদেশের সংবিধান এবং আইনগত প্রণীত বিধি-নিয়ম সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য উপস্থাপন করে।
এই আইনটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পদ্ধতি সম্পর্কে স্পষ্টতা এবং স্থিরতা নির্দেশ করে। এটি বাংলাদেশের সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি বিবেচনার আলোকে উল্লেখ করে এবং একটি প্রশাসনিক কাঠামো প্রণীত করে যা প্রধানতঃ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সংসদ এবং ন্যাযবিভাগ সম্পর্কে নির্দেশ করে।