একমালিকানা ব্যবসায় || Sole Proprietorship Business
একমালিকানা ব্যবসায়ের ধারণা
জনাব রাকিব চাকরি ছেড়ে জমানো অর্থ নিয়ে একটি ডেইরি ফার্ম শুরু করেন। এর সার্বিক দেখাশোনার দায়িত্বও তিনিই পালন করেন। কখনও অর্থের প্রয়োজন হলে তার যোগানও নিজেই দেন। অল্প দিনের মধ্যেই তার ফার্মে প্রচুর মুনাফা হয়, যা তিনি একাই ভোগ করেন।
উপরিউক্ত ঘটনায় যে ধরনের ব্যবসায়ের চিত্র ফুটে উঠেছে তা-ই হলো একমালিকানা ব্যবসায়। মানব সভ্যতার শুরুর দিকে পণ্যসামগ্রীর বাজার নির্দিষ্ট স্থান বা অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তখন প্রতিটি পরিবার এক একটি উৎপাদন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য হতো। প্রত্যেক পরিবারের কর্তা উত্ত প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা কাজ পরিচালনা করতেন। এ থেকেই একমালিকানা বা একাধিপতি ব্যবসায়ের উৎপত্তি। মূলত, একক মালিকানার ভিত্তিতেই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। এজন্য, এ ব্যবসায়কে পৃথিবীর প্রাচীনতম ও জনপ্রিয় ব্যবসায় সংগঠন বলা হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে একমালিকানা ব্যবসায় সংগঠনই সর্বাধিক।
সাধারণভাবে একজন ব্যক্তির মালিকানায় গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়কে একমালিকানা ব্যবসায় বলে। এ ব্যবসায়ে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে ব্যক্তি নিজ দায়িত্বে মূলধন যোগাড় করে ব্যবসায় গঠন ও পরিচালনা করেন। আবার, উক্ত ব্যবসায়ে অর্জিত সব লাভ নিজে ভোগ করেন বা ক্ষতি হলে নিজেই তা বহন করেন। এ ধরনের ব্যবসায় গঠন করা অত্যন্ত সহজ। যেকোনো ব্যক্তি নিজের উদ্যোগে স্বল্প পরিমাণ অর্থ নিয়ে এ জাতীয় ব্যবসায় শুরু করতে পারেন। প্রয়োজনে মালিক একাধিক কর্মচারী নিয়োগ করতে পারেন। অধিক অর্থও বিনিয়োগ করতে পারেন।
আইনের দিক থেকে একমালিকানা ব্যবসায় গঠনে তেমন কোনো নিয়ম-কানুন নেই। গ্রাম-গঞ্জে, হাট-বাজারে, রাস্তার পাশে কিংবা নিজ বাড়িতে যে কেউ ছোট আকারে এ ধরনের ব্যবসায় শুরু করতে পারেন। তবে, আইন অনুযায়ী সিটি কর্পোরেশন বা পৌর এলাকায় ব্যবসায়ীকে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হয়। আমাদের দেশে সাধারণত মুদির দোকান, চায়ের দোকান, সবজির দোকানসহ অধিকাংশ খুচরা পণ্যের দোকানগুলো একক মালিকানার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে।
বি. ও. হুইলার (B. O. Wheeler) বলেন, ''একমালিকানা ব্যবসায় এমন ধরনের ব্যবসায় যার মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ একজন মাত্র ব্যক্তির মাধ্যমে হয়ে থাকে।''
উল্লিখিত আলোচনা ও সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে একমালিকানা ব্যবসায় সম্পর্কে বলা যায়—
১. একমালিকানা ব্যবসায় একক মালিকানায় গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়;
২. মালিক একাই এর মূলধন সরবরাহকারী, ঝুঁকি বহনকারী ও মুনাফা ভোগকারী;
৩. শুধু মালিকের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এর স্থায়িত্ব অনিশ্চিত;
৪. এরূপ ব্যবসায়ে মালিক সম্পূর্ণ স্বাধীন।
সুতরাং, একক মালিকানায় কোনো ব্যক্তি ব্যবসায় গঠন ও নিয়ন্ত্রণ, মূলধন সরবরাহ, ঝুঁকি গ্রহণ এবং মুনাফা বা ক্ষতি একাই ভোগ করলে উক্ত ব্যবসায়কে একমালিকানা ব্যবসায় বলা হয়।
একমালিকানা ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য
পৃথিবীর প্রাচীনতম এবং অত্যন্ত সহজ প্রকৃতির ব্যবসায় সংগঠন হলো একমালিকানা ব্যবসায়। এরূপ ব্যবসায় স্বল্প ব্যয়ে, স্বল্প মূলধন নিয়ে সহজে গঠন করা যায়। ফলে, মানব সভ্যতার শুরু থেকে আজও দেশের আনাচে-কানাচে এ ধরনের ব্যবসায় গড়ে উঠছে। নিচে এরূপ ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করা হলো—
১. একক মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ (Single ownership and control): একমালিকানা ব্যবসায়ের মালিক একজন মাত্র ব্যক্তি, যা ব্যবসায়ের নাম থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। কোনো অবস্থাতেই এর মালিক বা স্বত্বাধিকারী একের অধিক হতে পারে না। স্বাধীনভাবে মালিকের একক উদ্যোগেই এ ব্যবসায় গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।
২. সহজ গঠন (Easy formation): এ জাতীয় ব্যবসায় গঠন করা খুবই সহজ। যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো সময় উদ্যোগ নিলেই এ ব্যবসায় গঠন করতে পারেন। এরূপ ব্যবসায় স্থাপন করতে নিবন্ধন বা সরকারি নিয়ম-কানুন অনুসরণের প্রয়োজন হয় না। আবার, আইনের আনুষ্ঠানিকতাও পালন করতে হয় না।
৩. একক সত্তা (Single entity): আইনের চোখে এর পৃথক কোনো সত্তা নেই। এখানে ব্যবসায় ও মালিক এক ও অভিন্ন সত্তার অধিকারী। অর্থাৎ মালিককে ব্যবসায় থেকে পৃথকভাবে দেখা হয় না। তাই ব্যবসায়ের নামে কেউ মামলা করতে পারে না। এরূপ ব্যবসায়ের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো মামলা-মোকদ্দমায় মালিকের নামই ব্যবহার করা হয়। আবার, ব্যবসায়ের আয়কর মালিককেই তার নিজ নামে পরিশোধ করতে হয়।
৪. সীমিত মূলধন (Limited capital): ব্যবসায়ের মালিক নিজের তহবিল থেকে ব্যবসায়ের প্রয়োজনীয় পুঁজির সংস্থান করে থাকেন। প্রয়োজনে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। পুঁজির একক যোগানদাতা হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই এতে মূলধনের স্বল্পতা দেখা যায়।
৫. ক্ষুদ্রায়তন (Small in size): একমালিকানা ব্যবসায় সাধারণত সীমিত বা ক্ষুদ্রায়তনের হয়ে থাকে। তবে কখনও কখনও তা মাঝারি কিংবা বৃহদায়তনেরও হতে পারে। এ বৈশিষ্ট্যের কারণে পৃথিবীর সব দেশেই একমালিকানা ব্যবসায় অন্যান্য ব্যবসায় সংগঠনের চেয়ে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
৬. অসীম দায় (Unlimited liability): একমালিকানা ব্যবসায়ে মালিকের দায় সীমাহীন বা অসীম। এ দায় ব্যক্তিগতভাবে মালিককেই বহন করতে হয়। এ জাতীয় ব্যবসায়ের দায় মেটাতে মালিকের ব্যক্তিগত সম্পত্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এজন্য এরূপ ব্যবসায়ে মালিককে সর্বদাই দায়িত্বশীল হতে হয়।
৭. একক ঝুঁকি (Single risk): দায়িত্বের দিক দিয়ে একমালিকানা ব্যবসায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এরূপ ব্যবসায়ের সম্পূর্ণ ঝুঁকি মালিক একাই বহন করেন। ব্যবসায়ে কোনোরূপ ক্ষতি বা লোকসান হলে তার সম্পূর্ণ দায় মালিককেই নিতে হয়। আবার ব্যবসায়ের সম্পূর্ণ মুনাফা ভোগ করার অধিকারও মালিকের একারই।
৮. দ্রুত সিধান্ত গ্রহণ (Quick decision making): এ ব্যবসায়ের মালিক সর্বেসর্বা হওয়ায় ব্যবসায়ের স্বার্থে ও প্রয়োজনে যেকোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সমন্বয়সাধন করতে পারেন। কারও বাধার সম্মুখীন হতে হয় না। ফলে, এরূপ ব্যবসায়ের মালিক যেকোনো সময় যেকোনো বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
৯. প্রত্যক্ষ যোগাযোগ (Direct communication): এরূপ ব্যবসায়ে সরবরাহকারী ও ক্রেতাদের সাথে মালিকের সরাসরি যোগাযোগ থাকে। এজন্য ক্রেতাদের রুচি, চাহিদা ও পছন্দ অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ বা সেবা দেওয়া যায়।
১০. অনিশ্চিত স্থায়িত্ব (Uncertain durability): একমালিকানা ব্যবসায় গঠন, পরিচালনা ও বিলোপসাধনসহ যাবতীয় ব্যবসায়িক কার্যক্রম সরকারি বিধিনিষেধ থেকে মুক্ত। এরূপ ব্যবসায়ের স্থায়িত্ব মালিকের কর্মক্ষমতা ও ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। তাই, যেকোনো মুহূর্তে এ ব্যবসায়ের বিলোপসাধন করা যায়।
উপরে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলো একমালিকানা ব্যবসায়কে অন্য সব ব্যবসায় থেকে আলাদা করে বিশেষ আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সাধারণত এসব বৈশিষ্ট্যের জন্যই এ ব্যবসায় এখনও সবার কাছে সমাদৃত।
একমালিকানা ব্যবসায়ের গুরুত্ব
সভ্যতার শুরু থেকে একমালিকানা ব্যবসায় সংগঠন মানুষের সাথী। প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করে একমালিকানা ব্যবসায় আমাদের কাছে অতি প্রয়োজনীয় সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আধুনিক পুঁজিবহুল শিল্প উন্নয়নের যুগেও এ জাতীয় ব্যবসায় সাফল্যের সাথে তার ঐতিহ্যের ধারা বজায় রেখে চলছে। ব্যক্তিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এরূপ ব্যবসায়ের যে গুরুত্ব রয়েছে, তা নিচে তুলে ধরা হলো-
১. বৃহদায়তন উৎপাদনে সহায়তা (Help in large scale production): একমালিকানা ব্যবসায় বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য কাঁচামাল সরবরাহ করে থাকে। এছাড়া বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা ভোক্তাদের কাছে পৌছানোর দায়িত্ব এ জাতীয় সংগঠন পালন করে। এভাবে এগুলো বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনের চাকা সচল রেখে তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। একটি কোমল পানীয় কোম্পানির কথাই ধরা যাক। এ কোম্পানিটি নিশ্চয়ই খুব বড় আকারের। এর পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে মুদির দোকান বা খাবারের দোকান অর্থাৎ একমালিকানা ব্যবসায়ের মাধ্যমে। এভাবে একমালিকানা ব্যবসায় বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করে যাচ্ছে।
২. আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ (Self employment opportunity): স্ব-উদ্যোগে নিজেই নিজের কর্মসংস্থান করাকে আত্মকর্মসংস্থান বলে। বর্তমানে চাকরির বাজার সীমিত। তবে, যেকোনো বেকার লোক স্বপ্ন পরিসরে অল্প পুঁজি নিয়ে এ জাতীয় ব্যবসায় গঠন করতে পারেন। এতে সহজেই বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ফলে, দেশের বেকার সমস্যাও কমতে থাকে। তাছাড়া, এ জাতীয় ব্যবসায় পরিচালনা বৃহদাকার ব্যবসায়ের মতো জটিল নয়।
৩. সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার (Maximum utilization of resources): এরূপ ব্যবসায় শহরে, গ্রামে-গঞ্জে বা দেশের যেকোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে তোলা যায়। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এ ব্যবসায়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে। এভাবে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে।
৪. প্রশিক্ষণের উপযুক্ত ক্ষেত্র (Proper field of training): পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে হাতে-কলমে শিক্ষাদানের পদ্ধতিকে প্রশিক্ষণ বলা হয়। একমালিকানা ব্যবসায় মানুষের কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতা প্রয়োগের একটি প্রাথমিক ক্ষেত্র। এ ব্যবসায় থেকে মানুষ আরও বেশি অনুপ্রাণিত হয়ে তার সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন ব্যবসায় অর্থাৎ উদ্যোগ নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এরূপ ব্যবসায় গঠন ও পরিচালনা করে একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন। এই অভিজ্ঞতা তাকে পরবর্তীতে বৃহদায়তন ব্যবসায় গঠনে সাহস ও শক্তি জোগাবে।
৫. উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার উন্নয়ন (Development of production and distribution system): ক্ষুদ্রায়তনের একমালিকানা ব্যবসায় সাধারণত ভোত্তা ও জনসাধারণের কাছে অবস্থান করে ও সরাসরি যুক্ত থাকে। ফলে, এটি পণ্য ও সেবার চাহিদা বা বাজার সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এতে করে ভোক্তারা যেমন নতুন ও উন্নত পণ্য ব্যবহারের সুযোগ পায়, তেমনি উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থারও উন্নতি হয়।
৬. জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন (Development of living standard): একমালিকানা ব্যবসায় ব্যাপক জনগোষ্ঠীর আয় ও সম্পদ বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করে। অন্যদিকে, সহজে পণ্য ও সেবা সরবরাহ করে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। এতে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও দেশের সার্বিক উন্নতি তথা জীবনযাত্রার মানও উন্নত হয়। ফলে আর্থিক ও সামাজিকভাবে সবাই লাভবান হয়।
৭. বাজার সৃষ্টি (Creation of market): পণ্য বা সেবার বর্তমান ও সম্ভাব্য ক্রেতাদের সমষ্টিকে বাজার বলা হয়। একমালিকানা ব্যবসায়ী পণ্যসামগ্রী সংগ্রহ করে সেগুলো কেনার ব্যাপারে সম্ভাব্য ভোক্তাদের উদ্বুদ্ধ করেন। এতে ভোক্তারা নতুন নতুন পণ্যদ্রব্য সম্পর্কে জানতে পারেন। এছাড়া, নির্দিষ্ট পণ্য কেনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এটি পণ্যের চাহিদা বাড়ানো ও বাজার সৃষ্টির ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। এভাবে ব্যবসায়ের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়।
৮. উদ্যোক্তা সৃষ্টি (Creation of entrepreneur): ঝুঁকি নিয়ে নিজস্ব কর্মপ্রচেষ্টায় ব্যবসায়কে সাফল্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গকে উদ্যোক্তা বলা হয়। স্বল্প পুঁজি ও সহজে গঠন করে জীবিকা অর্জনের একটি সহজতম উপায় হলো একমালিকানা ব্যবসায়। তাই, সমাজের অনেক লোকই এরূপ ব্যবসায় গঠনের উদ্যোগ নেন। এতে দেশে উদ্যোক্তা শ্রেণির সৃষ্টি হয়। এরূপ ব্যবসায়ে উদ্যোক্তার সর্বোচ্চ দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ থাকে।
৯. তথ্য সরবরাহ ও পরামর্শ প্রদান (Providing information and giving advice): এরূপ ব্যবসায়ীদের সাথে ক্রেতাদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকায় তারা ক্রেতাদের চাহিদা, পছন্দ, অপছন্দ প্রভৃতি জানতে পারেন। তাছাড়া, বাজারের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কেও এদের পরিপূর্ণ ধারণা থাকে। ফলে, প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ ও পরামর্শ দিয়ে তারা পণ্যের সরবরাহকারী ও উৎপাদনকারীকে সহায়তা করতে পারেন। এছাড়া, তারা পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন।
১০. পরিবর্তিত অবস্থার সাথে খাপ খাওয়ানো (Adjustment with the changing situation): ক্ষুদ্রায়তন ব্যবসায় বিধায় যেকোনো পরিবর্তিত অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে একমালিকানা ব্যবসায় সবচেয়ে উপযোগী সংগঠন। এতে নমনীয়তা অর্জন করা অনেক সহজ হয়। ফলে, যেকোনো পরিবর্তনশীল অবস্থায় এ ধরনের ব্যবসায় দক্ষতার সাথে মানিয়ে নেয় ।
এছাড়াও সম্পদের সদ্ব্যবহার, স্বনির্ভরতা অর্জন, সুষ্ঠু ব্যবসায়িক পরিবেশ সৃষ্টি, মূলধনের গতিশীলতা বাড়ানো, জাতীয় আয় বাড়ানো, সামাজিক সুসম্পর্ক ও সামাজিক মর্যাদা বাড়ানোর ক্ষেত্রে একমালিকানা ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সর্বোপরি, মানুষের অর্থনৈতিক ও সমাজ জীবনের অগ্রগতি ও উন্নতিতে এরূপ ব্যবসায় যে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে, সারা বিশ্বে এরূপ ব্যবসায়ের ব্যাপক উপস্থিতিই তার প্রমাণ।
একক মালিকানার সুবিধা এবং অসুবিধা
একক মালিকানা হল এক ধরনের ব্যবসায়িক কাঠামো যেখানে একজন ব্যক্তি সমগ্র ব্যবসা পরিচালনা করে এবং তার মালিকানা রাখে। এটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সহজতম রূপ এবং সাধারণত ছোট ব্যবসা এবং স্ব-নিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা নির্বাচিত হয়। একটি একক মালিকানার সাথে যুক্ত বিভিন্ন সুবিধা এবং অসুবিধা রয়েছে:
একক মালিকানার সুবিধা
সহজ এবং সস্তা গঠন: অন্যান্য ব্যবসায়িক কাঠামোর তুলনায় একটি একমাত্র মালিকানা সেট আপ করা তুলনামূলকভাবে সহজ এবং সস্তা। সাধারণত কোনো আনুষ্ঠানিক আইনি প্রয়োজনীয়তা বা জটিল নিবন্ধন প্রক্রিয়া জড়িত থাকে না।
সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ: একমাত্র মালিক হিসাবে, সমস্ত ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তের উপর আপনার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বৃহত্তর নমনীয়তা এবং দক্ষতার জন্য আপনি পরামর্শ বা বোর্ড মিটিং ছাড়াই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
প্রত্যক্ষ লাভ: ব্যবসার দ্বারা উত্পন্ন যে কোনো লাভ একচেটিয়াভাবে মালিকের। অংশীদার বা শেয়ারহোল্ডারদের সাথে লাভের ভাগ নেই।
ট্যাক্স সুবিধা: একমাত্র মালিকরা নির্দিষ্ট ট্যাক্স সুবিধা ভোগ করতে পারেন। ব্যবসার আয় ব্যক্তিগত আয় হিসাবে বিবেচিত হয় এবং আপনি এটি আপনার ব্যক্তিগত ট্যাক্স রিটার্নে রিপোর্ট করতে পারেন। উপরন্তু, আপনি হোম অফিস খরচ বা ব্যবসা-সম্পর্কিত ভ্রমণ খরচের মতো বিভিন্ন ট্যাক্স কাটছাঁটের জন্য যোগ্য হতে পারেন।
গোপনীয়তা: অন্যান্য ব্যবসায়িক কাঠামোর বিপরীতে, একমাত্র মালিকানায় আর্থিক বিবৃতি বা অন্যান্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের প্রয়োজন হয় না। এটি মালিকের কাছে গোপনীয়তার একটি স্তর অফার করে।
একক মালিকানার অসুবিধা
সীমাহীন দায়: একমাত্র মালিকানার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হল মালিকের ব্যবসার কোনো ঋণ বা বাধ্যবাধকতার জন্য সীমাহীন ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা। যদি ব্যবসার ক্ষতি হয় বা আইনি সমস্যার সম্মুখীন হয়, তাহলে মালিকের ব্যক্তিগত সম্পদ ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
সীমিত সম্পদ: একক মালিকানা প্রায়ই মূলধন বাড়াতে বা অর্থায়ন পেতে সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হয়। মালিকের ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার সাথে যুক্ত উচ্চ ঝুঁকির কারণে ব্যাংক এবং বিনিয়োগকারীরা অর্থ ধার দিতে বা একক মালিকানায় বিনিয়োগ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হতে পারে।
সীমিত দক্ষতা: একজন একমাত্র মালিক হিসাবে, আপনাকে ব্যবসার সমস্ত দিক নিজেই পরিচালনা করতে হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে অপারেশন, মার্কেটিং, অ্যাকাউন্টিং এবং আরও অনেক কিছু। এটি অপ্রতিরোধ্য হতে পারে, বিশেষ করে যদি আপনার নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব হয়। এটি ব্যবসার বৃদ্ধির সম্ভাবনাকেও সীমাবদ্ধ করতে পারে।
ধারাবাহিকতার অভাব: একটি একমাত্র মালিকানা মালিকের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ, এবং ব্যবসার আলাদা আইনি অস্তিত্ব নেই। মালিক যদি অবসর গ্রহণ করেন, অক্ষম হন বা মারা যান, তাহলে ব্যবসার অস্তিত্ব বন্ধ হয়ে যেতে পারে বা অন্য কাউকে মালিকানা হস্তান্তর করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে।
স্কেলিংয়ে অসুবিধা: সীমিত সংস্থান এবং দক্ষতার কারণে, একটি একক মালিকানা স্কেল করা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। অতিরিক্ত সহায়তা বা মূলধন ছাড়া ব্যবসা প্রসারিত করা বা বৃদ্ধির সুযোগের সুবিধা নেওয়া কঠিন হতে পারে।
আপনার নির্দিষ্ট প্রয়োজনের জন্য উপযুক্ত ব্যবসায়িক কাঠামোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এই সুবিধাগুলি এবং অসুবিধাগুলি বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। একজন আইনি বা আর্থিক পেশাদারের সাথে পরামর্শ আপনার ব্যক্তিগত পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে আরও নির্দেশিকা প্রদান করতে পারে।