লেনদেন || Transaction

লেনদেনের ধারণা ও সংজ্ঞা

লেনদেন হলো হিসাববিজ্ঞানের মূল উপাদান। লেনদেন শব্দটি 'লেন' এবং 'দেন'-এ দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। ‘লেন' অর্থ ‘নেওয়া আর ‘দেন’ ‘অর্থ দেওয়া। সুতরাং 'লেনদেন' শব্দটির অভিধানগত অর্থ হলো নেওয়া এবং দেওয়া অর্থাৎ গ্রহণ ও দান অথবা ‘আদান-প্রদান’। কিন্তু ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে যে কোনো আদান-প্রদানই লেনদেন বলে গণ্য হবে না। ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে লেনদেন বলতে শুধু সেই সকল আদান-প্রদানকে বুঝায় যেগুলো অর্থ অথবা অর্থমূল্যের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়। যেমন— মনে কর, – রাম রহিমকে ৫০০ টাকা দিল। এ ঘটনায় দুটি দিক দেখা যায়-রহিম ৫০০ টাকা গ্রহণ করল এবং রাম ৫০০ টাকা প্রদান করল।

হিসাবশাস্ত্রের জনক লুকা প্যাসিওলি (Summa De - Arithmetica, Geometrica, Proportion-et Proportionalita) তার গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, প্রত্যেকটি ব্যবসায়িক লেনদেনের দুটি দিক জড়িত। একটি আদানের (Receiving) দিক এবং অপরটি প্রদানের (Giving) দিক। উপরে রাম ও রহিমের মধ্যে ৫০০ টাকা আদান-প্রদানের মাধ্যমে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে নগদ টাকা ও পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ছাড়াও সেবার (Service) আদান-প্রদান হলেও লেনদেনের উদ্ভব হয়। 

প্রাচীনপন্থী হিসাবশাস্ত্রবিদ এল. সি. ক্রোপার (L. C. Cropper) লেনদেনের একটি পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা দিয়েছেন। তার মতে, “অর্থের আদান-প্রদান অথবা মাপকাঠিতে পরিমাপযোগ্য কোনো দ্রব্য বা সেবার আদান-প্রদানের মাধ্যমে কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে এরূপ আদান-প্রদানকে লেনদেন বলে।”

উপরের সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে লেনদেন হলো :
ক. এমন একটি ঘটনা যা অর্থের মাপকাঠিতে পরিমাপযোগ্য এবং 
খ. যে ঘটনাটি দ্বারা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। বস্তুত, যে ঘটনা দ্বারা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে না হিসাবশাস্ত্রে তাকে লেনদেনরূপে গণ্য করা হয় না। কারণ কারবারি লেনদেন নির্ধারণ করার মূল নীতিই হলো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন সাধন। "Every -Fieldhouse financial change which occurs in our business is a transaction."

সম্পত্তিসমূহ = দায়সমূহ + মালিকানা স্বত্ব 
অথবা, 
Assets = Liabilities + Owners Equity

আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে লেনদেন: হিসাবনিকাশ সমীকরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এতে মোট তিনটি উপাদান রয়েছে- সম্পত্তিসমূহ (Assets), দায়সমূহ (Liabilities) এবং স্বত্বাধিকার বা মালিকানা স্বত্ব (Owners Equity)। হিসাব সমীকরণটি হচ্ছে। আমেরিকার আধুনিক হিসাবশাস্ত্রবিদগণের মতে, “কোনো আর্থিক ঘটনার দ্বারা হিসাবনিকাশ সমীকরণের উপাদানসমূহে কোনো পরিবর্তন সাধিত হলে উক্ত ঘটনাকে লেনদেন বলে।” 

সুতরাং কোনো আর্থিক ঘটনা দ্বারা যদি কারবারের সম্পত্তিসমূহে অথবা দায়দেনায় অথবা কারবারের মালিকানা স্বত্বে কোনোরূপ পরিবর্তন আসে, তাকে লেনদেনরূপে আখ্যায়িত করা হয়।

লেনদেন

লেনদেনের প্রকারভেদ

বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে লেনদেনকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা যায়। নিচে বিশদভাবে আলোচনা করা হলো' 
১। প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক (Organization Basis):
ক. বহিঃলেনদেন (External Transactions) ও 
খ. আন্তঃলেনদেন (Internal Transactions) |

ক. বহিঃলেনদেন (External Transactions): বাইরের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে আর্থিক সম্পর্কবশত কোনো প্রতিষ্ঠানের যে লেনদেন হয় তাকে বহিঃলেনদেন বলা হয়। সাধারণত দ্রব্য বা সেবার আদান-প্রদানের জন্যই এরূপ লেনদেন সংঘটিত হয়। এজন্য এরূপ লেনদেনকে ব্যবসায়িক লেনদেনও (Business Transaction) বলা হয়। 

খ. আন্তঃলেনদেন (Interal Transactions): অবচয় (Depreciation), প্রাপ্য আয় (Accrued Income), প্রদেয় খরচ (Unpaid Expenses) এবং অন্যান্য মিলকরণ (Adjustments) ও সমাপ্তিকরণ (Closing) সংক্রান্ত লেনদেনগুলোকে আন্তঃলেনদেন বলা হয়। এদেরকে হিসাবনিকাশ সংক্রান্ত লেনদেনও (Accounting Transaction) বলা হয়ে থাকে।

২. মূল্য পরিশোধ ভিত্তিক (Based on payment):
ক. নগদ লেনদেন (Cash Transactions )
খ. ধারে লেনদেন (Credit Transactions) ও 
গ. অ-নগদ লেনদেন (Non-Cash Transactions )।

ক. নগদ লেনদেন (Cash Transactions): নগদ অর্থ বা চেকের মাধ্যমে যে সকল লেনদেন করা হয় তাদেরকে নগদ লেনদেন বলে। এরূপ লেনদেন সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথেই নগদ টাকায় বা চেকের মাধ্যমে তার মূল্য পরিশোধ করা হয়। যেমন— নগদ মূল্যে ব্যবসায়িক পণ্য ক্রয়, চেকের বিনিময়ে ব্যবসায়িক পণ্য বিক্রয়, কোনো খরচ বাবদ নগদ অর্থ প্রদান ইত্যাদি নগদ লেনদেনের উদাহরণ। 

খ. ধারে লেনদেন (Credit Transactions): আবার সম্পত্তি বা পণ্য বিক্রয় সংক্রান্ত কোনো লেনদেনের মূল্য যদি তাৎক্ষণিক নগদ অর্থে অথবা চেকের মাধ্যমে প্রদান করা না হয় এবং ভবিষ্যতের কোনো তারিখে টাকা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় তা হলে এরূপ লেনদেনকে ধারে লেনদেন (Credit Transactions) বলে।

গ. অ-নগদ লেনদেন (Non-Cash Transactions): চেক অথবা নগদ অর্থ ব্যতীত অন্যান্য যাবতীয় লেনদেনকে অ- নগদান লেনদেন বলা হয়। যেমন— ক্রীত পণ্য ত্রুটিযুক্ত বিধায় ফেরত প্রদান, প্রাপ্য আয়, প্রদেয় খরচ ইত্যাদি হলো অ- নগদ লেনদেনের উদাহরণ।

৩. দৃশ্যমানতা ভিত্তিক (Visibility Basis):
ক. দৃশ্যমান লেনদেন (Visible Transactions) ও 
খ. অদৃশ্যমান লেনদেন (Invisible Transactions)

ক. দৃশ্যমান লেনদেন (Visible Transaction): যে সকল লেনদেনের ফলাফল দৃষ্টিগোচর হয়, তাদেরকে দৃশ্যমান লেনদেন বলে। যেমন— কাঁচামাল, আসবাবপত্র, মেশিন ক্রয় ইত্যাদি।

খ. অদৃশ্যমান লেনদেন (Invisible Transactions): যে সকল লেনদেনের ফলাফল বা প্রভাব দেখা যায় না, তাদেরকে অদৃশ্যমান লেনদেন বলে। যেমন- যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, অট্টালিকা ইত্যাদি স্থায়ী সম্পত্তির অবচয়, শেয়ারের বাট্টা, প্রাথমিক খরচ ইত্যাদি এ শ্রেণির লেনদেন।

৪. উদ্দেশ্য ভিত্তিক (Objective Basis):
ক. কারবারি লেনদেন: ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে দৈনন্দিন যেসব লেনদেন সংঘটিত হয় তাকে কারবারি লেনদেন বলে। মুনাফা অর্জন করাই এ সমস্ত লেনদেনের মূল উদ্দেশ্য। যেমন— পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, বেতন প্রদান ইত্যাদি।

খ. অ-কারবারি লেনদেন: মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত না হয়ে সমাজের কল্যাণের উদ্দেশ্যে যদি কোনো প্রতিষ্ঠান লেনদেন সম্পন্ন করে তবে তাকে অ-কারবারি লেনদেন বলে। এ লেনদেনের মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজের কল্যাণ সাধন। যেমন— সরকারি স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ইত্যাদি। তবে ব্যক্তি মালিকানাধীন হাসপাতাল, কলেজ অ-কারবারি প্রতিষ্ঠান নয়।

গ. ব্যক্তিগত লেনদেন (Personal Transactions): ব্যক্তিগত জীবনে আমরা যেসব লেনদেন সম্পাদন করি তাদেরকে ব্যক্তিগত লেনদেন বলে। যেমন- বাজার খরচ, গাড়ি কেনা, বাড়ি কেনা ইত্যাদি।

৫. উপযোগিতা ভিত্তিক (Utility Basis):
ক. মূলধনজাতীয় লেনদেন (Capital Transactions ): যে সকল লেনদেন থেকে দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল পাওয়া যায় অর্থাৎ যার উপযোগিতা একাধিক আর্থিক বছর বজায় থাকে তাকে মূলধনজাতীয় লেনদেন বলে। যেমন— আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি ক্রয়, দালানকোঠা নির্মাণ ইত্যাদি।

খ. মুনাফাজাতীয় লেনদেন (Revenue Transactions): যে সকল লেনদেনের থেকে দীর্ঘমেয়াদি নয় স্বল্পমেয়াদি সুবিধা পাওয়া যায় তাকে মুনাফাজাতীয় লেনদেন বলে। এ সকল লেনদেনের উপযোগিতা সাধারণত একটি আর্থিক হিসাব বছরেই শেষ হয়ে যায়। যেমন- কর্মীদেরকে বেতন প্রদান, মজুরি প্রদান, বাড়িভাড়া প্রাপ্তি, কমিশন প্রাপ্তি ইত্যাদি।

৬. আকারের ভিত্তিতে (Basis of Form):
ক. দ্রব্য (Goods): দ্রব্য বলতে এমন কিছুকে বোঝায় যা বাজারে অর্পণের মাধ্যমে মানুষের প্রয়োজন ও অভাবের সন্তুষ্টি বিধান করতে সক্ষম হয়। দ্রব্যের মাধ্যমে লেনদেন সংঘটিত হয়। যেমন— অফিসের প্রয়োজনে ১,০০০ টাকার নথিপত্র কয় । 

খ. সেবা (Services): সেবার আকারেও লেনদেন সংঘটিত হয়। সেবা হচ্ছে যে কোনো কাজ বা সুবিধা যা একপক্ষ অন্যপক্ষকে প্রদান করতে পারে, যা অবশ্যই অস্পর্শনীয়। যেমন- বিভিন্ন অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সেবা। আবার পেশাদার হিসাববিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে সেবা প্রদান করে থাকেন।

গ. টাকা (Money): শুধু অর্থ প্রদানের মাধ্যমে অর্থাৎ কোনোরূপ পণ্য বা সেবা ব্যতীতও লেনদেন সংঘটিত হয়। যেমন- আন্তঃব্যাংকিং লেনদেনসমূহ।

ঘ. টাকা সংগ্রহের অধিকার আকারে (In the form of Right of Collecting Money): টাকা সংগ্রহের অধিকার এর আকারেও লেনদেন সংঘটিত হতে পারে। যেমন- পাওনাদার হতে পাওনা অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে দেনাদারের কাছে প্রাপ্ত হলে, এক্ষেত্রে পাওনাদারের চেকের অর্থ আদায়ের অধিকার দেনাদারের হয়ে থাকে।

এখানে উল্লেখ্য যে, লেনদেনের উপরিউক্ত শ্রেণিবিভক্তি কোনো স্বতন্ত্র শ্রেণিবিভক্তি নয়। একই লেনদেন বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিভিন্ন শ্রেণিতে পড়ে। যেমন- ধারে পণ্য বিক্রয় প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কের দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি একটি বহিঃলেনদেন, আবার অর্থ প্রদানের দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি একটি অ-নগদ লেনদেন। এরূপে আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

লেনদেনের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য

কোনো প্রতিষ্ঠানের যে কোনো আর্থিক পরিবর্তনকে ঘটনা (Event) বলে। প্রত্যেকটি লেনদেন একটি ঘটনা। কিন্তু তাই বলে যে কোনো ঘটনাই লেনদেন বলে গণ্য হবে না। কোনো ঘটনা হিসাবের বইতে লিপিবদ্ধ করার পূর্বে হিসাবরক্ষককে নিশ্চিত হতে হবে এটা লেনদেন কি না। যে সকল বৈশিষ্ট্য থাকলে কোনো ঘটনাকে লেনদেন বলা যেতে পারে নিচে তা আলোচনা করা হলো:

১. আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন (Financial Change): কোনো ঘটনাকে লেনদেনরূপে গণ্য করতে হলে তার মাধ্যমে ব্যবসায়ের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন আসতেই হবে। আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন নিম্নোক্ত দুই প্রকারের যে কোনো প্রকারে হতে পারে। যেমন-

ক. নিট পরিবর্তন (Net Change): এর দ্বারা সম্পত্তি এবং দায়ের মোট মূল্যের পরিবর্তন হয়। মনে কর, জামান আমানের নিকট ৫০০ টাকা পায়। জানা গেল, আমান দেউলিয়া হয়ে গেছে এবং তার নিকট হতে টাকা পাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। এক্ষেত্রে আমানের দেউলিয়া হওয়া জামানের নিকট একটি লেনদেন। কেননা আমানের দেউলিয়া হওয়ার ফলে জামানের নিট ৫০০ টাকা ক্ষতি হয়েছে। আরেকটি উদাহরণ, মনে কর কোনো ব্যবসায়ের ৫,০০০ টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেল। এতে প্রতিষ্ঠানের মোট সম্পত্তির মূল্য হ্রাস পেল এবং আর্থিক পরিবর্তন ঘটল। সুতরাং . এটা একটি লেনদেন। এ ধরনের পরিবর্তনকে পরিমাণগত পরিবর্তনও (Quantitative Change) বলা হয়

খ. কাঠামোগত পরিবর্তন (Structural Change): এর দ্বারা সম্পত্তি অথবা দায়ের মোট মূল্যের কোনো পরিবর্তন হয় না কিন্তু সম্পত্তি অথবা দায়ের মধ্যে পারস্পরিক পরিবর্তন হয়। মনে কর, জামানের হাতে ১৫,০০০ টাকা ছিল। সে ১৫,০০০ টাকা দিয়ে একটি মোটর সাইকেল কিনল। আপাত দৃষ্টিতে এ ঘটনায় তার আর্থিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় নি। কেননা, পূর্বে তার হাতে ১৫,০০০ টাকা নগদ ছিল; বর্তমানে সে টাকার পরিবর্তে তার ১৫,০০০ টাকা মূল্যের একটি মোটর সাইকেল রয়েছে। ফলে তার আর্থিক অবস্থার কোনো হ্রাস বৃদ্ধি হলো না। কিন্তু হিসাববিজ্ঞানের মতে এ ঘটনাটিও জামানের নিকট একটি লেনদেন বলে গণ্য হবে। কেননা, এ ঘটনায় জামানের আর্থিক অবস্থায় কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটেছে। এ ধরনের পরিবর্তনকে গুণগত পরিবর্তনও (Qualitative Change) বলা হয়।

২. অর্থের অঙ্কে পরিমাপণ (Money Measurement): কোনো ঘটনাকে লেনদেন বলে গণ্য করতে হলে অবশ্যই তা অর্থের অঙ্কে পরিমাপযোগ্য হতে হবে। যেমন— একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে একজন ম্যানেজার অবসর গ্রহণ করায় তাকে এক লক্ষ টাকা অবসর ভাতা দেওয়া হলো। এক্ষেত্রে অবসর ভাতা টাকার অঙ্কে পরিমাপযোগ্য বলে এটা লেনদেন বলে গণ্য হবে। কিন্তু উক্ত ম্যানেজার সাহেবের অবসর গ্রহণ করবার ফলে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতায় কিছুটা প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। ফলে ব্যবসায়ের কিছুটা ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু এরূপ ক্ষতির পরিমাণ কত তা অর্থের অঙ্কে পরিমাপযোগ্য নয়। সুতরাং একে লেনদেন বলা যাবে না।

৩. দ্বৈত সত্তা (Double Effect): দুতরফা দাখিলা পদ্ধতি অনুসারে প্রত্যেকটি লেনদেনের দুইটি পক্ষ থাকবে। অর্থাৎ একটি লেনদেনের ফলে দুইটি খাতে পরিবর্তন আসবে। সুতরাং কোনো ঘটনাকে লেনদেন বলে গণ্য করতে হলে দেখতে হবে এর দ্বৈত সত্তা আছে কি না। যেমন— করিম সাহেব নগদ ৫০০ টাকার মাল ক্রয় করেছেন। এখানে করিম সাহেবের কারবারে মালের পরিমাণ বাড়বে বিধায় মাল ক্রয় হিসাব ডেবিট হবে এবং টাকা কমে যাবে বলে নগদান হিসাব ক্রেডিট হবে। কারণ সম্পত্তিবাচক হিসাবে যা আসে বা বৃদ্ধি পায় তা ডেবিট হয় এবং যা চলে যায় বা হ্রাস পায় তা ক্রেডিট হয়। এখানে দেখা যাচ্ছে যে, ঘটনাটির দ্বৈত সত্তা আছে। সুতরাং এটা একটি লেনদেন।

৪. ঘটনার স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও স্বাতন্ত্র্য্যতা (Independence of Events): লেনদেন হতে হলে প্রত্যেকটি ঘটনাকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং স্বাধীন বলে ধরতে হবে। অর্থাৎ কোনো ঘটনাই অপর কোনো পূর্ববর্তী বা পরবর্তী ঘটনার উপর নির্ভরশীল হবে না। যেমন— করিম রহিমের নিকট হতে ৮,০০০ টাকার পণ্য ধারে ক্রয় করে দুই মাস পরে রহিমকে টাকা পরিশোধ করল। এক্ষেত্রে মাল ক্রয় এবং তার মূল্য পরিশোধ এ ঘটনা দুইটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু তাই বলে তাদেরকে একটি লেনদেন বলে ধরা যাবে না। তারা পরস্পর স্বাধীন দুইটি লেনদেন।

৫. অদৃশ্যমানতা (Invisibility): লেনদেন সর্বদাই দৃশ্যমান হবে এমন কোনো কথা নেই। কখনও কখনও এটা অদৃশ্যও (Invisible) হতে পারে। যেমন— বছরের প্রথম দিনে জনৈক ব্যবসায়ী একটি মেশিন ক্রয় করল। সারা বছর ধরে ঐ মেশিনের সাহায্যে সে দ্রব্য উৎপাদন করে বিক্রয় করল। সারা বছর ব্যবহার করবার ফলে মেশিনটির মূল্য অবশ্যই কিছুটা হ্রাস পাবে। এ মূল্য হ্রাসকে অবচয় (Depreciation) বলা হয়। এ অবচয় যদিও কোনো দৃশ্যমান ঘটনা নয়, তথাপি এটা একটি লেনদেনরূপে গণ্য হবে।

৬. ইতিবৃত্ত ঘটনা (Historical Events): সাধারণত ইতঃপূর্বে ঘটে গেছে এরূপ ঘটনাকেই লেনদেনরূপে হিসাবের বইতে লিবিপদ্ধ করা হয়। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে ভবিষ্যতে ঘটতে পারে এমন ঘটনাকেও লেনদেনরূপে ধরতে হয়। 

৭. হিসাবনিকাশের ভিত্তি (Basis of Accounting): কোনো ঘটনা লেনদেনরূপে গণ্য হবে কিনা, হিসাবনিকাশের ভিত্তির উপরই তা নির্ভর করে। হিসাবরক্ষণের ভিত্তি দুই প্রকারের হতে পারে-(ক) নগদান ভিত্তিক (Cash Basis) এবং (খ) প্রাপ্য- প্রদেয় ভিত্তিক (Accrual Basis)। কোনো ঘটনা নগদান ভিত্তিক পদ্ধতিতে লেনদেন বলে গণ্য না হলেও প্রাপ্য- প্রদেয় ভিত্তিক পদ্ধতিতে তা লেনদেন বলে গণ্য হতে পারে।

৮. দায়সমূহের প্রকৃত অঙ্ক (Actual Amount of Liabilities): কোনো দায় স্বীকার না করা পর্যন্ত তা লেনদেনরূপে ধরা যাবে না। সম্ভাব্য দায়কে লেনদেনরূপে গণ্য করা হয় না।

৯. প্রামাণ্য দলিল (Documentary Evidences): কোনো ঘটনাকে লেনদেন হওয়ার জন্য অবশ্যই প্রামাণ্য দলিল থাকতে হবে। যেমন— ক্যাশ মেমো, ভাউচার ইত্যাদি।

১০. পণ্য ও সেবার বিনিময় (Exchanging Products & Service): লেনদেনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পণ্য বা সেবার বিনিময় সংঘটিত হওয়া। যেমন— ১০,০০০ টাকার পণ্য বিক্রয়।

১১. লিখনযোগ্য (Recordable): যে কোনো ঘটনাকে লেনদেন হতে হলে অবশ্যই তাকে লিখনযোগ্য হতে হবে। হিসাবশাস্ত্রবিদ Hermanson & others এই বৈশিষ্ট্যের দিকে বিশেষ দৃষ্টিপাত করেছেন। তাদের মতামত অনুসারে— "Transactions are recordable happenings or events."

উপরিউক্ত অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও লেনদেনের প্রকৃতপক্ষে দুটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা প্রখ্যাত হিসাববিজ্ঞানী বর্গ R. F. Meigs, W. B. Meigs & M. A. Meigs তাদের Financial Accounting গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, লেনদেন ঘটনা যা 
১. প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সম্পদ ও দায়, মালিকানা স্বত্বের মধ্যে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন আনে এবং 
২. অর্থের অঙ্গে পরিমাপ করা যায়।

চেকের প্রকারভেদ

আর্থিক লেনদেনে সাধারণত ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরণের চেক রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
ব্যক্তিগত চেক: এগুলি একজন ব্যক্তির দ্বারা জারি করা চেক এবং তাদের ব্যক্তিগত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আঁকা হয়।

ক্যাশিয়ারের চেক: এগুলি একটি ব্যাঙ্ক দ্বারা জারি করা চেক, সাধারণত বড় লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত হয়। ব্যাঙ্ক তহবিলগুলির গ্যারান্টি দেয়, সেগুলিকে একটি নিরাপদ অর্থপ্রদানের পদ্ধতিতে পরিণত করে৷

প্রত্যয়িত চেক: এগুলি হল ব্যক্তিগত চেক যা ইস্যুকারী ব্যাঙ্ক দ্বারা প্রত্যয়িত হয়েছে, যা নির্দেশ করে যে চেকের পরিমাণ কভার করার জন্য অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত তহবিল রয়েছে।

ভ্রমণকারীর চেক: এগুলি একটি ব্যাঙ্কের দ্বারা জারি করা পূর্ব-মুদ্রিত চেক যা ভ্রমণের সময় একটি নিরাপদ এবং সুবিধাজনক অর্থপ্রদান হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তারা প্রায়ই নগদ জন্য একটি প্রতিস্থাপন হিসাবে ব্যবহার করা হয়.

মানি অর্ডার: এগুলি হল প্রিপেইড সার্টিফিকেট যা একটি ব্যাঙ্ক বা অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা হয়। এগুলি বিল পরিশোধ করতে বা কেনাকাটা করতে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং সেগুলিকে অর্থপ্রদানের একটি নিরাপদ পদ্ধতি হিসাবে বিবেচনা করা হয়৷

ইলেক্ট্রনিক চেক: ই-চেক বা ACH (অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউস) অর্থপ্রদান নামেও পরিচিত, এগুলি কাগজের চেকের ডিজিটাল সংস্করণ। এগুলি প্রায়শই অনলাইন লেনদেন বা স্বয়ংক্রিয় বিল পরিশোধের জন্য ব্যবহৃত হয়।

বেতনের চেক: এগুলি হল একজন নিয়োগকর্তা কর্তৃক কর্মীদের তাদের মজুরি বা বেতন প্রদানের জন্য জারি করা চেক।

পোস্ট-ডেটেড চেক: এগুলি এমন চেক যা ভবিষ্যতের তারিখ দিয়ে লেখা হয়, সাধারণত চেক লেখার সময় একজন ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত তহবিল না থাকলে ব্যবহার করা হয়। প্রাপক ভবিষ্যতের তারিখ পর্যন্ত চেকটি ধরে রাখতে সম্মত হন, যখন এটি কভার করার জন্য অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত তহবিল থাকে।

দ্রুত লেনদেন

সুইফট লেনদেন বলতে সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাঙ্ক ফিনান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (SWIFT) নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত আর্থিক লেনদেনকে বোঝায়। SWIFT হল একটি মেসেজিং নেটওয়ার্ক যা সারা বিশ্বের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি নিরাপদে আর্থিক তথ্য পাঠাতে এবং গ্রহণ করতে ব্যবহার করে।

একটি সুইফ্ট লেনদেনে অংশগ্রহণকারী ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক ক্রিয়াকলাপ যেমন আন্তর্জাতিক অর্থ স্থানান্তর, সিকিউরিটিজ ট্রেডিং, বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন এবং অন্যান্য সম্পর্কিত পরিষেবাগুলির সুবিধার্থে বার্তা বিনিময় জড়িত। এই বার্তাগুলিতে প্রেরক এবং প্রাপকের অ্যাকাউন্টের বিবরণ, জড়িত অর্থের পরিমাণ, মুদ্রা কোড এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য সহ লেনদেন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে।

সুইফ্ট নেটওয়ার্ক ব্যাঙ্কগুলির মধ্যে আর্থিক বার্তাগুলির নিরাপদ এবং দক্ষ স্থানান্তর নিশ্চিত করে, বিশ্বব্যাপী সংযোগ এবং আন্তঃঅপারেবিলিটি সক্ষম করে৷ এটি এই বার্তাগুলির জন্য একটি প্রমিত বিন্যাস প্রদান করে, যা সঠিকতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে এবং আর্থিক লেনদেনে ত্রুটি কমায়৷

এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে যদিও সুইফট লেনদেনগুলি আন্তর্জাতিক স্থানান্তর এবং অন্যান্য আর্থিক ক্রিয়াকলাপের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, তবে সেগুলিই একমাত্র উপায় নাও হতে পারে৷ অন্যান্য বিকল্পগুলি, যেমন ক্রিপ্টোকারেন্সি, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (EFT), এবং স্থানীয় পেমেন্ট সিস্টেমগুলিও লেনদেনের সাথে জড়িত পক্ষগুলির নির্দিষ্ট চাহিদা এবং পছন্দগুলির উপর নির্ভর করে বিদ্যমান।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url