উৎপাদন কী? || What is Production?
উৎপাদন
বাংলাদেশ সম্প্রতি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ দেশের সব জেলায় সবকিছু উৎপাদিত হয় না। যেমন: মুন্সীগঞ্জে আলুর ব্যাপক ফলন হলেও, নরসিংদীতে কলা ও শাকসবজি প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়। অন্যদিকে, রাজশাহীর আম সারাদেশে সমাদৃত।মানুষ তার বুদ্ধি এবং মেধাকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃতি থেকে পাওয়া সম্পদসমূহকে প্রক্রিয়াজাত করে পণ্য তৈরি করে জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করছে। এর ফলে একটি সাধারণ বস্তুও অসাধারণ বস্তুতে রূপান্তরিত হয়ে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করছে। যেমন: মাটি প্রকৃতি থেকে পাওয়া একটি সম্পদ। এই প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে মানুষ তার মেধা, শ্রম ও মূলধন ব্যবহার করে আজ কত কিছুই না তৈরি করছে। প্লেট থেকে শুরু করে একটি ঘরের ড্রইং রুমের সাজসজ্জা, এমনকি কোথাও কোথাও শুধু মাটি দিয়ে তৈরি সম্পূর্ণ বাড়িও দেখা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের বিপরীত দিকে মাটির তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্রের স্থায়ী বাজার চোখে পড়ে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মাটির তৈরি এসব জিনিসকে আজ আকর্ষণীয় পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। মাটির রূপকে পরিবর্তন করে বিভিন্ন ধরনের পণ্য যেমন: প্লেট, হাঁড়ি-পাতিল, কলসি, কলমদানি প্রভৃতি তৈরি করা হয়। এরূপ পরিবর্তনকেই সাধারণ ভাষায় উৎপাদন বলা হয়।
মানুষ প্রকৃতপক্ষে কোনো কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না। তবে প্রাকৃতিক বিভিন্ন সম্পদের আকার, আকৃতি এবং রূপ পরিবর্তন করে মানুষ এর বাড়তি উপযোগ সৃষ্টি করতে পারে। এই বাড়তি উপযোগ সৃষ্টির কাজই হলো উৎপাদন ।
মনে করো 'লতাপাতা কোম্পানি' রাজশাহী থেকে আম কিনল। তারপর ট্রাকে করে সেই আম ঢাকায় এনে তাদের নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে প্রক্রিয়াজাত করে তা 'জুস' হিসেবে বাজারে বিক্রি করল। এর ফলে আমের জুসের দাম স্বভাবতই বেড়ে যায়। কেননা, আম থেকে নতুন উপযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ, আম থেকে তা রূপান্তরিত হয়ে জুসে পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য, কোনো উপকরণ থেকে নতুন উপযোগ সৃষ্টি হলে মানুষ সেক্ষেত্রে বেশি মূল্য দিতেও রাজি থাকে। কেননা, এই উপযোগ মানুষের অভাব পূরণের সক্ষমতা অর্জন করে থাকে।
এভাবে আমরা সুতা থেকে কাপড়, কাঠ থেকে আসবাবপত্র, বাঁশ থেকে কাগজ, দুধ থেকে দই প্রভৃতি বাড়তি উপযোগ সৃষ্টি হতে দেখি। এই বাড়তি উপযোগ বিনিময়যোগ্য এবং বিক্রয়যোগ্য বলে একে উৎপাদন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কোনো কিছু বিনিময়যোগ্য এবং বিক্রয়যোগ্য না হলে তা উপযোগ হিসেবে বিবেচিত হবে কিনা তা আমাদের জানতে হবে। মনে করো, বাসায় অবস্থানরত একমাত্র বোন আফরোজা আক্তার (রানু) সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রতিদিন আটা থেকে রুটি এবং আলু থেকে সুস্বাদু ভাজি তৈরি করেন।
উৎপাদন কাকে বলে?
উদ্ভাবন এবং সৃষ্টি শব্দ দু'টি উৎপাদনের সমার্থক শব্দ। সাধারণ ভাষায় উৎপাদন বলতে নতুন কোনো পণ্য বা সেবা সামগ্রী উদ্ভাবন বা সৃষ্টি করাকে বোঝায়। অর্থাৎ মানুষের অভাব ও চাহিদা পূরণে সক্ষম এমন কোন পণ্য বা সেবা সৃষ্টি করাকে উৎপাদন বলে।প্রকৃতপক্ষে, মানুষ কোনো কিছুই তৈরি বা সৃষ্টি করতে পারে না। তবে প্রাকৃতিক সম্পদের আকার-আকৃতি এবং রূপ পরিবর্তন করে একে ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে পারে। যেমন: তুলা থেকে সুতা, সুতা থেকে কাপড় এবং কাপড় থেকে ক্রেতাদের রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের পোশাক প্রস্তুত করা হয়।
আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, উৎপাদন হলো একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে উৎপাদনের উপকরণগুলো ব্যবহার করে ক্রেতাদের পছন্দ অনুযায়ী পণ্য তৈরি করা হয়। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সব অর্থনৈতিক কার্যক্রম উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। উৎপাদন প্রসঙ্গে কয়েকটি জনপ্রিয় সংজ্ঞা নিচে উপস্থাপন করা হলো-
Heizer এবং Render G, "Production is the creation of goods and services." অর্থাৎ, "দ্রব্য ও সেবা তৈরি করাকে উৎপাদন বলে।"
উপরের আলোচনা থেকে বলা যায়—
১. উৎপাদন একটি চলমান প্রক্রিয়া;
২. এর মাধ্যমে নতুন উপযোগ সৃষ্টি করা হয়;
৩. উৎপাদিত পণ্যের অবশ্যই বিনিময়মূল্য বা বাজার দাম থাকে;
উৎপাদনের আওতা বা পরিধি
৩. রূপান্তর প্রক্রিয়া (Transformation process): প্রকৃতি থেকে পাওয়া বিভিন্ন কাঁচামালকে রূপান্তরের মাধ্যমে নতুন পণ্য উৎপাদন করা হয়। যেমন- গম থেকে আটা এবং আটা থেকে রুটি তৈরি করা হয়। খনি থেকে তেল, স্বর্ণ- রূপা উত্তোলন, বন থেকে কাঠ সংগ্রহ ইত্যাদি উৎপাদনের আওতাভুক্ত।
৪. উৎপাদন পরিকল্পনা (Production planning): কোন পণ্য, কাদের জন্য, কত পরিমাণ, কখন এবং কোথায় উৎপাদন করা হবে তা নির্ধারণ করাকে উৎপাদন পরিকল্পনা বলে। পণ্য উৎপাদনের আগে এর পরিকল্পনা করা আবশ্যক। কেননা উৎপাদন পরিকল্পনা ছাড়া কোনোভাবেই ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব নয়। তাই এ ধরনের উৎপাদন পরিকল্পনাও উৎপাদনের আওতাভুক্ত।
৫. পণ্যের নকশায়ন ( Product design): পণ্য পরিকল্পনার একটি অংশ হলো পণ্য নকশায়ন। পণ্যের আকার- আকৃতি, ওজন, রং, মোড়ক, গুণাগুণ প্রভৃতি কেমন হবে তা নির্ধারণ করাকে পণ্যের নকশায়ন বলে। উল্লেখ্য যে, পণ্য উৎপাদনের আগে পণ্যের নকশা করা হয়। এটিও উৎপাদনের আওতাভূক্ত।
৬. কারখানার অবস্থান (Factory location): উৎপাদন কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য কারখানার অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই উৎপাদনের আগে কারখানার অবস্থান সম্পর্কে পরিকল্পনা করতে হয়। কাঁচামালের সহজলভ্যতা, দক্ষ শ্রমিকের পর্যাপ্ততা, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা প্রভৃতি বিষয় বিবেচনা করে কারখানার অবস্থান নির্বাচন করা উচতি।
৭. মান নিয়ন্ত্রণ (Quality control): মান হলো কোনো পণ্যের নির্দিষ্ট গুণগত বৈশিষ্ট্য, যা ক্রেতাদের ঐ পণ্য কিনতে আকৃষ্ট করে। অন্যদিকে, মান নিয়ন্ত্রণ বলতে ক্রেতা বা ভোক্তার প্রত্যাশা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা এবং কোনো বিচ্যুতি দেখা দিলে তা সংশোধনের ব্যবস্থা করাকে বোঝায়। উৎপাদিত পণ্য যদি মানসম্মত না হয় তাহলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হয়। তাই বলা যায়, পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ উৎপাদনের আওতাভুক্ত।
৮. উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ (Production control): উৎপাদন কার্যক্রম সুনিপুণভাবে চলছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করাকে উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ বলে। উল্লেখ্য যে, মান নিয়ন্ত্রণ পণ্য মানের সাথে সম্পর্কিত কিন্তু উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ পণ্যসামগ্রী উৎপাদন কাজের সাথে সম্পর্কিত। একজন উৎপাদনকারী বিভিন্ন পদক্ষেপ অনুসরণের মাধ্যমে (যেমন- সিডিউলিং, রুটিন, ফলোআপ ) উৎপাদন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
৯. গবেষণা ও উন্নয়ন (Research and development): ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইটের যুগে পণ্য উৎপাদনে গবেষণা অপরিহার্য একটি বিষয়। গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন পণ্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। তাই বলা যায়, গবেষণা ও উন্নয়ন উৎপাদনের আওতাভুক্ত বিষয় ।
১০. প্রশিক্ষণ (Training): কর্মীদের দক্ষ করে তুলতে প্রশিক্ষণের বিকল্প কিছু নেই। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মীরা উৎপাদনের বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে জানতে পারে। এতে কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বাড়ে। একজন দক্ষ কর্মী যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য সম্পদ। কেননা দক্ষ কর্মী দিয়ে পণ্য উৎপাদন করলে ব্যয় ও অপচয় কমে পাশাপাশি পণ্যের মান বাড়ে।