অর্থনীতি || Economics
অর্থনীতির উৎপত্তি ও বিকাশ
আজকের যে অর্থনীতি আমরা পড়ি, পূর্বে এতটা জটিল ছিল না। সনাতন বা আদিম সমাজে মানুষের জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত সহজ সরল। খাবার দাবার, কাপড় চোপড় এবং বাড়িঘর- এসবই ছিল মানুষের মৌলিক চাহিদা। দ্রব্য সামগ্রী বিনিময়ের রীতি ছিল খুব সীমিত। মূলত মানুষের কায়িক পরিশ্রম ছিল উৎপাদনের একমাত্র উপকরণ।
সমাজে কোনো শ্রেণিভেদ ছিল না। হযরত মুসা (আ:) এর সময় ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব হিব্রু (Hebrew) সভ্যতার যুগে ধর্মগ্রন্থে অর্থনীতি বিষয়ে সরলভাবে কিছু আলোচনা হতো। আইন, ধর্ম, নৈতিকতা, দর্শন এবং অর্থনীতি তখন একসঙ্গে আলোচিত হতো। অর্থনীতি বিষয়ের আলাদা কোনো অস্তিত্ব ছিল না। উৎপাদন, ভোগ ও দৈনন্দিন সংসার পরিচালনার বিদ্যাকেই তখন অর্থনীতি বলা হতো।
অর্থনীতির ইংরেজি শব্দ 'Economics' গ্রিক শব্দ 'Oikonomia' থেকে এসেছে। 'Oikonomia' অর্থ গৃহস্থালির ব্যবস্থাপনা (Management of the Household)। প্লেটো (৪২৭-৩৪৭ খ্রিষ্টপূর্ব) এবং এরিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রিষ্টপূর্ব ) ছিলেন গ্রিক সভ্যতার বিখ্যাত দুই চিন্তাবিদ। এ দুজন চিন্তাবিদ ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শ্রমিকের মজুরি , দাসপ্রথা ও সুদসহ অর্থনীতির অনেক মৌলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন । প্রাচীন ভারতে চতুর্থ খ্রিষ্টপূর্বে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ' বৃহত্তর পরিসরে সারা দেশের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি ও সামরিক বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়। দেশের ধন - সম্পদ বৃদ্ধি , রাষ্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও বাণিজ্য উদ্বৃত্তকরণের লক্ষ্যে ইংল্যান্ডের ব্যবসায়ীরা বেশি রপ্তানি করত এবং খুব সামান্যই আমদানি করত। ইংল্যান্ডের উৎপাদিত পণ্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি করে মূল্যবান ধাতু ( সোনা , রুপা, হীরা ইত্যাদি ) আমদানি করা হতো।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফরাসিরা সে দেশের ধনী মানুষের বিলাসী জীবনযাপন , অতিরিক্ত করারোপ এবং ইংল্যান্ডের বাণিজ্যবাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ভূমিবাদ (Physiocracy) মতবাদ প্রচার করেন। ভূমিবাদীদের মতে , কৃষিই ( খনি ও মৎসক্ষেত্রসহ) হলো উৎপাদনশীল খাত । অন্যদিকে শিল্প ও বাণিজ্য উভয়ই অনুৎপাদনশীল খাত হিসেবে মনে করা হতো। এভাবেই প্রাচীন এবং মধ্যযুগে অর্থনীতিবিষয়ক আলোচনা ক্রমশ নানা বিষয়ের সমন্বয়ে জটিল হতে থাকে। রাজনৈতিক অর্থনীতি একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি পায় , যখন ইংরেজ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ ১৭৭৬ সালে তার বিখ্যাত বই “An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations ” রচনা করেন।
অর্থনীতি কাকে বলে?
জ্ঞান - বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে অর্থনীতি বিষয়ের পরিধিও অনেক বেড়েছে। অতীত ও বর্তমান অর্থনীতি বিষয়ের সমন্বয়ে অর্থনীতি বিষয় এখন অনেক উন্নত বা সমৃদ্ধ। প্রথমে যারা অর্থনীতি বিষয়ে উপস্থাপন করেছেন এদের মধ্যে অ্যাডাম স্মিথ , ডেভিড রিকার্ডো এবং জন স্টুয়ার্ট মিল অর্থনীতিকে সম্পদের উৎপাদন ও বণ্টনের বিজ্ঞান বলে মনে করেন। এদের মধ্যে অ্যাডাম স্মিথকে অর্থনীতির জনক বলা হয়। অর্থনীতির এই ধারা ক্লাসিক্যাল অর্থনীতি হিসেবে পরিচিত । তখন অর্থনীতি বা Economics- এর নাম ছিল রাজনৈতিক অর্থনীতি বা Political Economy।
অ্যাডাম স্মিথের প্রদত্ত অর্থনীতির সংজ্ঞা : “অর্থনীতি এমন একটি বিজ্ঞান , যা জাতিসমূহের সম্পদের ধরণ ও কারণ অনুসন্ধান করে ।” সম্পদকে কেন্দ্র করে অর্থনীতি গড়ে ওঠে। তাই সম্পদ আহরণ ও উৎপাদনই মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলির মূল উদ্দেশ্য।
স্মিথের সংজ্ঞার দুর্বলতা হলো :
১. অর্থনীতি মানুষের অসীম অভাবকে কীভাবে সীমিত সম্পদ দিয়ে মেটাবে, এই সংজ্ঞায় তার উল্লেখ নেই।
২.জাতীয় সম্পদের উপর অধিক জোর দেওয়া হলেও ব্যক্তি মানুষ ও তার কাজ - কর্মকে অবহেলা করা হয়েছে।
৩ . সম্পদ আহরণের উপর গুরুত্ব দেওয়া হলেও কী উপায়ে সম্পদ যোগাড় করা হবে তা বলা হয়নি।
৪. সম্পদ বলতে দ্রব্যকেই বোঝানো হয়েছে কিন্তু সেবা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।
২.জাতীয় সম্পদের উপর অধিক জোর দেওয়া হলেও ব্যক্তি মানুষ ও তার কাজ - কর্মকে অবহেলা করা হয়েছে।
৩ . সম্পদ আহরণের উপর গুরুত্ব দেওয়া হলেও কী উপায়ে সম্পদ যোগাড় করা হবে তা বলা হয়নি।
৪. সম্পদ বলতে দ্রব্যকেই বোঝানো হয়েছে কিন্তু সেবা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।
অধ্যাপক মার্শাল কর্তৃক প্রদত্ত অর্থনীতির সংজ্ঞা অধ্যাপক আলফ্রেড মার্শাল সম্পদের চেয়ে মানবকল্যাণের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন । তিনি বলেন, “অর্থনীতি মানবজীবনের সাধারণ কার্যাবলি আলোচনা করে ।”
অর্থনীতির মূল আলোচ্য বিষয় মানুষের অর্থ উপার্জন এবং অভাব মোচনের জন্য সেই অর্থের ব্যয়। অর্থাৎ অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের কল্যাণ সাধন। মার্শাল শুধু মানুষের বাস্তব কল্যাণ সাধন করা নিয়েই আলোচনা করেছেন । বর্তমানে সম্পদের স্বল্পতার সমস্যাই অর্থনীতির মূল সমস্যা। মার্শালের সংজ্ঞায় মানুষের এ মৌলিক সমস্যাটি বিবেচনা করা হয়নি।
অধ্যাপক এল . রবিন্স প্রদত্ত অর্থনীতির সংজ্ঞা অধ্যাপক এল . রবিন্স অর্থনীতির অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাঁর মতে , “ অর্থনীতি হলো এমন একটি বিজ্ঞান , যা মানুষের অসীম অভাব এবং বিকল্প ব্যবহারযোগ্য দুষ্প্রাপ্য উপকরণসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধনকারী কার্যাবলি আলোচনা করে । ”
এ সংজ্ঞার বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ :
১. মানুষের অভাব অসীম এবং অভাবের প্রকৃতি ও পরিমাণ বিভিন্ন রকমের।
২. অভাব পূরণকারী সম্পদ ও সময় খুবই সীমিত।
৩. অসীম অভাবকে কীভাবে সীমিত সম্পদ দ্বারা সমন্বয় সাধন করা যায় , তা অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়।
৪. সম্পদের যোগান সীমিত বলে একই সম্পদ দ্বারা আমাদের বিভিন্ন অভাব পূরণের চেষ্টা করতে হয়।
৫. অভাবের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তা পূরণ করতে হয় । এসব কারণে এ সংজ্ঞাটিকে অধিকতর সুনির্দিষ্ট এবং গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয়।
২. অভাব পূরণকারী সম্পদ ও সময় খুবই সীমিত।
৩. অসীম অভাবকে কীভাবে সীমিত সম্পদ দ্বারা সমন্বয় সাধন করা যায় , তা অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়।
৪. সম্পদের যোগান সীমিত বলে একই সম্পদ দ্বারা আমাদের বিভিন্ন অভাব পূরণের চেষ্টা করতে হয়।
৫. অভাবের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তা পূরণ করতে হয় । এসব কারণে এ সংজ্ঞাটিকে অধিকতর সুনির্দিষ্ট এবং গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয়।
রবিন্সের সংজ্ঞাটির সমালোচনা :
১. রবিন্স অর্থনীতির বিষয়বস্তুকে বেশি বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছেন।২. মানুষ তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে এমন কিছু পছন্দ করে , যা অর্থনীতিতে আলোচনা হয় না।
৩. অর্থনৈতিক কাজকর্মের মূল উদ্দেশ্য যে মানবকল্যাণ তার উল্লেখ নেই।
৪. রবিন্সের সংজ্ঞায় অর্থনীতির সামাজিক পছন্দকে আলোচনা করা হয়নি।
৫. আধুনিক বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তার সংজ্ঞায় আসেনি।
৬. রবিন্স অর্থনীতিতে শুধু মূল্য নিয়ে আলোচনা করেছেন কিন্তু জাতীয় আয়, নিয়োগব্যবস্থা , বিনিয়োগ, বণ্টন ইত্যাদি আলোচনা করেননি।
সবশেষে বলা যায়, রবিন্সের সংজ্ঞা অপেক্ষাকৃত বিমূর্ত। অর্থনীতিতে কোনো তত্ত্বই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। তাই ত্রুটি - বিচ্যুতি থাকার পরেও রবিন্সের সংজ্ঞাটি অধিক গ্রহণযোগ্য। কারণ এটি অর্থনীতির প্রধান সমস্যাটিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছে।