এইচ. এস. সি. কৃষিশিক্ষা ১ম পত্র অনুধাবনমূলক প্রশ্ন || HSC, Agriculture 1st paper, Comprehension questions
প্রথম অধ্যায়: বাংলাদেশের কৃষি
১ . কৃষিই মানুষের মৌলিক চাহিদা (Basic Needs) পূরণ করে ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো হলো খাদ্য , বস্ত্র , বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। এ সবক'টি চাহিদা পূরণ হয় কৃষি থেকে। চাল, ডাল, গম, শাকসবজি, মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি খাদ্যসামগ্রীর সিংহভাগ আসে কৃষি থেকে। পাট, তুলা ও রেশম থেকে কাপড় তৈরির সুতা পাই। কাঠ, বাঁশ, খড়, শণ, গোলপাতা ইত্যাদি থেকে গৃহনির্মাণ সামগ্রী ও আসবাবপত্র পাই। বাঁশ, খড়, গবাদিপশুর বিষ্ঠা, গাছের ডালপালা ইত্যাদি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করি। কাঠ ও আখের ছোবড়া, বাঁশ ইত্যাদি থেকে কাগজ , পেন্সিল পাই। হোমিওপ্যাথিক ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ঔষধ তৈরির কাঁচামাল হলো কৃষিজাত পণ্য। সুতরাং বলা যায়, কৃষির মাধ্যমে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে।
২. কৃষিকে জাতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলা হয় কেন?
উত্তর: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির একক অবদান সবচেয়ে বেশি হওয়ায় কৃষিই জাতীয় উন্নয়নের মেরুদণ্ড। কৃষিতে নিয়োজিত জনশক্তি মোট শ্রমশক্তির ৪৫ ভাগ। খাদ্য, পুষ্টি নিরাপত্তা, কর্মের সংস্থান, শিল্পায়ন ও শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি দারিদ্র্য দূরীকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে আমাদের দেশের টেকসই উন্নয়নে কৃষির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই কৃষিকে জাতীয় উন্নয়নের মেরুদণ্ড বলা হয়।
৩. বাংলাদেশের জন্য মাঠ ফসল গুরুত্বপূর্ণ কেন? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: যে সকল ফসল বিস্তীর্ণ মাঠে, নিচু ও মাঝারি নিচু জমিতে বেড়াবিহীন অবস্থায় তুলনামূলক কম পরিচর্যার মাধ্যমে উৎপাদন করা হয় তাদেরকে মাঠ ফসল বলে। আমরা আমাদের খাদ্যের সিংহভাগ যেমন- চাল, ডাল, গম ইত্যাদি মাঠ ফসল হতে পাই। বস্ত্র তৈরির প্রধান কাঁচামাল পাট, তুলা, রেশম, তিসির আঁশ মাঠ ফসল থেকে আসে। এদেশের গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ ঘরই কাঁচা। গৃহ নির্মাণে ব্যবহৃত বাঁশ, খড়, শন, গোলপাতা ইত্যাদি কৃষিজ পণ্য মাঠ ফসল হতে আসে। শিক্ষার উপকরণ যেমন— কাগজ, পেন্সিল আসে বাঁশ, আঁখের ছোবড়া ও ধানের খড় হতে। মাঠ ফসলের উপজাত দ্রব্য খড় , গোখাদ্য, হাঁস - মুরগির খাদ্য ও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের জন্য মাঠ ফসল গুরুত্বপূর্ণ।
৪. টমেটো কেন উদ্যান ফসল? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: উদ্যান জাতীয় ফসল বাড়ির আশেপাশে বন্যামুক্ত উর্বর জমিতে বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যার মাধ্যমে চাষ করা হয়। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাঠে টমেটো চাষ করা হলেও স্বল্প পরিসরে বাড়ির আশেপাশেও চাষ করা হয়। সবজি জাতীয় ফসল উদ্যান ফসলের অন্তর্ভুক্ত। টমেটো সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। টমেটো চাষে ও পরিপক্ষের পর উত্তোলনের (Harvest) সময় বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয়, যা উদ্যান ফসলের বৈশিষ্ট্য। এ সকল কারণে টমেটোকে উদ্যান ফসলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
উত্তর: স্বল্প পরিসরে প্রতিটি উদ্ভিদের আলাদা যত্ন করার মাধ্যমে বাগানে যে ফসলের চাষ করা হয় তাকে উদ্যান ফসল বলে। ফুল, ফল, শাকসবজি ও মসলাজাতীয় ফসল উদ্যান ফসলের অন্তর্ভূক্ত সাধারণত বসতবাড়ি সংলগ্ন উঁচু জমিতে উদ্যান ফসলের আবাদ করা হয়। আমাদের দেশে উৎপাদিত মোট ফসলের প্রায় ৩০ শতাংশই আসে উদ্যান ফসল থেকে। উদ্যান ফসল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে, পুষ্টির চাহিদা পূরণে ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।
৬. উদ্যান ফসল শ্রমসাপেক্ষ হলেও লাভজনক কেন?
উত্তর: যে সকল ফসল উদ্যানে বেড়াযুক্ত অবস্থায় নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে উৎপাদন করা হয় তাদের উদ্যান ফসল বলে। সাধারণত বসতবাড়ির আশেপাশের উর্বর জমিতে স্বল্প পরিসরে এ ফসল চাষ করা হয়। এক্ষেত্রে প্রতিটি গাছের পরিচর্যা আলাদাভাবে করা হয় ও সার্বক্ষণিক যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। ফসল পরিপক্কতার সময় এক না হওয়াই ধাপে ধাপে সংগ্রহ করতে হয়। তবে গাছ হতে ফুল ও ফল দীর্ঘদিন পাওয়া যায় ও এ ফসল উৎপাদনে খরচ ও ঝুঁকি কম। তাই বলা হয় , উদ্যান ফসল শ্রমসাপেক্ষ হলেও লাভজনক।
৭. রেটুন ফসল চাষ লাভজনক কেন? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: ফসলের পরিপক্কতার সময় গোড়া থেকে নতুন চারা বা কুশি বের হওয়ার ফলে পুনরায় যে ফসল পাওয়া যায় তাকে মুড়ি (Ratoon) চাষ বলে। এ ধরনের চাষ পদ্ধতিতে বীজের প্রয়োজন হয় না। জমি তৈরি , বীজ বপন ইত্যাদি বাবদ শ্রমিক ও মূলধন খরচও কম লাগে। পরিপক্ব হতে মূল ফসলের চেয়ে ১-২ মাস সময় কম লাগে বলে বাড়তি ফসল পেয়ে কৃষক লাভবান হয়।
৮. সামাজিক বনায়ন বলতে কী বোঝ?
উত্তর: বসতবাড়ির আশেপাশে, রাস্তার পাশে, পতিত জমিতে রেললাইনের পাশে প্রতিষ্ঠানের আশেপাশেসহ বিভিন্ন সামাজিক এলাকায় যে বন গড়ে উঠে তাকে সামাজিক বন বলে। সামাজিক বনে বিভিন্ন ফলজ বৃক্ষ লাগানো হয়। সামাজিক বন থেকে মানুষ ফলের চাহিদা পূরণ করে, ভূমিক্ষয় রোধ করে, কুটির শিল্প তৈরির কাঁচামাল পায়, ঘরবাড়ি তৈরির কাঠ পায়, জ্বালানি কাঠ পায়। এছাড়াও সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। অতএব বলা যায়, সামাজিক বন জনগণের উপকার করে।
৯. সামাজিক বনায়ন কেন গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর: বনজ সম্পদ বৃদ্ধি ও সর্ব সাধারণের কল্যাণে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে এবং সরকারের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় সামাজিক এলাকায় (প্রান্তিক ও পতিত জমি) যে বনায়ন করা হয় তাকে সামাজিক বনায়ন বলে। ও জ্বালানি ও কাঠের মোট সরবরাহের সিংহভাগই আসে সামাজিক বন হতে বাংলাদেশের সর্বত্র ঔষধি গাছ লাগিয়ে অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। কাগজ কল, হার্ডবোর্ড মিল, পার্টিকেল বোর্ড মিল, দিয়াশলাই ফ্যাক্টরি, ফার্নিচার ফ্যাক্টরি প্রভৃতির কাঁচামাল সরবরাহে সামাজিক বনায়নের ভূমিকা অনন্য। এছাড়াও সামাজিক বনায়ন ভূমিক্ষয় রোধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। বেকার ও দুঃস্থ মহিলাদের কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধির সুযোগ করে দেয়। সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১০. গবেষণামূলক কাজে ইন্টারনেট প্রয়োজন কেন?
উত্তর: বিশ্বের অফুরন্ত জ্ঞান ভাণ্ডারের সময় আমানত হলো ইন্টারনেট। গবেষণামূলক কাজের জন্য বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত, পরিসংখ্যান ইত্যাদি সর্বপ্রকার তথ্যই ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। তাছাড়া একজন গবেষক তাঁর গবেষণার কাজে সাহায্যের জন্য বিভিন্ন পুস্তক ব্যবহার করেন। এসব পুস্তক পৃথিবীর যে প্রান্তের পাইব্রেরিতেই থাকুক না কেন, তা খুব সহজেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে ডাউনলোড করে পড়া যায়। এসব কারণেই গবেষণামূলক কাজে ইন্টারনেট প্রয়োজন।
১১. কৃষি তথ্য সেবায় মোবাইল ফোন কী কাজে লাগে, ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: কৃষি তথ্য ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মোবাইল ফোন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি। বর্তমানে কৃষি তথ্য সার্ভিস মোবাইল ফোন কোম্পানির সাথে সমঝোতা করে এসএমএস (SMS) এর মাধ্যমে কৃষি তথ্য সেবা চালু করেছে। ফলে স্বল্প সময়ে সারাদেশে মাঠপর্যায়ে কর্মরত কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং কৃষকের কাছে তথ্য পৌঁছে যাচ্ছে। কৃষি কল সেন্টারে কৃষি বিষয়ক যেকোনো প্রশ্ন করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে সরাসরি সমাধান পাওয়া যাচ্ছে। এভাবে মোবাইল ফোন সারাদেশে কৃষিতথ্য পৌঁছে দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
১২. অভিজ্ঞ কৃষককে স্থানীয় তথ্যভাণ্ডার বলা হয় কেন? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: অভিজ্ঞ কৃষক একজন স্থানীয় নেতা এবং পরামর্শদাতা। তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ ও নতুন নতুন কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন। এছাড়া তিনি গণমাধ্যম থেকেও অনেক তথ্য সংগ্রহ করেন। এভাবে তিনি নিজ কৃষিজ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করে এলাকার অন্য কৃষকদের কৃষি বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করেন। তাই অভিজ্ঞ কৃষককে স্থানীয় তথ্যভাণ্ডার বলা হয়।
১৩. এক্সেস টু ইনফরমেশন বলতে কী বোঝ?
উত্তর: এক্সেস টু ইনফরমেশন হলো মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে দূরশিক্ষা কার্যক্রম। ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রমের অধীনে এক্সেস টু ইনফরমেশন প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যালয় ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কম্পিউটার সামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে , যেগুলো স্থানীয়ভাবে কল সেন্টারের মতো কাজ করে যাচ্ছে। তাছাড়া সকল কৃষি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে, যাতে সর্বশেষ কৃষি প্রযুক্তির তথ্য উল্লেখ থাকে। যেমন: কৃষি তথ্য সার্ভিসের ওয়েব পেইজের ঠিকানা হলো www.ais.gov.bd. ফলে একজন কৃষক অনায়াসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কৃষি বিষয়ক প্রয়োজনীয় তথ্য আদান - প্রদান করতে পারছে।
উত্তর: এক্সেস টু ইনফরমেশন হলো মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে দূরশিক্ষা কার্যক্রম। ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রমের অধীনে এক্সেস টু ইনফরমেশন প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যালয় ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কম্পিউটার সামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে , যেগুলো স্থানীয়ভাবে কল সেন্টারের মতো কাজ করে যাচ্ছে। তাছাড়া সকল কৃষি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে, যাতে সর্বশেষ কৃষি প্রযুক্তির তথ্য উল্লেখ থাকে। যেমন: কৃষি তথ্য সার্ভিসের ওয়েব পেইজের ঠিকানা হলো www.ais.gov.bd. ফলে একজন কৃষক অনায়াসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কৃষি বিষয়ক প্রয়োজনীয় তথ্য আদান - প্রদান করতে পারছে।
১৪. কৃষি ডাইরি বলতে কী বোঝ?
উত্তর: কৃষি ডাইরি কৃষি তথ্য সার্ভিস কর্তৃক প্রকাশিত ডাইরি যেখানে আধুনিক কৃষি সংশ্লিষ্ট তথ্য - উপাত্তের উল্লেখ থাকে। বর্তমান গবেষণার ফলাফল ও আধুনিক কৃষির তথ্য উপাত্ত, যেমন বিভিন্ন ফসলের উন্নত জাত, বীজ, সারের মাত্রা, সেচ, বালাইনাশক, সর্বশেষ প্রযুক্তি, বিভিন্ন পরিসংখ্যান ইত্যাদি তথ্য এ ডাইরিতে পাওয়া যায়। এ ডাইরিতে কৃষি সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তর, অধিদপ্তর, সংস্থা, ব্যক্তি, সমিতি, সংগঠন ইত্যাদির ফোন / ফ্যাক্স নম্বর, ই - মেইল , ওয়েবসাইটসহ প্রয়োজনীয় যোগাযোগের ঠিকানা থাকে।
দ্বিতীয় অধ্যায়: ভূমি সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি
১. pH মান কত হলে মাটি ক্ষারীয় হয়? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: মাটিতে উপস্থিত হাইড্রোজেন আয়নের ঘনত্বের (গ্রাম / লিটার) ঋণাত্মক লগারিদমই হলো pH। ১ থেকে ১৪ সংখ্যা দ্বারা pH স্কেলে অম্লমান উল্লেখ করা হয়। কোনো মাটির অম্লমান ৭.০ এর উপরে উঠে গেলে তা মাটির ক্ষারত্ব প্রকাশ করে। অর্থাৎ, মৃত্তিকার OH আয়নের ঘনমাত্রা ১০ x ১০ গ্রাম / লিটারে বেশি থাকলে সে মাটিকে ক্ষারীয় মাটি বলা হয়। O আয়নের ঘনমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে pH এর মান বৃদ্ধি পেতে থাকে।
২ . মাটির ক্ষারত্ব সৃষ্টির লোনাজনিত কারণটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: মাটিতে হাইড্রোজেন আয়ন (H+) অপেক্ষা হাইড্রোক্সিল আয়ন (OH) বেশি থাকলে যে বিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তাকে মাটির ক্ষারত্ব বলে। সামুদ্রিক লোনা পানির প্লাবনে কোনো জমি নিয়মিত প্লাবিত হলে সে মাটির লবণাক্ততা বেড়ে যায়। লোনা পানিতে লবণ বেশি থাকে। অন্যদিকে সোডিয়াম আয়নের আধিক্য থাকে। ফলে মাটিতে ক্ষারত্ব সৃষ্টি হয়।
৩. মাটি সংশোধন কেন প্রয়োজন- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: যদি কোনো মাটিতে অম্লত্ব বা ক্ষারত্বের কারণে ফসলের উৎপাদন কমে যায় বা চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ে তা হলে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি ও তাকে চাষোপযোগী করে গড়ে তোলাকেই মাটি সংশোধন বলে। প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উভয় কারণে মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈব গুণাবলি নষ্ট হয়। বিভিন্ন কারণে মাটি দূষিত হয় এবং মাটিতে ক্ষতিকর জীবাণু দ্বারা বীজ, গাছের চারা ও গাছ আক্রান্ত হয়। মাটিবাহিত ক্ষতিকর ভাইরাস , ব্যাকটেরিয়া , ছত্রাকসহ বিভিন্ন জীবাণু গাছে রোগ সৃষ্টি করে এভাবে মাটির স্বাভাবিক গুণাবলি নষ্ট হলে গাছ জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে না। ফলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। এসব কারণে মাটি সংশোধন করা হয়ে থাকে।
৪. নিরপেক্ষ মাটি বলতে কী বোঝ?
উত্তর: কোনো মাটিতে হাইড্রোজেন আয়ন (H) ও হাইড্রোক্সিল আয়নের (OH) পরিমাণ সমান থাকলে তাকে নিরপেক্ষ মাটি বলে। নিরপেক্ষ বা প্রশম মাটির অম্লমান ৭। এই ধরনের মাটিতে সব ধরনের পুষ্টি উপাদান সহজলভ্য থাকে বিধায় ফসল চাষে সর্বাধিক উপযোগী নিরপেক্ষ মাটিতে জৈব পদার্থ সহজে বিয়োজিত হয়। এ মাটিতে বীজের অঙ্কুরোদগমও ভালো হয়।
৫. মাটির pH জানা প্রয়োজন কেন? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: মাটির pH হলো মাটিতে হাইড্রোজেন আয়নের ঘনত্বের ঋণাত্মক লগারিদম। এটি মাটির একটি রাসায়নিক ধর্ম যা ক্ষারত্ব ও অম্লত্ব নির্দেশ করে। সব মাটিতে সব ফসল ভালো হয় না। মাটির pH মানের ওপর কোন ফসল ভালো জন্মাবে তা নির্ভর করে। কোনো ফসল অম্লীয় মাটিতে ভালো জন্মে, যেমন- চা, কফি, লেবু ইত্যাদি। আবার কোনো ফসল ভারীয় মাটিতে ভালো জন্মে, যেমন— নারিকেল, সুপারি, আখ ইত্যাদি। তবে অধিকাংশ ফসলই নিরপেক্ষ মাটিতে ভালো জন্মে। তাই মাটির pH মান জেনে সেই অনুযায়ী ফসল চাষ করলে লাভবান হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায় । এ কারণেই মাটির pH জানা জরুরি।
৬. কম্পোস্ট সার বলতে কী বোঝ?
উত্তর: নানা প্রকার আবর্জনা, উদ্ভিদ যেমন- আগাছা, কচুরিপানা, কসাইখানা, আবর্জনা, ধানের তুষ, আখের ছোবড়া, রান্নাঘরের আবর্জনা এবং প্রাণিজাত পচনশীল উচ্ছিষ্টাংশ নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে পচিয়ে যে সার তৈরি করা হয় তাকে কম্পোস্ট সার বলা হয়।
i. পরিখা পদ্ধতি – পরিখা খনন করে আবর্জনা পচানো হয় এবং এভাবে কম্পোস্ট সার উৎপাদন করা হয়।
ii . পাকা কাঠামো পদ্ধতি- পাকা কাঠামো তৈরি করে আবর্জনা পচিয়ে কম্পোস্ট সার উৎপাদন করা হয়।
৭. নিবিড় চাষ পদ্ধতি বলতে কী বোঝ?
উত্তর: যে পদ্ধতিতে কোনো ফসলের একটি গোছায় একটি চারা এবং পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানো পদ্ধতিতে সেচ প্রদান করে অধিক ফলন পাওয়া যায় তাকে নিবিড় চাষ পদ্ধতি বলে। এই পদ্ধতিতে স্বল্প ব্যয়ে ও পরিশ্রমে এবং পরিচর্যার মাধ্যমে অধিক ফসল পাওয়া যায়। স্বল্প পরিমাণ মিথেন গ্যাস নির্গত হওয়ায় বায়ুদূষণ কম। স্বাভাবিকের তুলনায় ফসল ১০-১৫ দিন আগে পাকে। ফলে সেচ ও জ্বালানি সাশ্রয় হয়।
৮. অণুজীব সার পরিবেশবান্ধব কেন?
উত্তর: মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিসহ ফসলের পুষ্টি চাহিদা পূরণে অণুজীব সার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অণুজীব সার বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন মাটিতে আবদ্ধ করে উর্বরতা বাড়ায়। মাটিতে জৈব পদার্থ যুক্ত করে ফসলের ফলন (যেমন- গম ও ধানের ১৫-২৫%, মসুরের ১৫-৪০%, সয়াবিনের ৭৫-২০০%) ও গুণগত মান বৃদ্ধি করে। ডাল জাতীয় ফসলের দানায় আমিষের পরিমাণ ৫০-১০০% বৃদ্ধি পায়। জমিতে অণুজীব সার ব্যবহারে প্রায় ১০-৪০% রাসায়নিক সার কম লাগে। এ সার ব্যবহারে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না এবং উৎপাদিত ফসলেও কোনো ক্ষতিকারক উপাদান থাকে না। এ ধরনের সার জমিতে ব্যবহারের ফলে ফসলের খরা ও রোগ সহনশীলতা বাড়ে। এসকল কারণে অণুজীব সার পরিবেশবান্ধব।
৯. সবুজ সার বলতে কী বোঝ?
উত্তর: কোনো উদ্ভিদকে সবুজ অবস্থায় অর্থাৎ গাছে ফুল আসার আগে চাষ দিয়ে মাটির সাথে মেশানোর ফলে পচে যে সার উৎপন্ন হয় তাকে সবুজ সার বলে। সাধারণত লিগিউম জাতীয় গাছ যেমন- ডাল, শিম, শনপাট, ধৈজ্ঞা ইত্যাদি সবুজ সার প্রস্তুত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। জমিতে সবুজ সার ব্যবহার করলে রাসায়নিক সার প্রয়োগের পরিমাণ কমানো যায় । প্রধানত সবুজ সার ব্যবহারে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ে। ফলে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতাও বেড়ে যায়। এ সার অধিক পরিমাণ নাইট্রোজেন ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান মাটিতে সরবরাহ করে। এতে বেলে মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে ও মাটির অভ্যন্তরে বাতাস চলাচলে সুবিধা হয়। এছাড়াও সবুজ সার মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখে ও আগাছার উপদ্রব কম হয়।
১০. সবুজ সার হিসেবে ধৈঞ্চা উপযোগী কেন?
উত্তর : ধ্যৈা এক প্রকার লিগিউম জাতীয় শস্য যাদের শিকড়ে রাইজোবিয়াম নামক এক প্রকার ব্যাকটেরিয়া গুটি তৈরি করে তাতে বায়ুমণ্ডল হতে নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে। এসব গুটি পচে সঞ্চিত নাইট্রোজেন পরবর্তী ফসলকে পুষ্টি সরবরাহ করে। যা এঁটেল ও বেলে মাটির সাথে মিশালে মাটির বুনট ও সংযুতি পরিবর্তিত হয়ে দোআঁশে পরিণত হয়। ধৈজ্ঞা মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখে ও উর্বরতা বাড়ায়। এছাড়া এটি উৎপাদনে তেমন কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। তাই সবুজ সার হিসেবে ধৈয়া উপযোগী হয়।
১১. জৈব পদার্থকে “মাটির প্রাণ” বলা হয় কেন ? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: জৈব পদার্থ মাটির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা জীবজন্তুর মৃতদেহ, গাছপালা, লতাপাতা, প্রাণীর মলমূত্র প্রভৃতি পচে তৈরি হয়। আদর্শ মাটিতে ৫% জৈব পদার্থ থাকে। জৈব পদার্থ মাটিস্থ অণুজীবগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। ফলে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানসমূহ গাছের গ্রহণ উপযোগী হয়। তাছাড়া জৈব পদার্থ মাটির গঠন উন্নত করে, পানি ধারণ ও বায়ু চলাচল ক্ষমতা বাড়ায় এবং মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এসকল কারণে জৈব পদার্থকে “মাটির প্রাণ” বলা হয়।
১২. মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে কেঁচোর ভূমিকা ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে কেঁচোর ভূমিকা ব্যাপক । কেঁচো মাটিকে আলগা, ঝুরঝুরে, ফাঁপা ও নরম রাখে বলে মাটির গভীরে আলো - বাতাস ও পানি সহজে প্রবেশ করতে পারে। কেঁচোর বিষ্ঠায় বহুবিধ রাসায়নিক পদার্থ, উৎসেচক, নাইট্রোজেন আবদ্ধকারী নাইট্রিফাইং ও অ্যামোনিফাইং ব্যাকটেরিয়াসহ অনেক ধরনের জীবাণু ও উদ্ভিদ বৃদ্ধির সহায়ক ইনডোল যৌগ উপস্থিত থাকে। ফলে মাটিতে জৈব পদার্থ যুক্ত হয়, পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে এবং মাটি উর্বর হয়।
তৃতীয় অধ্যায়: বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি
১. বীজ শোধন করা হয় কেন? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: বীজ বপনের পূর্বে ছত্রাকনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করাকে বীজ শোধন বলে। বপনকৃত বীজ ও উৎপন্ন চারাকে রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য বীজ শোধন করা প্রয়োজন। তাছাড়া যেসব ফসলের বীজত্বক শক্ত, সেসব ফসলের বীজের সুপ্তাবস্থা (Dormancy) ভাঙার জন্য বীজ শোধন করে নিলে নির্ধারিত সময়ে অঙ্কুরোদগম ঘটে। অর্থাৎ, সুস্থ সবল চারা উৎপাদন, বীজবাহিত রোগ প্রতিরোধ, অঙ্কুরোদগম হার বৃদ্ধি ও ভালো ফলন পাওয়ার জন্য বীজ শোধন করা হয়।
২. সঠিক বীজ নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ কেন?
উত্তর: ফসল উৎপাদনের মৌলিক উপাদান হলো বীজ। বীজ যদি দুর্বল ও রোগাক্রান্ত হয় তাহলে চারাও দুর্বল ও রোগাক্রান্ত হবে। সঠিক বীজ নির্বাচনে ভালো ফলন পাওয়া যায়। শুধু ভালো বীজ ব্যবহারে ফসলের ফলন ১৫-২০ % বৃদ্ধি পায়। তাই চাষাবাদের ক্ষেত্রে ভালো ফলন ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সঠিক বীজ নির্বাচন করা গুরুত্বপূর্ণ।
৩. প্রজনন বীজ বা মৌল বীজ বলতে কী বোঝ?
উত্তর: অনুমোদিত বীজ উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে প্রজনন বীজ। অভিজ্ঞ উদ্ভিদ প্রজননবিদদের সরাসরি ও ঘনিষ্ঠ তত্ত্বাবধানের পর পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে গবেষণাগারে উদ্ভাবিত সর্বাধিক বংশগত বিশুদ্ধতাসম্পন্ন বীজকে প্রজনন বীজ বলে। এরূপ বীজে ভিন্ন প্রজাতি বা ভিন্নজাতের কোনো সংমিশ্রণ থাকবে না। প্রজনন বীজ সংখ্যায় খুব অল্প পরিমাণে উৎপন্ন হয় বলে তা অত্যন্ত মূল্যবান বীজ। এ বীজ থেকেই পরবর্তীকালে ভিত্তি বীজ বা অন্যান্য কৃষিবীজ উৎপন্ন করা হয় বলে একে মৌল বীজও বলে।
৪. ভালো বীজ উৎপাদনে রোগিং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর: বীজ ফসলের জমি থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত গাছ তুলে ফেলাকে রোগিং বলে। বীজের মৌলিক বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য রোগিং করা দরকার। কারণ অন্য জাতের ফুলের সাথে পরাগায়িত হয়ে নির্বাচিত জাতের বীজের বংশগত বিশুদ্ধতা নষ্ট হতে পারে। রোগিং এর মাধ্যমে উন্নত গুণসম্পন্ন বীজ উৎপাদন সম্ভব হয়। এমনকি বীজের রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও কমে। ফলে উৎপাদিত বীজের বাজারমূল্য বেশি থাকে। তাই ভালো বীজ উৎপাদনে রোগিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৫. বীজ ফসলের জমি নিরাপদ দূরত্বে রাখা হয় কেন?
উত্তর: একই ফসলের বিভিন্ন জাতের মধ্যে পরাগায়ন হয়ে জাতের বিশুদ্ধতা যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য বীজ ফসলের জমির নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। বীজ ফসলের জমি থেকে একই ফসলের বীজ বপনের সময় পরিবর্তন করেও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা যায়। যেমন- পেঁয়াজের বীজের জমি ভিত্তি বীজ হলে ৭৫ মিটার এবং প্রত্যায়িত বীজ হলে ৭০ মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হয়।
৬. হাম পুলিং বলতে কী বোঝ?
উত্তর: মাটির উপরে গাছের সম্পূর্ণ অংশ উপড়ে ফেলাকে হাম পুলিং বলে। আলু সংগ্রহের ৭-১০ দিন পূর্বে হাম পুলিং করা হয়। বীজ আলুতে অবশ্যই হাম পুলিং করতে হয়। এতে আলুর ত্বক শক্ত হয়, রোগের বিস্তার কম হয় এবং এর সংরক্ষণ গুণ বৃদ্ধি পায়। খাবারের আলুতে এ প্রক্রিয়া করলে ভালো তবে করা জরুরি নয়।
৭. বায়োফার্টিলাইজার বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: যে সকল জৈবিক দ্রব্য মাটিতে প্রয়োগ করার পর তা মাটির জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে মাটির উর্বরতা সংরক্ষণ এবং উদ্ভিদকে পুষ্টি দ্রব্য সরবরাহের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করে সে সকল দ্রব্যকে বায়োফার্টিলাইজার বা বায়োসার বলে। যেমন— Rhizobium , Azotobacter Trichoderma ইত্যাদি। এগুলো প্রয়োগের ফলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় এবং ফসলের উৎপাদনও বাড়ে।
৮ . রাইজোবিয়াম কেন অণুজীব সার, ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী রাইজোবিয়াম সার ইউরিয়ার বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই সার উৎপাদনে রাইজোবিয়াম নামক ক্ষুদ্র অণুজীব বা ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয়। এই ব্যাকটেরিয়া শিমজাতীয় উদ্ভিদের শিকড়ে নডিউল সৃষ্টি করে। নডিউলের ভিতরে ব্যাকটেরিয়া বায়ুমণ্ডল থেকে নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে নিজের প্রয়োজন মেটায় এবং সহঅবস্থানকারী উদ্ভিদকেও সরবরাহ করে। রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়া এক প্রকার অণুজীব বলেই এর দ্বারা তৈরিকৃত সারকে অণুজীব সার বলা হয়।
৯ . এ্যাজোলা সার বলতে কী বোঝ?
উত্তর: এ্যাজোলা একটি ফার্নজাতীয় ক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদ। এর পাতার গহ্বরে Anabaena নামক নীলাভ - সবুজ শেওলার একটি প্রজাতি বাস করে যা হেটেরোসিস্ট কোষের মাধ্যমে বায়ুমন্ডলীয় নাইট্রোজেন নিজেদের দেহে আবদ্ধ করতে পারে। এ্যাজোলা উন্নতমানের জৈব সার যা শস্যের ফলন বৃদ্ধিতে নাইট্রোজেনের উৎস এবং ইউরিয়ার বিকল্প হিসেবে কাজ করে। এ্যাজোলার একটি পুরু স্তর প্রতি হেক্টর জমিতে ৩০-৪০ কেজি নাইট্রোজেন সরবরাহে সক্ষম। রোপা আমন ধানে এ্যাজোলা ব্যবহার করে ২০-২৫ ভাগ ফলন বাড়ানো যায়। পরপর ২/৩ বার এ্যাজোলা উৎপাদন করে জমিতে মেশাতে পারলে ইউরিয়া ছাড়াই ফসলের ভালো ফলন পাওয়া যায়।
১০. ট্রাইকোডার্যাকে বায়োপেস্টিসাইড বলা হয় কেন?
উত্তর: ট্রাইকোডারমা এক প্রকার ছত্রাক। জৈব সার হিসেবে এটির উৎপাদন ও ব্যবহার বেড়েই চলেছে। ট্রাইকোডার্মা মাটির অম্লত্ব, লবণাক্ততা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে মাটির গঠন ও বুনট উন্নত করে। ট্রাইকোডার্মা দিয়ে বীজ শোধন করা হলে অনেক রোগের আক্রমণ কমে যায়। এটি মাটিতে বসবাসকারী কিছু ক্ষতিকর অণুজীব খেয়ে ফেলে। ফলে এসব অণুজীবের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিবেশ রক্ষা পায়। ট্রাইকোডার্মার কোনো বিষক্রিয়া নেই। এ সকল কারণে ট্রাইকোডার্মাকে বায়োপেস্টিসাইড বলে।
১১. পাটের রিবন রেটিং কেন করা হয়?
উত্তর: পাটের রিবন রেটিং হলো বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত পাটের ছাল পচনের একটি বিকল্প পদ্ধতি। আমাদের দেশে ভাদ্র - আশ্বিন মাসে খাল - বিলে পাট পচানোর মতো যথেষ্ট পানি থাকে না। সেক্ষেত্রে রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট গাছ কাটার পর কাঁচা থাকা অবস্থায় গাছ থেকে ফিতার মতো ছালকে পৃথক করে পচানোর ব্যবস্থা করা হয়। পাট উৎপাদনকারী এলাকায় পচন পানির অভাব থাকলে উৎপাদিত পাটের আঁশ খুব নিম্নমানের হয়ে থাকে, ফলে পাট বিক্রি করে ভালো মূল্য পাওয়া যায় না। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে স্বল্প পানি ও অল্প জায়গার মধ্যে সহজেই আঁশ পাওয়া সম্ভব। এছাড়াও আঁশে কাটিংস হয় না বলে উন্নত আঁশ পাওয়া যায়।
১২. রেশম চাষের প্রয়োজন কেন? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: পোকা, গাছ, মাটি ও পরিবেশের সমন্বয়ে রেশম চাষের কার্যক্রম সফলতা লাভ করে বলে এটি বর্তমানে কৃষি খাতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে। রেশম চাষের প্রয়োজনীয়তা হলো-
i. রেশম কাপড়ের চাহিদা অনেক বেশি।
ii. বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
iii. বেকারত্ব দূর হয় ও স্বল্প পুঁজির ব্যবসা।
iv. উৎপাদন ঝুঁকি কম।
১৩. কোকুন বলতে কী বোঝ ?
উত্তর: রেশম পোকার শূককীট অবস্থা শেষ হওয়ার সাথে শূককীট তার মুখে সৃষ্ট লালা দিয়ে কীড়া জালিকা তৈরি করে জালিকার ভিতরে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। জালিকা স্তরে স্তরে জমা হয়ে পুরু হয় এবং শূককীট ভিতরে সম্পূর্ণ আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই অবস্থাকেই কোকুন বলে। গুটির মধ্যে পিউপা প্রায় নিশ্চল অবস্থায় থাকে। এ অবস্থায় দেহ স্বচ্ছ, মাথা ছোট ও সরু হয়। খাওয়া বন্ধ করে মাথা নাড়ে। মল নরম ও সবুজ হয়।
১৪. মাশরুম চাষঘরে অক্সিজেনের উপস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ কেন?
উত্তর: অক্সিজেনের উপস্থিতিতে মাশরুম বিভিন্ন এনজাইমের সহায়তায় জারণ - বিজারণ প্রক্রিয়ায় কাঠের গুঁড়া ভেঙ্গে বিভিন্ন খাদ্য উপাদান বের করে আনে যা মাইসেলিয়াম খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। মাশরুমের ফুটিং বডি উৎপাদনের সময় প্রচুর পরিমাণ খাদ্যের প্রয়োজন হয়। অক্সিজেন না পেলে খাদ্য গ্রহণ সম্ভব হয় না। তাই চাষ ঘরে অক্সিজেনের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ।
১৫. মাশরুম চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: মাশরুম চাষ একটি অধিক লাভজনক পেশা ও ব্যবসা। এতে পুঁজি কম প্রয়োজন এবং অতিরিক্ত কোনো আবাদি জমির প্রয়োজন হয় না। চাষ শেষে প্যাকেট জৈব সার হিসেবে জমিতে ব্যবহার ও বিক্রি করা যায়। মাশরুম চাষের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। কম খরচে ও কম শ্রমে মাশরুম চাষের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ আমিষ উৎপাদন সম্ভব। সর্বোপরি, বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে যেখানে প্রতিনিয়ত চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে অথচ খাদ্য চাহিদা বাড়ছে সেখানে ঘরের মধ্যে মাশরুমের মতো একটি মূল্যবান সবজি চাষ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১৬. মৌচাকে রাণী মৌমাছি কেন গুরুত্বপূর্ণ? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: মৌচাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রাণী মৌমাছি। মৌচাকের মধ্যে একমাত্র রাণী মৌমাছিই ডিম পাড়ে এবং একবার মাত্র প্রজননের পর প্রায় সারা বছরই ডিম দিয়ে থাকে রাণী মৌমাছি প্রতিদিন গড়ে ৩০০০ টি ডিম দিতে পারে। রাণীর শরীর থেকে ফেরোমেন নামক বস্তুর গন্ধ বের হয় বলে অন্যান্য মৌমাছি রাণীকে ঘিরে থাকে এবং কলোনি ত্যাগ করে অন্য কলোনিতে যায় না। নিষেককৃত ডিম থেকে রাণী ও কর্মী মৌমাছি এবং অনিষেককৃত ডিম থেকে পুরুষ মৌমাছি সৃষ্টি হয়। এভাবে ডিম পাড়া ও বাচ্চা উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার জন্য মৌচাকে রাণী মৌমাছি গুরুত্বপূর্ণ।
১৭. কর্মী বা শ্রমিক মৌমাছি বলতে কী বোঝ?
উত্তর: কর্মী মৌমাছি আকারে পুরুষ মৌমাছির চেয়ে ছোট, গায়ের রং হালকা হলুদ রানী ও পুরুষ বাদে অবশিষ্ট সব সদস্যই শ্রমিক বা কর্মী মৌমাছি। একটি মৌচাকে সাধারণত ১০,০০০-৩০,০০০ কর্মী মৌমাছি থাকে। এরা বন্ধ্যা মৌমাছি। এরা মধু অনুসন্ধান, মধু সংগ্রহ, মৌচাক তৈরি, মৌচাক রক্ষা ও ব্যবস্থাপনা, রানীর পরিচর্যা, বাচ্চাদের লালন - পালন ইত্যাদি কাজ করে থাকে। এছাড়াও রয়েল জেলি নিঃসরণ, বাচ্চাদের খাওয়ানো, মোম নিঃসরণ, নেকটার বাষ্পায়ন, চাক শীতলীকরণ ও বায়ু চলাচলের সুব্যবস্থাকরণ ইত্যাদি কাজ করে থাকে। প্রশ্ন -
১৮. "মধু সর্বরোগের মহৌষধ" - ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: মধু দেহের সুস্থতা ও সজীবতা রক্ষা করে রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। মধুতে রয়েছে ভিটামিন যা মানুষের বেরিবেরি, পেলেগ্রা প্রভৃতি মারাত্মক রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম। তাছাড়াও এর ফরমিক অ্যাসিড, অ্যাসিটিক অ্যাসিড, সাইট্রিক অ্যাসিড ও ল্যাকটিক অ্যাসিড মানবদেহের রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। আয়ুর্বেদীয় এবং ইউনানী বহু ঔষধ তৈরিতে মধু ব্যবহার করা হয়ে থাকে। শ্বাসকষ্ট, রক্ত পরিশোধক, ঠাণ্ডা, সর্দি - কাশি প্রতিরোধ , জ্বর নিরাময়, ক্ষত বা জিহ্বার, গলার এবং আগুনে পোড়া ঘা দূর করার জন্য মধু ব্যবহৃত হয়। গ্যাস্ট্রিক বা আলসারে আক্রান্ত রোগীর জন্যও নিয়মিতভাবে মধু সেবন সুফলদায়ক। বুক ও পেটের ব্যাথা উপশমে মধু উপকারী। প্রায় সব ধরনের রোগ প্রতিরোধে সক্ষম বলে মধুকে সর্বরোগের মহৌষধ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
১৯. মৌমাছির চাষ লাভজনক কেন?
উত্তর: স্বল্প বিনিয়োগে ও ফসলের ক্ষেতে মৌমাছি চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব। অল্প খরচে মধু উৎপাদন করে অনেক বেশি দামে বিক্রি করা যায়। আয়ুর্বেদী ও ইউনানী পদ্ধতিতে তৈরি বহু ঔষধে মধু ব্যবহৃত হয়। দেহে পুষ্টি সরবরাহের পাশাপাশি মধু বর্তমানে ক্যান্সার রোগের চিকিৎসায়ও ব্যবহৃত হয়। মৌমাছি ফুলে ফুলে ঘুরে পরাগায়ন ঘটায় বলে সরিষার ফলন ২০-৩০ % বৃদ্ধি পায়। আবার , সরিষা থেকে মধু সংগ্রহ করে একই সাথে দ্বিগুণ লাভ হয়। মাত্র একবার ১৫-১৬ হাজার টাকা ব্যয় করে মৌমাছির প্রকল্প স্থাপন করলে তা ১০-১৫ বছর ব্যবহার করা যায়। সর্বোপরি, মৌচাষ করে দেশের মানুষের দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। তাই মৌমাছির চাষ লাভজনক।
পঞ্চম অধ্যায়: মাঠ ও উদ্যান ফসল উৎপাদন
১. সকল উফশী ধান আধুনিক ধান নয় কেন?
উত্তর: যে ধান গাছের সার গ্রহণ করার ক্ষমতা অধিক এবং ফলন বেশি হয় তাকে উফশী ধান বলে।
উফশী জাতের ধানের গাছ খাটো, মজবুত ও পাতা খাড়া হয়। ধান পেকে গেলেও গাছ সবুজ থাকে। উফশী ধানে যখন প্রয়োজনীয় বিশেষ গুণাগুণ যেমন- রোগবালাই সহনশীলতা, স্বল্প জীবনকাল, চিকন চাল, খরা, লবণাত্ততা ও জলমগ্নতা সহিষ্ণু ইত্যাদি সংযোজিত হয় তখন তাকে আধুনিক ধান বলে। অর্থাৎ, সকল আধুনিক ধানে উশী গুণ বিদ্যমান থাকে কিন্তু সকল উফশী ধান আধুনিক ধান নয়।
২. ভাসমান বীজতলা বলতে কী বোঝ?
উত্তর: বন্যার সময় বীজতলা তৈরির উপযোগী জমি না পাওয়া গেলে ভাসমান বীজতলা করা হয়। কলাগাছ বা বাঁশের ফ্রেমের উপর চাটাই দিয়ে খড়কুটা বা কলাগাছের পাতা তার উপর বিছিয়ে দিতে হয়। এরপর ২-৩ সেমি পুরু করে কাদা মাটি তার উপর প্রলেপ দিয়ে বীজতলা বানাতে হয়। এটি ভেলার ন্যায় ভাসতে থাকে। আর গজানো বীজ কাদার উপর ঘন করে ছিটিয়ে দিতে হবে। এ চারা ৩-৪ সপ্তাহ পর্যন্ত বীজতলায় রাখা যায়।
৩. আখকে শিল্প ফসল বলা হয় কেন?
উত্তর: আখ হচ্ছে চিনি ও গুড় উৎপাদনের প্রধান উৎস। আখের পাতা ও ছোবড়া দিয়ে কাগজ, বোর্ড, জ্বালানি ও কৃত্রিম রেশম তৈরি করা যায়। উপরন্তু আখের ছোবড়া ও পাতা বিভিন্ন কারখানায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এসব দিক বিবেচনা করে আখকে শিল্প ফসল বলা হয়।
৪. রেটুন চাষে খরচ কম হয় কেন?
উত্তর: প্রথমবার আখ কাটার পর আখের গোড়া থেকে পুনরায় কুশি বের হওয়ার সুযোগ দিয়ে আখ চাষ করাই হলো আখের রেটুন চাষ। রেটুন চাষ যেহেতু প্রথমবার আখ কাটার পর ঐ আখের গোড়া থেকে করা হয় তাই এক্ষেত্রে জমি চাষ ও বীজ বপনের প্রয়োজন হয় না। ফলে এ চাষে জমি চাষ ও বীজের জন্য যে খরচ হয় সেটি লাগে না। তাই রেটুন চাষে কম খরচ লাগে।
৫. পাট ফসল গুরুত্বপূর্ণ কেন?
উত্তর: পাট উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার ফসল। এছাড়াও এটি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রধান আঁশজাতীয় ফসল। পাটকাঠি জ্বালানি হিসেবে, ঘরবাড়ি তৈরিতে, ক্ষেতে বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। পাটকাঠি দিয়ে উন্নতমানের কাগজ, হার্ডবোর্ড ও চট তৈরি করা হয়। পাটের কচি পাতা শাক হিসেবে খাওয়া হয়। পাটের পাতা মাটিতে পচে প্রচুর জৈব পদার্থ সৃষ্টি করে তাই পার্টের জমিতে ধানের ফলন ভালো হয়। তাই পাট গুরুত্বপূর্ণ।
৬. পাটের জাগে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা হয় কেন?
উত্তর: পাটের জাগ দেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য হলো পাট পচানো যাতে সহজেই পাটের আঁশ ছাড়ানো যায়। ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা হলে পার্টের পচন ত্বরান্বিত হয়। প্রতি ১০০০ কেজি কাঁচা ছালের জন্য প্রায় ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ব্যবহার করতে হয়। এ কারণেই পাটের জাগে ইউরিয়া সার ছিটাতে হয়।
৭. বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: মাঠ থেকে সংগৃহীত বা প্রক্রিয়াজাতকৃত বীজ বপনের পূর্ব পর্যন্ত গুদামজাত করে রাখাকে বীজ সংরক্ষণ বলে। বীজ উৎপাদনের পর সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হলে বীজের গুণাগুণ ভালো থাকে। বীজ সংরক্ষণের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। যেমন, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই বীজ সংরক্ষণ, আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বীজ সংরক্ষণ এবং তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে হিমাগারে বীজ সংরক্ষণ। সাধারণত প্রথম ২ টি উপায়ে মাঠ ফসলের বীজ ও শেষোক্ত উপায়ে উদ্যান ফসলের বীজ সংরক্ষণ করা হয়।
৮ . "ফল চাষ লাভজনক" - ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া ফল চাষের জন্য উপযোগী। মাঠ ফসলের তুলনায় ফল চাষের উৎপাদন খরচ কম কিন্তু দাম বেশি ফলে লাভ বেশি হয়। সাধারণত ১ হেক্টর জমিতে দানা জাতীয় ফসল চাষ করে বছরে লাভ ৩০-৩৫ হাজার টাকা, সেখানে ফল চাষ করে একই সময়ে ১.৫-২ লাখ টাকা লাভ করা সম্ভব। অন্যান্য ফসল রোগবালাই ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, কিন্তু ফল গাছে এসব ঝুঁকি নেই। প্রজাতিভেদে বিভিন্ন প্রকার ফল গাছ ৫ থেকে ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত ফলন দেয়। ফলে একবার গাছ লাগিয়ে দীর্ঘমেয়াদী ফলন পাওয়া যায়। এছাড়া ফল দিয়ে তৈরি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বাজার চাহিদা বেশি। তাই বলা যায়, ফল চাষ লাভজনক।
৯. কুল গাছে প্রুনিং করা হয় কেন?
উত্তর : গাছের যথাযথ বৃদ্ধি ও অধিক ফল ধারণের জন্য কুল গাছে প্রুনিং করা হয়। প্রথম বছর গাছের কাঠামো মজবুত করার লক্ষ্যে গোড়া থেকে ৭৫ সেমি উচ্চতা পর্যন্ত প্রুনিং করা হয়। ছাঁটাইকৃত গাছে প্রচুর পরিমাণে নতুন কুশি বের হয়। ফুল আসার আগে দুর্বল, ভাঙা, রোগাক্রান্ত ডালগুলো হালকা করে এবং ফল সংগ্রহের পর সব ডাল ভারীভাবে প্রুনিং করতে হয়। কুল গাছে সাধারণত নতুন গজানো প্রশাখায় ফুল ধরে যা পরবর্তীতে অধিক ফল উৎপাদন করে। এসকল কারণে প্রুনিং করা হয়।
১০. কমলা চাষ লাভজনক ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া কমলা চাষের জন্য উপযোগী। কমলায় সব ধরনের পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকায় রোগীর পথ্য ও রুচি বর্ধনকারী হিসেবে জনপ্রিয়। একটি কমলা গাছ ৫ বছর থেকে প্রায় ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত ফলন দেয়। আবার একটি গাছ প্রতি বছরে ৩০০-৫০০টি কমলা ধারণ করে। প্রতিটি কমলার বাজারমূল্য ১৫ টাকা হিসেবে এক বছরে একটি গাছ থেকে ৪,৫০০-৭,৫০০ টাকা আয় করা সম্ভব। যে সময়ে বাংলাদেশের বাজারে দেশীয় ফলের স্বল্পতা থাকে সেটিই তখন কমলা সংগ্রহের সময়। তাই এদের বাজারে চাহিদাও বেশি। তাই বলা যায়, কমলা চাষ লাভজনক।
ষষ্ঠ অধ্যায়: ফল ও শাকসবজি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ
১. শাকসবজি নষ্ট হয়ে যায় কেন?
উত্তর: শাকসবজি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণগুলো হলো-
i. শাকসবজির মেটাবলিক পরিবর্তন যেমন- শ্বসনে ইথিলিনের উৎপত্তি ও উপাদানগত পরিবর্তন।
ii. শাকসবজি সংগ্রহের পর জলীয় অংশ কমে যাওয়া।
iii. অভ্যন্তরীণ বিপর্যয়।
iv. তোলার সময় বা পরে অঘাতজনিত ক্ষত।
V. রোগজীবাণুর আক্রমণ।
২. ফল পচে কেন?
উত্তর: বিভিন্ন ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক ক্রিয়ার ফলে খাদ্যদ্রব্য গ্রহণের অনুপযোগী হয়ে যাওয়াই হলো পচন। জীবাণুর প্রবেশ ও বংশবিস্তার এবং খাদ্যদ্রব্যে জলীয়কণার পরিমাণ, আলো, তাপমাত্রা, অক্সিজেনের ভারসাম্যহীনতা প্রভৃতি কারণে ফল পচে যায়। ফলের ভেতরে পানি থাকে অণুজীব অভ্যন্তরীন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে পচায়। আবার তাপমাত্রার বৃদ্ধিতে , অক্সিজেনের উপস্থিতিতে শ্বসন প্রক্রিয়া দ্রুত হয়ে ফল পচে। অধিক তাপ ও আঘাতে ক্ষতের সৃষ্টি হলে ইথিলিনের উৎপাদন বেড়ে ফলের পচনকে ত্বরান্বিত করে।
৩. ফল সংরক্ষণের প্রয়োজন কেন?
উত্তর: ফল জাতীয় খাদ্যদ্রব্যের প্রকৃতিগত ও গুণগত পরিবর্তন না ঘটিয়ে ব্যবহার উপযোগী করে রাখার বিশেষ পদ্ধতিই হলো ফল সংরক্ষণ। ফল সংরক্ষণের মাধ্যমে অমৌসুমে ফলের চাহিদা পূরণ করা যায়। ফলে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ। সংরক্ষিত ফল দিয়ে সারা বছরের সব ধরনের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা যায়। বাংলাদেশে মৌসুমের সময় উৎপাদিত ফলের উল্লেখযোগ্য অংশ নষ্ট হয়। অথচ সেগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হলে তা খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা দিতে সক্ষম। বর্তমানে বেকার জনগোষ্ঠী সংরক্ষণ শিল্পের সাথে যুক্ত হয়ে কর্মসংস্থানের সংকট দূর করতে পারে। এছাড়াও সংরক্ষিত ফল বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। শিল্পের কাঁচামালের সরবরাহ বাড়ানোর জন্যও ফল সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
৪. আমাদের নিয়মিত শাকসবজি খাওয়া উচিত কেন?
উত্তর: শাকসবজিতে সহজপাচ্য শর্করা, আমিষ, স্নেহজাতীয় খাদ্য উপাদান ও প্রচুর ভিটামিন রয়েছে। এসব খাদ্য শরীর গঠন ও রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
কোনো কোনো শাকসবজি যেমন- লাউ, কচু, সজিনা, পালংশাক, পুঁইশাক এবং লালশাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন 'এ' রয়েছে। ভিটামিন 'এ' এর অভাবে রাতকানাসহ চোখের নানাবিধ রোগ হয়। গাঢ় সবুজ ও লাল রংয়ের শাকসবজিতে রয়েছে প্রচুর আয়রন ও ক্যালসিয়াম। কাঁচা মরিচে আছে প্রচুর ভিটামিন 'সি'। ভিটামিন 'সি' খেলে দাঁতের মাড়ি ভালো থাকে। ভিটামিন 'সি' সর্দি - কাশি থেকেও শরীরকে রক্ষা করে। ভিটামিন - বি আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। মটরশুঁটি, বরবটি ও শিমে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ও আমিষ জাতীয় খাদ্য থাকে, যা আমাদের শরীরের বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরণ করে। নিয়মিত শাকসবজি খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হয় না। এছাড়া শাকসবজি হৃদরোগ , বহুমূত্র , চর্মরোগ ইত্যাদি রোগের প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। এসকল কারণে আমাদের নিয়মিত শাকসবজি খাওয়া উচিত।
৫. শরীর গঠনে শাকসবজি গুরুত্বপূর্ণ কেন?
উত্তর: শাকসবজি শরীর গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেননা শাকসবজিতে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন আছে। ভিটামিন - বি আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। মটরশুঁটি, বরবটি ও শিমে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ও আমিষ জাতীয় খাদ্য থাকে, যা আমাদের শরীরের বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরণ করে। নিয়মিত শাকসবজি খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। এছাড়া শাকসবজি হৃদরোগ, চর্মরোগ ইত্যাদি রোগের প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।
৬. সবজিতে কিউরিং করা হয় কেন?
উত্তর : ফেটে যাওয়া বা আঘাতপ্রাপ্ত কন্দজাতীয় মশলা ও সবজির ক্ষত স্থান শুকিয়ে রোগমুক্ত করাকে কিউরিং বলে। শাকসবজি জমি থেকে সংগ্রহ করার সময় কমবেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এসব ক্ষতস্থান থেকে পানি বেরিয়ে বা জীবাণু প্রবেশ করে শাকসবজি পচে যেতে পারে। তাই ফসল সংগ্রহের পর বাতাস চলাচল করতে পারে (আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৮৫%) এমন স্থানে ২০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় দু-তিন দিন রেখে কিউরিং করলে শাকসবজির ক্ষতস্থান সেরে উঠে এবং সংরক্ষণকাল বেড়ে যায়।
৭. ব্লাঞ্চিং বলতে কী বোঝ?
উত্তর: ফল কিংবা শাকসবজি সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে প্রথমে সেগুলো কেটে ২-৫ মিনিট ফুটন্ত পানিতে ডুবিয়ে ও পরে পানি ঝরিয়ে হিমায়িত করা হয়, একে ব্লাঞ্চিং বলে। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে ফল কিংবা শাকসবজির এনজাইম নিষ্ক্রিয় করা হয়। এতে ফল / সবজির টিস্যুর ভেতরে থাকা বাতাস, অনাকাঙ্ক্ষিত স্বাদ এবং গন্ধ অপসারিত হয়। উত্তপ্ত ফুটন্ত পানিতে ডুবানো অথবা সরাসরি বাষ্প ইনজেকশন এ দুটি পদ্ধতিতে ব্লাঞ্চিং করা যায়।
৮. অ্যাসেপসিস বলতে কী বোঝ ?
উত্তর: অ্যাসেপসিস হলো ফল ও শাকসবজিকে জীবাণুমুক্ত করে সংরক্ষণ করা।
ফল ও শাকসবজি পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করলে তা থেকে বহুল পরিমাণে অপদ্রব্য জীবাণু অপসারিত হয়। কাজেই বেশ কিছু সময়ের জন্য এগুলো ভালো থাকে। এভাবে জীবাণু থেকে ফল ও শাকসবজিকে দূরে সরিয়ে রেখে সংরক্ষণ করার যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তাকে অ্যাসেপসিস বলে।
৯. ফল ও শাকসবজি সংরক্ষণে গ্রেচিং করা জরুরি কেন? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: প্রাথমিকভাবে বাছাই করার পর ফল ও শাকসবজির আকার, আকৃতি, রং পক্কতা, আঘাতজনিত ক্ষত ইত্যাদি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে ভাগ করাকে গ্রেডিং বলে। ফল ও শাকসবজি দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য গ্রেডিং করা আবশ্যক। গ্রেডিং করে পচা, রোগাক্রান্ত ফল ও শাকসবজি বাছাই করে তা বাদ দেওয়া হয়, ফলে অন্য ফল ও শাকসবজির পচন রোধ হয়। পরতার ওপর ভিত্তি করে অধিক পাকা, কম পাকা ও কাঁচা ফলমূল আলাদা করে নিলে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের পক্ষেই সঠিক মূল্য নির্ধারণে সুবিধা হয় এবং উভয়েই লাভবান হয়।
১০. ফল গ্রেডিং করা হয় কেন?
উত্তর : প্রাথমিকভাবে বাছাই করার পর ফলের আকার, আকৃতি, রং, পক্বতা, আঘাতজনিত ক্ষত ইত্যাদি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে ভাগ করাকে গ্রেডিং বলে। ফল দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য গ্রেডিং করা আবশ্যক। এর ফলে পচা, রোগাক্রান্ত ফল বাছাই করে তা বাদ দেওয়া হয়। এরপর তাদের পরুতার ওপর ভিত্তি করে ভাগ করার ফলে অধিক পাকা , কম পাকা ও কাঁচা ফলমূল আলাদা করা হয়, যা পচন রোধে সাহায্য করে। অর্থাৎ, সংরক্ষণের পূর্বশর্ত হলো গ্রেডিং।
১১. ওয়াক্সিং বলতে কী বোঝ?
উত্তর: ওয়াক্সিং হলো জীবাণু প্রতিরোধকারী রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে ফল ও শাকসবজির পচন বন্ধ করা। মোমের সাথে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ানাশক মিশিয়ে ফলের উপর প্রলেপ দিলে ফলে অবস্থিত জীবাণু ধ্বংস হয়। তাছাড়া ফলের গায়ে যেসব সূক্ষ্ম ছিদ্র থাকে সেগুলো বন্ধ হওয়ার কারণে ফল শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
১২. শাকসবজির শারীরিক ও শারীরতাত্ত্বিক অবক্ষয় বলতে কী বোঝ?
উত্তর: শাকসবজির শারীরিক ও শারীরতাত্ত্বিক অবক্ষয় বলতে সংগ্রহের পর স্বাভাবিক সবুজ রং নষ্ট হওয়া, কাণ্ড ও ফল জাতীয় সবজিতে আঁশের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে বোঝায়। এতে শাকসবজিতে পানির পরিমাণ কমে যায়, আমিষ, চর্বি ও ভিটামিনের পরিবর্তন হয়, যার ফলে শাকসবজি পচে থাকে।
১৩. ফল ও সবজি সুষ্ঠুভাবে বাজারজাতকরণে কী করা প্রয়োজন ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: ফল ও শাকসবজি গাছ থেকে সংগ্রহ করার পর থেকে বিক্রি পর্যন্ত পার করা ধাপগুলোই হচ্ছে বাজারজাতকরণ। ফল ও সবজি সুষ্ঠুভাবে বাজারজাতকরণের জন্যে ভালো ফল ও সবজি বাছাই, এগুলোর আকার, বর্ণ, পরিপক্কতার ওপর গ্রেডিং, সাবধানে প্যাকিং ও পরিবহন করা প্রভৃতি কাজগুলো করা হয়। বাজারজাতকরণ সুষ্ঠু হলে কৃষক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা সকলেই লাভবান হবেন।
১৪. জ্যাম তৈরির সময় সাইট্রিক এসিড মেশানো হয় কেন?
উত্তর: জ্যাম তৈরির সময় সাইট্রিক অ্যাসিড বা লেবুর রস পানের সাথে মিশিয়ে নেওয়া হয়। জ্যাম তৈরির সময় সাইট্রিক অ্যাসিড মিশালে তা ফলের শাঁস থেকে পেকটিন মুক্ত করে এবং খাদ্যের সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়ায়। এছাড়া এসিডের মিশ্রণ মিষ্টিযুক্ত খাদ্যের স্বাদ বৃদ্ধি করে। তাই জ্যাম তৈরির সময় সাইট্রিক অ্যাসিড মেশানো হয়।