মৎস্য সম্পদের গুরুত্ব || Importance of fishery resources

মৎস্য

বাংলাদেশে শস্য বা ফসলের বাইরেও কৃষির আরও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র বা খাত রয়েছে । যেমন 

১. মৎস্য খাত 

২. প্রাণিসম্পদ ( গবাদিপশু ও হাঁস - মুরগি ) খাত। 

মৎস্য ও মৎস্য বিজ্ঞানের ধারণা 

মৎস্য বা মাছ হলো শীতল রক্তবিশিষ্ট মেরুদণ্ডী প্রাণী । এরা ফুলকার সাহায্যে শ্বাসকার্য চালায় এবং পাখনার সাহায্যে পানিতে চলাফেরা করে। মাছ চাষকে বলা হয় পিসিকালচার ( Pisciculture )।

জীববিজ্ঞানের যে শাখায় মাছের ও অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন অন্যান্য জলজ প্রাণীর ( যেমন- শামুক , ঝিনুক ইত্যাদি ) শ্রেণীবিন্যাস, চাষ পদ্ধতি, প্রজনন , রোগ ব্যবস্থাপনা , সংরক্ষণ , পরিবহন ও বিপণন বিষয়ে আলোচনা করা হয় তাকে মৎস্য বিজ্ঞান বলে।


প্রাণীকূলে ( Anirmal Kingdom ) মাছের অবস্থান: 

পর্ব (Phylum):     কর্ডাটা ( Chordata) 

উপ - পর্ব ( Sub - phylum ): ভার্টিব্রাটা (Vertebrata)

অধিঃশ্রেণি ( Super - class ):  i. নাথোস্টোমাটা ( Gnathostomara ) 

                                               ii . আগনাথা ( Agnathar)

শ্রেণি ( Class ) :  ১. কনড্রিকথিস ( Chondrichthyes ) 

                           ২. অসটিকথিস ( Osteichthyes ) 
মৎস্য সম্পদের গুরুত্ব

মাছের শ্রেণিবিন্যাস 

ক. অন্তঃকঙ্কালের প্রকৃতি অনুসারে : অন্তঃকঙ্কালের প্রকৃতি অনুসারে মাছকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায় । যথা— 

১. তরুণাস্থিযুক্ত মাছ: যেসব মাছের অন্তঃকঙ্কাল নরম ও তরুণাস্থি দিয়ে গঠিত সেগুলোকে তরুণাস্থিযুক্ত মাছ বলে। যেমন – রূপচাঁদা , করাত , হাঙর ইত্যাদি।

২. অস্থিযুক্ত মাছ : যেসব মাছের অন্তঃকঙ্কাল শক্ত ও অস্থিময় সেগুলোকে অস্থিযুক্ত মাছ বলে। যেমন- কাতলা , রুই , মৃগেল ইত্যাদি।


খ. আঁইশের উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে: মাছকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা- 

১. আঁইশযুক্ত মাছ : যে সকল মাছের দেহ আঁইশ দ্বারা আবৃত থাকে তাকে আঁইশযুক্ত মাছ বলে । যেমন – রুই , কাতলা , সরপুঁটি ইত্যাদি ।

 ২. আঁইশবিহীন মাছ : যে সকল মাছের দেহ আঁইশ দ্বারা আবৃত থাকে না তাকে আঁইশবিহীন মাছ বলে। যেমন- মাগর , শিং , পাবদা ইত্যাদি।

 
গ. বাসস্থানের ওপর ভিত্তি করে: মাছকে প্রধানত ৩ টি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা- 

১. স্বাদু পানির মাছ : অভ্যন্তরীণ বদ্ধ ও মুক্ত জলাশয়ে , অর্থাৎ পুকুর , নালা , নদী ও বিলের স্বাদু পানিতে যেসব মাছ বাস করে সেগুলোকে স্বাদু পানির মাছ বলা হয়। যেমন- রুই , কাতলা , শিং , মাগুর , পুঁটি , কই, টাকি ও বোয়াল।

২. আধালোনা পানির মাছ : নদীর মোহনা অঞ্চলের পানি আধালোনা প্রকৃতির । এ অঞ্চলে যেসব মাছ পাওয়া যায় সেগুলোকে আধালোনা পানির মাছ বলা হয় । যেমন— ভেটকি , পোয়া , ছুরি , লইট্যা ও কোরাল। 

৩. লোনা পানির মাছ : বঙ্গোপসাগরে ও উপকূলীয় এলাকায় অর্থাৎ লোনা পানিতে যেসব মাছ বসবাস করে সেগুলোকে লোনা পানির মাছ বলে। যেমন— ইলিশ , রূপচাঁদা , সুরমা , তারামাছ ও দাতিনা। 

মৎস্য সম্পদের গুরুত্ব 

বাংলাদেশের আবহাওয়া , জলবায়ু , মাটি ও পানি মাছ চাষের জন্য উপযুক্ত বলে এখানে প্রচুর মাছ উৎপাদন করা যায়। বর্তমানে মাছের পোনা উৎপাদন , পোনা লালন পালন , মাছ চাষ , সংরক্ষণ , বাজারজাতকরণ , রপ্তানিসহ বিভিন্ন খাতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে । নিচে মাছ চাষের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো— 

খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহ 

১. আমিষ সরবরাহ : পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে , মাথাপিছু প্রতিদিন কমপক্ষে ৪৫.৩ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করা উচিত যার এক - তৃতীয়াংশ হবে প্রাণিজ প্রোটিন । প্রাণিজ আমিষের গুণগতমান বেশি । এ প্রাণিজ আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস হলো মাছ। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় মাছ প্রায় ৬০ % আমিষের যোগান দেয়।

২. চর্বি সরবরাহ : মাছে রয়েছে প্রচুর চর্বি বা তেল যা আমাদের দৈহিক শক্তির জন্য খুবই প্রয়োজন । এছাড়াও রয়েছে শরীরের জন্য উপকারি ফ্যাটি এসিড যা রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে।

৩. ভিটামিন সরবরাহ: ছোট মাছ যেমন- মলা , ঢেলা , দারকিনা , কাচকি প্রভৃতি মাছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ' এ ' রয়েছে যা রাতকানা রোগ দূর করে। এছাড়া মাছে ভিটামিন ই রয়েছে । রিবোফ্লাভিন , থায়ামিন ইত্যাদির অভাব পূরণেও মাছ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। মাছের চামড়ায় রয়েছে ভিটামিন ' ই ' , কোলাজেন ও ওমেগা -৩।

৪. খনিজ সরবরাহ : সামুদ্রিক মাছে প্রচুর আয়োডিন রয়েছে যা গলগন্ড রোগ হওয়া থেকে মুক্তি দেয়। মাছে ক্যালসিয়াম , লৌহ , জিংক , ফসফরাস প্রভৃতি খনিজ রয়েছে যা হাড়ের গঠনে ভূমিকা রাখে। 

জাতীয় অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান 
১ . বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন: দেশের রপ্তানি আয়ের ১.৩৯ % মৎস্য উপখাত থেকে আসে । ২০২০-২১ অর্থবছরে ০.৪৬ লক্ষ টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে ২৫৫৫.০৪ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা , ২০২১ ]। রপ্তানিকৃত মৎস্য সম্পদের মধ্যে চিংড়ি , শুঁটকি মাছ , ব্যাঙের পা , কাঁকড়া , কচ্ছপ ইত্যাদি অন্যতম। বিশ্বের ৫৬ টি দেশে বাংলাদেশের মাছ রপ্তানি হয়। 

২. জাতীয় অর্থনীতিতে: বাংলাদেশের আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে মৎস্য খাত। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা , ২০২১ এর তথ্যমতে , দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি'র ৩.৫৭ % এবং মোট কৃষিজ আয়ের প্রায় এক - চতুর্থাংশ ( ২৬.৫০ % ) মৎস্য খাত থেকে আসে।

৩. কর্মসংস্থান সৃষ্টি : বর্তমানে বাংলাদেশে জেলের সংখ্যা ১৩.১৬ লাখ ( তথ্যসূম : কৃষি ডাইরি , ২০২১)৷ পুরুষ - মহিলা নির্বিশেষ মোট জনসংখ্যার ১১ % এর অধিক লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের ওপর নির্ভরশীল।

৪. জনশক্তি: নিবিড় মাছ চাষ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর জনশক্তি প্রয়োজন। অনেক বেকার লোক মাছ চাষ করে হ্যাচারি , নার্সারি , খামার , মাছের খাদ্য তৈরি করে বেকারত্ব দূর করছে।

৫. শিল্পক্ষেত্রে: মাছের চর্বি, কাঁটা , হাড় ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় । সাবান , ওষুধ , গ্লিসারিন , বার্নিশ ইত্যাদি তৈরিতে মাছের তেল ব্যবহৃত হয়। মাছের ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই গ্রামগঞ্জে নৌকা, লঞ্চ , বরফ তৈরি ও জাল বুননের মতো বিভিন্ন শিল্প গড়ে উঠেছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url