ভার্চুয়াল রিয়েলিটি || Virtual Reality
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি শব্দের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে কৃত্রিম বাস্তবতা। প্রকৃত অর্থে বাস্তব নয় , কিন্তু বাস্তবের চেতনা উদ্রেককারী বিজ্ঞাননির্ভর কল্পনাকে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বা কৃত্রিম বাস্তবতা কিংবা কল্পবাস্তবতা বলে। একে সংক্ষেপে VR বলা হয়ে থাকে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি মূলত কম্পিউটার প্রযুক্তি ও সিমুলেশন তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এতে ব্যবহৃত সফটওয়্যারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- Vizard , VRToolkit , 3d Studio Max , Maya ইত্যাদি।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে ত্রিমাত্রিক ইমেজ তৈরির মাধ্যমে অতি অসম্ভব কাজও করা সম্ভব হয়। কল্পনার পাথায় ভর করে ইচ্ছে করলে চাঁদের মাটিতে হেঁটে আসা, প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতম অঞ্চলে ঘুরে আসা, মানুষের মস্তিষ্কের নিউরাল সংযোগের উপর দিয়ে হাঁটা কিংবা জুরাসিক পার্কের সেই অতিকায় ডাইনোসরের তাড়াও খাওয়া যায়। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হলো হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে তৈরিকৃত এমন একটি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ, যা ব্যবহারকারীদের কাছে বাস্তব পরিবেশ মনে হয়।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির উপাদানসমূহ
১. রিয়েলিটি ইঞ্জিন
২. হেড মাউন্টেড ডিসপ্লে ( Head Mounted Display HMD )
৩. ডেটা গ্লোভ ( Data ( Glove )
৪. বিভিন্ন ধরনের সেন্সর
৫. একটি পূর্ণাঙ্গ বড়ি স্যুইট ( Body Suit )
৬. উচ্চ মানের অডিও ব্যবস্থা
৭. বিভিন্ন সিমুলেশন , মডেলিং ও গ্রাফিক্স সফটওয়্যার ইত্যাদি।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি তৈরির উপাদানসমূহ
১. ইফেক্টর (Effector): ইফেক্টর হলো ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে ব্যবহৃত এক বিশেষ ধরনের ইন্টারফেস ডিভাইস। এটি ব্যবহারকারীকে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির পরিবেশের সাথে সংযুক্ত করে। যেমন-
ক. হেড মাউন্টেড ডিসপ্লে(Head Mounted Display): হেডসেটটি চোখ ও কানকে ঢেকে রাখে এবং এটি দ্বারা কোনো দৃশ্য দেখা ও শোনা যায়। ত্রিমাত্রিক ছবি দেখার জন্য লেন্স সহ হেডসেট ব্যবহার করা হয়।
খ. ডেটা গ্লোভস (Data Gloves): ডেটা গ্লোভস পরিধান পরিধান করলে স্পর্শের অনুভূতি প্রধান করে। তাছাড়া হাতের সাথে সংযুক্ত গ্লোভস দ্বারা প্রয়োজনীয় কমান্ড দেওয়া হয়।
গ. একটি পূর্ণাঙ্গ বডি স্যুইট ( Body Suit): বডি স্যুইটে ব্যবহৃত সেন্সরগুলো হতে সিমুলেশন প্রোগ্রামে অনবরত পাঠাতে থাকে ও প্রোগ্রামটি সেই অনুযায়ী সামনের স্ক্রিনে পরিবর্তন আনে।
২. বিয়েলিটি সিমুলেটর (Really Simulator): এটি এক ধরনের হার্ডওয়্যার , যা ইফেক্টরকে সংবেদনশীল তথ্য সরবরাহ করে। যেমন- বিভিন্ন ধরনের সেন্সর, ট্রান্সসিউডার , উচ্চ মানের অডিও ও ভিডিও ব্যবস্থা , রিয়েলিটি ইঞ্জিন ইত্যাদি।
৩. অ্যাপ্লিকেশন (Application): ভার্চুয়াল পরিবেশ ও প্রাসঙ্গিকতা তৈরিতে বিভিন্ন সিমুলেশন সফটওয়্যার ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন- অটোডেস্কের তৈরি ডিভিশন (Division) , যা সাধারণত ইন্টেল প্রসেসর সংবলিত পিসিতে ব্যবহৃত হয়।
৪. জিওমেট্রি (Geometry): জিওমেট্রি হলো ভার্চুয়াল পরিবেশের বিভিন্ন বস্তুর বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত তথ্যাবলি। যেমন- ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে ব্যবহৃত ত্রিমাত্রিক মডেলসমূহকে অটোডেস্ক , থ্রিডি স্টুডিও ম্যাক্স বা মায়া প্রভৃতি সফটওয়্যার ব্যবহার করে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে দুই চোখে দুটি ভিন্ন দৃশ্য দেখিয়ে ত্রিমাত্রিক অনুভূতি সৃষ্টি করা হয়। একই স্ক্রিনে ভিন্ন ভিন্ন প্রজেক্টরের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্য প্রদর্শন করিয়েও একই অনুভূতি সৃষ্টি করা যায়। এর জন্য কম্পিউটার হার্ডওয়্যার বা সফটওয়ারের সাহায্যে কোনো পরিবেশ বা ঘটনার ত্রিমাত্রিক চিত্রায়ণ করার প্রয়োজন হয়। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি একজন ব্যক্তিকে কোনোরকম শারীরিক ঝুঁকি বা বিপদ ছাড়াই বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রদান করে। সম্প্রতি গুগলও Lively নামে ভার্চুয়াল চ্যাটিং সার্ভিস চালু করেছে, যেখানে একটি ভার্চুয়াল কক্ষ বা পরিবেশে যে কেউ তার বন্ধু - বান্ধব ও আত্মীয় - স্বজনদের নিয়ে প্রবেশ করতে পারে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অভিজ্ঞতা: ২০০৫ সালের মার্চে আমেরিকার টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টনস্থ নাসা ঘুরে ঘুরে অনেক কিছু দেখার সুযোগ হয়। চাঁদের পাথর হাত দিয়ে স্পর্শ করে অভিভূত হই । নানায় রাখা ডামি মহাশূন্যযানে বসি। আমাকে বিশেষ ধরনের চশমা আরো কিছু ডিভাইস দেয়া হয়। রুমের লাইট বন্ধ করে অন্ধকারে VR- এর সুইচ অন করে দেয়া হয়। আমি মহাশূন্যে চলে যাচ্ছি। বিভিন্ন গ্রহ , উপগ্রহ উল্কাপিন্ড এবং মহাশূন্যের আরো অনেক কিছু দেখি।
প্রায় ১৫ মিনিট পর মহাশূন্যযানটি নিয়ে পৃথিবীতে আসি। লাইট অন করে দেয়ার পর দেখি আমি নাসার ঐ ডামি মহাশূন্যযানটিতেই বসে আছি। এই হলো ভার্চুয়াল রিয়েলিটি। আমাদের দেশের বঙ্গবন্ধু নভো থিয়েটার ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ছোট্ট একটি উদাহরণ। এখানে নভোমন্ডল সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য এবং নভোমণ্ডলের ধারণা পাওয়ার জন্য কৃত্রিম নভোমণ্ডল তৈরি করা আছে। ভারতের কলকাতার সায়েন্স সিটিতে যাওয়ার সুযোগ হলে টাইম মেশিনে উঠে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি উপভোগ করতে পার। সায়েন্স সিটির ডামি মহাশূন্যযানটি পৃথিবীর আদিকাল থেকে আধুনিক যুগ ভ্রমণ করিয়ে নিয়ে আসবে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ধাপ সমূহ
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কাজ করে মূলত দুটি ধাপে-
১. প্রথমত কম্পিউটারে তৈরি ত্রিমাত্রিক ছবি দিয়ে ভার্চুয়াল পরিবেশ বা পরিমণ্ডল তৈরি হয়।
২. পরের ধাপে ব্যবহারকারীর গতিবিধি অনুসরণ করে ত্রিমাত্রিক ছবি অনুসারে পরিবর্তন করতে হয়। ডান দিকে তাকালে ডান দিকের ছবি দেখাবে, গেইমে শত্রু সামনে এলে প্রয়োজন অনুসারে হাত নেড়ে তার সঙ্গে লড়াই করতে হবে। এই নাড়াচড়াগুলো অনুসরণ করার জন্য সেন্সর ব্যবহার করা হয়।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির বৈশিষ্ট্য
একটি কৃত্রিম জগতের প্রধানত নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো থাকতে হয়—
১. বাস্তব জগতে বিভিন্ন বস্তুকে যেমন দেখায় , কৃত্রিম জগতেও বস্তুগুলোর ত্রিমাত্রিক রূপ ঠিক তেমনি হতে হয়।
২. ব্যবহারকারীর চলাফেরার সাথে সাথে বিভিন্ন বস্তুর দৃশ্যমান অংশেরও আনুষঙ্গিক পরিবর্তন ঘটাতে হয়।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির খারাপ প্রভাব
বাস্তব জীবনে প্রত্যেকটি প্রযুক্তির কিছু না কিছু নেতিবাচক বা মন্দ দিক রয়েছে। শৈশব থেকে অর্জিত শিক্ষাই বলে দেবে আমরা কোন পথ অবলম্বন করবো। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির নেতিবাচক প্রভাব চিহ্নিত করা হলো-
১. ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদির দাম ও জটিলতা বেশি এবং এই প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত সফটওয়্যার বা প্রোগ্রামও খুবই মূল্যবান ও ব্যয়বহুল।
২. ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ফলে মনুষ্যত্বহীনতা বা ডিহিউম্যানাইজেশন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে মানুষের ক্রিয়া হ্রাস পাবে ও মানব সমাজ বিলুপ্ত হতে থাকবে।
৩. ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ফলে মানুষ ইচ্ছেমতো কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করতে পারবে। ফলে মানুষ বেশিরভাগ সময় কাটাবে কল্পনার জগতে এবং খুব কম সময় থাকবে বাস্তব জগতে।
৪. ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহারের ফলে মানুষের চোখের ও শ্রবনশক্তির ক্ষতি হতে পারে।