আসক্তি কি? || What is Addiction?

 কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহারে আসক্তি

আসক্তি বলে একটা ভীতিকর শব্দ আছে এবং সবাই নিশ্চয়ই এর সাথে পরিচিত। সাধারণত আসক্তি শব্দটা ব্যবহৃত হয় মাদকের সাথে। কোনো একজন ব্যক্তি মাদকে আসক্ত হয়ে গেলে তার জীবনটা কেমনভাবে নষ্ট হয়ে যায় এবং সেখান থেকে বের হয়ে আসা কত কঠিন আমরা সবাই সেটা জানি। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির পাঠ্যবইয়ে কম্পিউটার এবং কম্পিউটার ব্যবহারের মতো এমন চমৎকার একটা বিষয়ের সাথে আসক্তির মতো ভয়ংকর একটা নেতিবাচক শব্দ কেমন করে জুড়ে দেওয়া হলো সেটি নিয়ে আপনাদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই অবাক হয়েছেন। 

আপনাদের ভেতর যাদের কম্পিউটার আছে, তাদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে কম্পিউটার গেম খেলতে খেলতে মাঝে মাঝে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন, খেলা বন্ধ করে যখন অন্য একটা জরুরি কাজ করা দরকার তখনো খেলা ছেড়ে উঠতে পারছেন না, এরকম অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই কারো কারো হয়েছে। যাদের কম্পিউটারে ইন্টারনেটের যোগাযোগ আছে তাদের কারো কারো হয়তো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে এবং সেই ফেসবুকে আপনি সম্ভবত নিজের সম্পর্কে কোনো তথ্য দিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছেন কখন সেখানে কেউ লাইক দেবে। 

ফেসবুকে আপনার বন্ধু বাড়লে আপনি হয়তো আনন্দ পেয়েছেন এবং ঠিক কম্পিউটার গেমের মতোই ফেসবুক নামে সামাজিক নেটওয়ার্কে আপনার যতটুকু সময় দেওয়া উচিত আপনাদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই তার থেকে অনেক বেশি সময় দিয়েছেন। এটা হয়তো খুব অস্বাভাবিক নয় যে আপনি যদি ফেসবুকে এত সময় না দিতেন তাহলে আপনার পরীক্ষার ফল আরেকটু ভালো হতো। আপনি আরো কয়েকটা চমৎকার বই পড়তে পারতেন। মাঠে আরো একটু বেশি খেলতে পারতেন। ভাই - বোন, বাবা - মাকে আরেকটু বেশি সময় দিতে পারতেন। আপনাদের অনেকে কম্পিউটার গেম কিংবা ফেসবুকের মতো কোনো একটা সামাজিক নেটওয়ার্কে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি সময় ব্যয় করেন। 

এতে সত্যিকারের জীবনের খানিকটা হলেও ক্ষতি করছেন যারা এমনটি করছেন তারা নিশ্চয়ই এখন কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট নামে ইতিবাচক শব্দটির সাথে আসক্তি নামের নেতিবাচক শব্দটা জুড়ে দেওয়ার কারণ বুঝতে পেরেছেন। আসক্তি বলতে বোঝানো হয় যখন কেউ জানে কাজটি করা ঠিক হচ্ছে না তারপরও সেই কাজটি না করে থাকতে পারে না। মাদকের জন্যে এটি যেমন হতে পারে ঠিক সেরকম কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও সেটি হতে পারে। মাদক যেমন জীবনের জন্য ক্ষতিকর , বাড়াবাড়ি করা হলে কম্পিউটার কিংবা ইন্টারনেটও সে রকম ক্ষতির কারণ হতে পারে।

কম্পিউটার গেমে আসক্তি

 কম্পিউটার গেমে আসক্তিটা যেকোনো বয়স থেকেই শুরু হতে পারে তবে শৈশব থেকে বেশি দেখা দেয়। বেশিরভাগ সময়ই গেম আসক্তিটা ঘটে অভিভাবকদের অজ্ঞতা  কারণে। কম্পিউটার একটা Tool এবং এটা দিয়ে নানা ধরনের কাজ করা যেতে পারে। তথ্য ও প্রযুক্তির এত সুন্দর সুন্দর কথা বলা হয়েছে, অভিভাবকরা ধরে নেন এটা দিয়ে যা কিছু করা হয় সেটাই ভালো কাজ, তাই যখন তারা দেখেন তাদের সন্তানেরা দীর্ঘ সময় কম্পিউটারের সামনে বসে আছে তারা বুঝতে পারেন না। 
আসক্তি কি?


কম্পিউটার গেম এক ধরনের বিনোদন এবং এই বিনোদনের নানা রকম মাত্রা রয়েছে। যারা সেটি খেলছে তারা সেটাকে নিছক বিনোদন হিসেবে নিয়ে মাত্রার ভেতরে ব্যবহার করলে সেটি যেকোনো সুস্থ বিনোদনের মতোই হতে পারে। কিন্তু প্রায় সময়ই সেটি ঘটে না। দেখা গেছে একটি ছোট শিশু থেকে পূর্ণ বয়স্ক মানুষ পর্যন্ত সবাই কম্পিউটার গেমে আসক্ত হয়ে যেতে পারে। কোরিয়ায় একজন মানুষ টানা পঞ্চাশ ঘণ্টা কম্পিউটার গেম খেলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল, চীনের এক দম্পতি কম্পিউটার গেম খেলার অর্থ জোগাড় করতে তাদের শিশু সন্তানকে বিক্রয় করে দিয়েছিল। এই উদাহরণগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় কম্পিউটার গেমে আসক্ত হয়ে যাওয়া মোটেও ৰিচিত্ৰ নয় এবং একটু সতর্ক না থাকলে একজন খুব সহজেই আসক্ত হয়ে যেতে পারে।

 কম্পিউটার কিংবা কম্পিউটার গেমে আসক্তির বিষয়টা যেহেতু নতুন , তাই সেগুলো নিয়ে গবেষণা এখনো খুব বেশি হয়নি। কিন্তু ভবিষ্যতে পুরো বিষয়টি নিয়ে গবেষকরা আরো নিশ্চিতভাবে দিক - নির্দেশনা দিতে পারবেন। এখনই গবেষণায় দেখা গেছে কোনো একটা কম্পিউটার গেমে তীব্রভাবে আসক্ত একজন মানুষের মস্তিষ্কে বিশেষ উত্তেজক রাসায়নিক দ্রব্যের আবির্ভাব হয়। শুধু তাই নয় যারা সপ্তাহে অন্তত ছয় দিন টানা দশ ঘণ্টা করে কম্পিউটার ব্যবহার করে তাদের মস্তিষ্কের গঠনেও এক ধরনের পরিবর্তন হয়ে যায়। কাজেই কম্পিউটার গেম চমৎকার একটা বিনোদন হতে পারে কিন্তু এতে আসক্ত হওয়া খুব সহজ। কিন্তু এর পরিণতি মোটেও ভালো নয়, সেই দিকটা সবাইকে মনে রাখতে হবে।

সামাজিক নেটওয়ার্কে আসক্তি 

মানুষ সামাজিক জীব এবং মানুষের নিজেদের ভেতর সবসময়েই একধরনের সামাজিক যোগাযোগ ছিল। কিন্তু ইদানীং সামাজিক যোগাযোগের কথা বলা হলে সেটি মানব সভ্যতার সেই চিরন্তন সামাজিক যোগাযোগ বা সামাজিক নেটওয়ার্কের কথা না বুঝিয়ে ইন্টারনেট - নির্ভর সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধরনের নেটওয়ার্কের কথা বোঝানো হয়। ফেসবুক , টুইটার , ইনস্টাগ্রাম , গুগলপ্লাস- এ ধরনের অনেক সামাজিক যোগাযোগ সাইট রয়েছে যেগুলোতে মানুষ নিজেদের পরিচিতদের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারে। 

এক সময় এই সাইটগুলো ছিল কম বয়সী তরুণ - তরুণীদের জন্যে , এখন সব বয়সী মানুষই সেটি ব্যবহার করে। শুধু যে একে অন্যের সাথে যোগাযোগের জন্যে এটি ব্যবহার করে তা নয় , একটা বিশেষ আদর্শ বা মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যেও এটি ব্যবহার করা হয়। যে উদ্দেশ্যে এটি শুরু হয়েছিল যদি এটি সেই উদ্দেশ্যের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে এটি কোনো সমস্যার জন্ম দিত না , কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি সামাজিক যোগাযোগ সাইটে আসক্তি ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীর জন্যেই একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে শুরু করছে। 

মনোবিজ্ঞানীরা এটা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন এবং এখন এটি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত বলা যায় এই সাইটগুলোর সাফল্য নির্ভর করে , সেগুলো কত দক্ষতার সাথে ব্যবহারকারীদের আসক্ত করতে পারে। পুরো কর্মপদ্ধতির মাঝেই যে বিষয়টি রয়েছে সেটি হচ্ছে কত বেশিবার এবং কত বেশি সময় একজনকে এই সাইটগুলোতে টেনে আনা যায় এবং তাদেরকে দিয়ে কোনো একটা কিছু করানো যায়। যে যত বেশিবার এই সাইট ব্যবহার করবে সেই সাইটটি তত বেশি সফল হিসেবে বিবেচিত হবে এবং অবশ্যই সেটি তত বেশি টাকা উপার্জন করবে। কাজেই কেউ যদি অত্যন্ত সতর্ক না থাকে তাহলে তার এই সাইটগুলোতে পুরোপুরি আসক্ত হয়ে যাবার খুব বড় একটা আশঙ্কা রয়েছে।

 মনোবিজ্ঞানীরা এই সাইটগুলো বিশ্লেষণ করে আরো একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় আবিষ্কার করেছেন। সব মানুষের ভেতরেই নিজেকে প্রকাশ করার একটা ব্যাপার রয়েছে কিংবা নিজেকে নিয়ে মুগ্ধ থাকার এক ধরনের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা থাকে, সেটাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় Narcissism বলে- সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে মানুষের এই সুপ্ত বাসনাকে জাগ্রত করে দেয়। 

সবার ভেতরই তখন নিজেকে জনপ্রিয় করে তোলার এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। জেনে হোক না জেনে হোক ব্যবহারকারীরা নিজের সম্পর্কে অত্যন্ত তুচ্ছ খুঁটিনাটি তথ্য সবার সামনে উপস্থাপন করতে থাকে, কেউ সেটি দেখলে সে খুশি হয় , কেউ পছন্দ করলে আরো বেশি খুশি হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি অনেকটা মাদকের মতো কাজ করে এবং একজন ব্যবহারকারী ঘণ্টার পর ঘন্টা এই যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের সময় অপচয় করতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগের এই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার কারণে সারা পৃথিবীতে অনেক সময়ের অপচয় হচ্ছে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url