দুর্নীতি কী? || What is Corruption?
দুর্নীতির ধারণা
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে 'দুর্নীতি' অন্যতম ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি যার কারণে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। দুর্নীতি মানব ইতিহাসের একটি ঘৃণিত বিষয়। কোটিল্য প্রায় দু'হাজার বছর আগে তাঁর ' অর্থশাস্ত্রে ' দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। আভিধানিক অর্থে দুর্নীতি বলতে বোঝায়— 'যা নীতি বিরুদ্ধ' , 'কুনীতি' , 'অসদাচরণ' ইত্যাদি। অন্যভাবে বলা যায়, ‘সত্যশীলতা, সদগুণ বা নৈতিক নীতির ক্ষতিসাধন , নষ্টকরণ, অপকর্মে অনুচিত বা বেআইনি কর্মে উৎসাহদান'। অক্সফোর্ড অভিধান অনুসারে, 'দুর্নীতি মানে অস্বাভাবিক উপায়ে কোনো কিছু করা।
দুর্নীতির ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে Corruption. Corruption শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ 'Corruptius' , থেকে যার অর্থ ধ্বংস বা ক্ষতি সাধন। জাতিসংঘ প্রণীত ম্যানুয়াল অন অ্যান্টি করাপশন পলিসি (Manual on Anticorruption Policy) অনুযায়ী, ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধারের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহারই হলো দুর্নীতি। ক্ষমতার অপব্যবহার বলতে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রকেই বোঝানো হয়। নৈতিক অর্থে, নীতি বিচ্যুতি বা নীতি বিরুদ্ধ কাজই দুর্নীতি। প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দুর্নীতির একটি উত্তম সংজ্ঞা দিয়েছেন প্রফেসর ড . মোহাম্মদ শামসুর রহমান। তিনি বলেন, 'ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ কিংবা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা অন্য কাউকে সুযোগ - সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে যদি কোনো সরকারি কর্মী নিজের খেয়ালখুশি মতো সরকারি ক্ষমতা বা পদমর্যাদার অপব্যবহার করেন বা অন্যায় কোনো কাজ করেন, বা ন্যায়সংগত কাজ করা থেকে বিরত থাকেন তাহলে তার এমন কার্যকলাপকে দুর্নীতি বলা যায়।'
বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন ( দুদক ) দুর্নীতি সম্পর্কে তাদের প্রকাশিত হ্যান্ড ব্রশিয়ারে বলেছে, ব্যক্তি স্বার্থ অর্জনের বা ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহারই দুর্নীতি। উত্ত প্রুশিয়ারে দুদক আরও উল্লেখ করে, যে কর্মকাণ্ড সাধারণভাবে বিবেকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, তাকেই দুর্নীতি বলে।
দুর্নীতির কারণসমূহ (Causes of Corruption)
দুর্নীতির কারণসমূহ জানতে ও উদ্ঘাটন করতে দেশি - বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও গবেষকগণ চেষ্টা করছেন। তারা দুর্নীতির কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন । এর মধ্যে TIB কর্তৃক চিহ্নিত দুর্নীতির কারণসমূহ হচ্ছে
১. জবাবদিহিতার অভাব;
২. ইচ্ছামাফিক ক্ষমতার ব্যবহার ;
৩. একচ্ছত্র ক্ষমতার ব্যবহার ;
৪. স্বচ্ছতার অভাব ;
৫. ক্ষমতাশীল ব্যক্তিদের প্রভাব ;
৬. স্বল্প বেতন ইত্যাদি।
এছাড়া ' অভাব ' ও 'লোভকে' অনেকে দুর্নীতির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন । বস্তুত ' অভাব ' ও ' লোভ ' অসংখ্য অপকর্মের প্রসূতি । কারণ অধিকাংশ মানুষ এ দুটি বিষয়ে তাড়িত হয়ে দুর্নীতি করে। দুর্নীতির আরও যে সব কারণ রয়েছে তা হলো:
ক. সরকারের কর্মকান্ডে স্বচ্ছতার অভাব। অর্থাৎ , জনগণের স্বার্থজড়িত কাজ ও প্রকল্প বিষয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত এবং অবহিত করা হয় না;
খ. তথ্য জানার অধিকার সংক্রান্ত আইনের অভাব;
গ. বাক স্বাধীনতাসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অভাব;
ঘ. দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনা ; যথাসময়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের হিসাব - নিকাশ সম্পন্ন না হবার দীর্ঘসূত্রিতা;
ঙ. পরিবার, ব্যবসা - বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি পরিমাপের জন্য নিয়মিত জরিপ পরিচালনা না হওয়া;
চ. দুর্বল কর প্রশাসন ও কর ব্যবস্থা ;
ছ. সর্বমহলে গণতান্ত্রিক মনোভাবের অনুপস্থিতি ;
জ. সরকারি কর্মকাণ্ডের পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য সুশীল সমাজ ও গবেষণাধর্মী সংস্থার অভাব ;
ঝ. জাতীয় রাজনীতি সম্বন্ধে ভোটাধিকারপ্রাপ্ত জনগণের অসচেতনতা ;
ঞ. আইনের শাসনের অভাব ;
ট. বিচারবিভাগের স্বাধীনতার অভাব ও আইনের দুর্বলতা ,
ঠ. দুর্নীতির তথ্যদাতার নিরাপত্তার অভাব ;
ড. সামরিক ও বে - সামরিক স্বৈরশাসন ;
ঢ. সৎ কর্মচারীদের যথাযথ মূল্যায়ন না করা এবং অসৎ কর্মচারীদের বিচার না করা ;
ণ. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের অভাব ;
ত. দুর্নীতি প্রতিরোধে রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্বল অবস্থান ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ;
থ. দেশপ্রেম , মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাব ও অবক্ষয়।
দুর্নীতির প্রভাব (Effects of corruption)
বাংলাদেশের সমাজজীবনে দুর্নীতির মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা যায় । মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা এবং জাতীয় উন্নয়ন তরান্বিত করা উভয় ক্ষেত্রেই মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দুর্নীতি । দুর্নীতির প্রভাব নিম্নরূপ:
১. দুর্নীতির কারণে সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মাঝে দূরত্ব ও বৈষম্য বাড়ে। এক শ্রেণি লোকের সম্পদের পাহাড় গড়ার হীন মনোবাসনার কাছে ক্রমেই অসহায় হয়ে পড়ে দরিদ্র শ্রেণির মানুষের জীবন। দুর্নীতির ফলে জাতীয় আয় এবং মানুষের মাথাপিছু আয় কমে যায়।
২. দুর্নীতির প্রভাবে সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন পরিকল্পনার সুচারু বাস্তবায়ন বাধাপ্রাপ্ত হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ থাকলেও দুর্নীতির কারণে তাও বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে সরকারের সাথে জনগণের দূরত্ব বৃদ্ধি পায়।
৩. দুর্নীতির কারণে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তির ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। এর ফলে দাতা সংস্থা ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নেয়।
৪. ক্ষমতার অপব্যবহার সমাজের অন্যান্য মানুষদের জন্য নেতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি করে। ফলে সাধারণ মানুষ দুর্নীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। এর ফলে সামাজিক শৃঙ্খলা ও সংহতি বিনষ্ট হয়। যার ফলে সাধারণ জনগণ বিশেষভাবে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার লংঘিত হয়। দুর্নীতির প্রভাবে মানুষ কর্মবিমুখ হয়ে পড়ে। সর্বোপরি নৈতিক চেতনা হারিয়ে মানুষ অমানুষে পরিণত হয়।
দুর্নীতি দমন বা প্রতিরোধের উপায়সমূহ বা ব্যবস্থা
দুর্নীতি সমাজ দেহে ক্যান্সার সমতুল্য সামাজিক ব্যাধি। দুর্নীতি ও এর কারণসমূহকে পুরোপুরি নির্মূল করা হয়ত সম্ভব নয়। তবে একে দমন বা প্রতিহত করার কিছু উপায় বা ব্যবস্থা নির্দেশ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি প্রতিরোধে যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তা হলো:
১. দুর্নীতির বিচারের জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন এবং তা কার্যকর করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের ‘ দুর্নীতি দমন কমিশন'কে শক্তিশালী ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে এবং দুর্নীতির বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ আদালত স্থাপন করতে হবে।
২. সরকারি ও বেসরকারি আমলাতন্ত্রের সব পর্যায়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও তথ্য লাভের অধিকার সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন এবং একে শক্তিশালী করতে হবে।
৪. বাক স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৬. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
৭. সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের আয় - ব্যয়ের হিসাব - নিকাশ (নিরীক্ষা) নিয়মিতভাবে পরীক্ষা (audit) করতে হবে।
৮. দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তি ও কর্মীদের পুরস্কৃত করে উৎসাহ দিতে হবে এবং যারা অসৎ, দুর্নীতিবাজ তাদেরকে তিরস্কৃত করতে হবে , শাস্তি দিতে হবে। প্রয়োজনে কর্ম থেকে অপসারিত করতে হবে।
৯. বেতনভুক্ত কর্মচারীদের যুক্তিযুক্ত বেতন - ভাতা দিতে হবে।
১০. প্রশাসন ও জনসাধারণের মধ্যে প্রকৃত গণতন্ত্র তথা গণতান্ত্রিক চেতনা তৈরি করতে হবে। কারণ গণতন্ত্রেই মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা স্বীকৃত। বিশেষকরে গণতান্ত্রিক সরকারই দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক সরকার।
১১. সরকারি প্রশাসনের নিয়োগ পদ্ধতি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হতে হবে, যাতে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নিয়োগ লাভের সুযোগ পায়।
১২. সর্বস্তরে e - governance (ইলেকট্রনিক শাসন) চালু করতে হবে।
১৩. শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে নৈতিক শিক্ষা সম্পর্কে পাঠ পরিবর্ধিত ও আকর্ষণীয় করতে হবে এবং দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণা অব্যাহত রাখতে হবে। বিভিন্ন ধর্মে দুর্নীতিবিরোধী যেসব নীতি কথা রয়েছে সেগুলোও প্রচার করতে হবে। নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ কখনো কোনো অনৈতিক কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারে না।
১৪. প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই দুর্নীতিবিরোধী কর্মসূচি ও অঙ্গীকার থাকতে হবে।