ভূমিক্ষয়ের কারণ || Causes of Soil Erosion

ভূমিক্ষয় কি?
মাটির ক্ষয় হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মাটির উপরের স্তরটি প্রাকৃতিক শক্তি যেমন জল, বাতাস, বরফ বা মানুষের ক্রিয়াকলাপের দ্বারা তার আসল অবস্থান থেকে সরানো বা স্থানচ্যুত হয়। এটি একটি প্রাকৃতিক ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া যা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ঘটছে, কিন্তু মানুষের ক্রিয়াকলাপগুলি অনেক ক্ষেত্রে এটিকে উল্লেখযোগ্যভাবে ত্বরান্বিত করেছে এবং আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ভূমিক্ষয়ের কারণ

মৃত্তিকা ক্ষয় শব্দের উৎপত্তি
"মাটির ক্ষয়" শব্দের উৎপত্তি ইংরেজি ভাষায়, প্রতিটি শব্দের অর্থে অবদান রয়েছে:
1. "মাটি": "মাটি" শব্দটি জৈব পদার্থ, খনিজ পদার্থ, জল এবং বায়ুর মিশ্রণের সমন্বয়ে পৃথিবীর পৃষ্ঠের উপরের স্তরকে বোঝায়। এটি এমন একটি মাধ্যম যেখানে গাছপালা বৃদ্ধি পায় এবং এটি কৃষি ও প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য।

2. "ক্ষয়": "ক্ষয়" শব্দটি ল্যাটিন শব্দ "ইরোসিও" থেকে এসেছে, যার অর্থ "দূরে যাওয়া" বা "দূর হয়ে যাওয়া"। মাটি ক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে, এটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে বোঝায় যার মাধ্যমে বাতাস, জল বা অন্যান্য পরিবেশগত কারণগুলির ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে মাটি ধীরে ধীরে তার আসল অবস্থান থেকে জীর্ণ বা সরানো হয়।

"মাটির ক্ষয়" শব্দটি বিভিন্ন প্রাকৃতিক এবং মানব-প্ররোচিত কারণ যেমন বৃষ্টিপাত, বায়ু, বন উজাড়, কৃষি এবং নির্মাণ কার্যক্রমের কারণে মাটির মূল অবস্থান থেকে ধীরে ধীরে অপসারণ এবং স্থানচ্যুতির প্রক্রিয়াকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়। মৃত্তিকা ক্ষয় পরিবেশ, কৃষি এবং জমির উৎপাদনশীলতার উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে, এটি মৃত্তিকা বিজ্ঞান এবং পরিবেশগত গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা তৈরি করে।

ভূমিক্ষয় কত প্রকার?
ভূমিক্ষয় মূলত দুটি প্রকারে থাকে - ন্যাচারাল ভূমিক্ষয় এবং মানুষ উদ্ভিদ্ধ ভূমিক্ষয়। 
1. ন্যাচারাল ভূমিক্ষয়: এই ধরণের ভূমিক্ষয় প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে বুঝে তোলে, যেটি নিস্তেজভাবে ঘটে এবং মানুষের সাহায্য নেয় না। উদাহরণ হলো ভূমিক্ষণ যেখানে প্রাকৃতিক ঘটনার ফলে ভূমি আপেক্ষিকভাবে সম্পর্কিত ভাবে বেড়ে আসে, যেমন ভূমিস্পর্শ বা ভূমিসূষণ।

2. মানুষ উদ্ভিদ্ধ ভূমিক্ষয়: এই ধরণের ভূমিক্ষয় মানুষের প্রযুক্তি এবং নগর উন্নতির ফলে সৃষ্টি হয়। মানুষ নির্মিত গৃহস্থলী, সড়ক, স্থানীয় উন্নতি প্রকল্প, উদ্যান, উদ্যান এবং প্রযুক্তি সহ মূলত মানুষের কার্য এবং সৃষ্টি হয়।

মানুষ উদ্ভিদ্ধ ভূমিক্ষয় এই দুটি প্রকারের ভূমিক্ষণের সাথে যোগ করে ব্যবহার করতে পারে এবং প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলির সাথে সংঘটিত হতে পারে, যেটি নির্মিত সড়ক, প্রায়োজনীয় সেবা প্রদান, জলাশয় পরিচর্যা, এবং অন্যান্য সাধারণ মানুষ উদ্ভিদ্ধ ভূমিক্ষয়ের সাথে মিলে একটি পূর্ণাঙ্গ উন্নতি প্রক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।


ভূমিক্ষয় বেশি হয় কেন? 
ভূমিক্ষয়ের বেশি হয় কারণ এটি বিভিন্ন কারণের সমন্বয়ে ঘটে থাকে। এই কারণগুলি নিম্নরূপ:
1. জলবায়ু পরিবর্তন: জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে সার্থক ভূমিক্ষয় ঘটে। উচ্চতা বা নিম্নতা, তাপমাত্রা, বৃষ্টির পরিমাণ, এবং আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে ভূমিক্ষয় বেশি হয়। যেমন, বর্ষা সময়ে ভূমিক্ষয় বেশি হয় কারণ বৃষ্টি প্রবাহ এবং বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে যায়।

2. ভূমির স্থানীয় প্রকৃতি: ভূমির স্থানীয় প্রকৃতির মধ্যে সম্পূর্ণ তথ্য বা সংস্কৃতি এবং ঐতিহাসিক ঘটনার কারণে ভূমিক্ষয় বেশি হয় সময়ের সাথে। এই প্রকৃতি এবং ঐতিহাসিক কারণগুলি ভূমিক্ষয়ের চেয়ে একটু অধিক উচ্চ জোটে আসতে পারে।

3. তথ্য এবং প্রযুক্তির উন্নতি: তথ্য ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে ভূমিক্ষয় বেশি হয় কারণ মানব সমাজের জনসংখ্যা বেড়ে যায় এবং নগরীকরণ সম্পূর্ণ দেশগুলিতে বেড়ে চলে। বেড়ে চলা সংখ্যা মানব সমাজের জনসংখ্যা বেড়ে যায়, যা সাথে সাথে জমির প্রতি জনসংখ্যা এবং ভূমিক্ষয়ের জরুরি প্রয়োজনকে বাড়িয়ে দেয়।

4. উন্নত নাগরিক জীবনধারা: উন্নত নাগরিক জীবনধারা পূর্ণমানে সরকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা, বাজার এবং নেটওয়ার্ক সেবা প্রদান করে তাদের জীবন সহজ করে দেয় এবং সমাজে উন্নত জীবনধারা এবং কাজের সুযোগ প্রদান করে। এই উন্নত নাগরিক জীবনধারা কারণে লোকেরা সহজেই শহরে বসে থাকতে পারে এবং ভূমিক্ষয়ের দিকে চলে আসতে থাকে।

এই কারণগুলির সমন্বয়ে ভূমিক্ষয় বেশি হয়। সমৃদ্ধি এবং সাংখ্যিক বৃদ্ধি সাথে সাথে জমির প্রতি চাহিদা বেড়ে যায়, এবং এই চাহিদা সমন্বয়ে সাপেক্ষে ভূমিক্ষয়ের বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়। 

ভূমিক্ষয়ের কারণ
ভূমিক্ষয়ের প্রধান প্রধান কারণ উল্লেখ করা হলো— 
১. বৃষ্টিপাত ও সেচ (Rainfall or precipitation and irrigation): বৃষ্টিপাত চাষাবাদের জন্য যেমন আবশ্যক আবার ভূমিক্ষয়েরও প্রধান কারণ। বৃষ্টিপাতের সংখ্যা ও পরিমাণ ভূমিক্ষয়কে প্রভাবিত করে। মুষলধারে বৃষ্টি হলে বৃষ্টির ফোঁটা বড় হয় এবং মাটিতে সজোরে আঘাত করে মাটির কথা আলগা করে দেয়। মাটি যখন পানি শোষণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। 
তখন অতিরিক্ত পানি প্রবাহ সৃষ্টির মাধ্যমে পানি উপর থেকে নিচের দিকে ধাবিত হয়। এই যাওয়ার পথে পানির সঙ্গে নরম মাটি স্থানান্তরিত হয় । আবার অভ্যধিক পানি সেচের ফলে অতিরিক্ত পানি অপসারণ বা নিষ্কাশনের সঙ্গে উপরের আলপা মাটি মিশে অপসারিত হয়। পানির বেগ যত বেশি হবে মাটির ক্ষয়ও তত বেশি হবে।

২. ভূমির ঢাল (Land slope): অধিক চালু মাটিতে ও ঢালের দৈর্ঘ্য বেশি হলে অধিক বেগে পানি নিচের দিকে ধাবিত হয় । বাংলাদেশের বান্দরবান , খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি এলাকায় জুম পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। ফলে জুম চাষের মাটি আলগা হয় এবং বৃষ্টিপাতের ফলে এই মাটি বৃষ্টির পানির সাথে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে চলে যায় । কয়েক বছরের মধ্যে জুম চাষের জমি অনুর্বর হয়ে পড়ে।

৩. মাটির প্রকৃতি (Nature of soil): বেলে - দোআঁশ মাটিতে সচ্ছিদ্রতা বেশি বলে বৃষ্টির পানি দ্রুত শুষে নিতে পারে। তাই এই মাটির ভূমিক্ষয় কম। কিন্তু জৈব পদার্থহীন , কাদা ও ভারী মাটির সচ্চিদ্রতা কম থাকায় এর শোষণ ক্ষমতাও কম। তাই সামান্য বৃষ্টি হলেও মাটির উপরে পানি জমে যায় এবং ভূমির ক্ষয় করে মাটিসহ নিচের দিকে ধাবিত হয়।

৪. শস্যের প্রকৃতি (Nature of crop plants): স্বল্প শিকড় ও অম্ল পাতাযুক্ত ফসল যেমন- আখ, ভুট্টা চাষ করলে মাটির উপরিভাগ অনাবৃত থাকায় ভূমিক্ষয় হয়। যেসব ফসল মাটি ঢেকে রাখে, সেগুলো মাটিকে ক্ষয়ের করল থেকে রক্ষা করে। যেমন— চিনাবাদাম, মাসকালাই, খেসায়ি ইত্যাদি সবুজ সার ফসল ও আচ্ছাদন ফসল।

৫ . জমি চাষের পদ্ধতি (Land tilling practices): পাহাড়ি জমিতে ঢালের বাবর না করে আড়াআড়ি চাষ করলে ভূমিক্ষয় কম হয় । খাড়া পাহাড়ের গায়ে ধাপ বা সোপান সৃষ্টি করে ফসলের চাষ করা হয়।

৬. ফসল চাষের নিবিড়তা (Cropping intensity): ফসল চাষের নিবিড়তা বেশি হলে ভূমিক্ষয়ের আশংকা বেড়ে যায় । কোনো জমিতে বছরে ১ টি ফসল চাষের পরিবর্তে ৩ টি ফসল (ফসল চাষের নিবিড়তা ৩০০%) চাষ করলে ভূমিক্ষয়ের আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়।

৭. হিমবাহ্ (Glacier): হিমবাহ প্রবাহের সময় পার্বত্য অঞ্চলের ভূমির উপরিভাগ আলগা হয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হারে ভূমিক্ষয় হয়।

৮. বায়ুপ্রবাহ (Wind flow): যে অঞ্চলে গাছপালা কম সে অঞ্চলে বায়ুপ্রবাহ দ্বারা ভূমিক্ষয় হয়। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে এরূপ বায়ুপ্রবাহ ঘটিত ভূমিক্ষয় হয়।

৯ . মানুষের কার্যাবলি (Human intervention): 
i. ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বাসস্থান নির্মাণের কারণে বনজজান ও কৃষিজমি বিনষ্ট হচ্ছে। 
ii. অপরিকল্পিত চাষাবাদ , জুম চাষ , পশুচারণ প্রভৃতি কারণে মাটি জনাবৃত হয়ে ভূমিক্ষয় ত্বরান্বিত হয়।
iii.যানবাহন ( যেমন-মহিষের গাড়ি) চলাচল প্রক্রিয়ায় পরোক্ষভাবে মাটি ক্ষয় হয়। 
iv. মাঠ কিংবা ফসলি জমি কেটে রাস্তাঘাট নির্মাণ করায় ভূমিক্ষয় হয়। 
v . বিভিন্ন এলাকায় বেড়ি বাঁধ নির্মাণের কারণে ভূমিক্ষয় ত্বরান্বিত হয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url