ফরায়েজি আন্দোলন || Faraji Movement

 ফরায়েজি আন্দোলন 

আরবি শব্দ 'ফরজ' থেকে 'ফরায়েজি শব্দের উৎপত্তি , যার অর্থ আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত মুসলমানদের জন্য অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। ফরায়েজি আন্দোলনে মুসলমানদেরকে অনৈসলামিক কার্যকলাপ পরিহার করে ফরজের ভিত্তিতে জীবন পরিচালনার নির্দেশ প্রদান করা হয়। এজন্যই এ আন্দোলনের নাম হয় ফরায়েজি। 

তখনকার মুসলমান সমাজে পিরপূজা, কবর পূজা , মনসা পূজা , শীতলা পূজা , দরগায় মানত , মহররমে অতি উচ্ছ্বাস ইত্যাদি অনৈসলামিক আচার - অনুষ্ঠান ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। মুসলমানদের এসব ধর্মীয় কুসংস্কার ও অনাচার হাজী শরীয়তউল্লাহকে বিচলিত করে। তিনি এসব পালনের ঘোর বিরোধিতা করেন এবং ইসলামে যেসব ফরজ কাজ রয়েছে যেমন মুখে কালিমা বলা, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কায়েম করা, রমজান মাসে রোজা রাখা, জাকাত দেওয়া, হজ করা এবং অন্যান্য ইসলামি নিয়ম - নীতি পালনের জন্য মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করেন। 

বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে মুসলমান সমাজে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে চরম দুর্দশা নেমে আসে। এই কোম্পানি মুসলমানদের সেনা, রাজস্ব ও বিচার বিভাগ এবং অন্যান্য চাকরি থেকে বিতাড়িত করার ফলে অজস্র মুসলিম পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চড়া খাজনা আদায় ছাড়াও জমিদার, নায়েব, গোমস্তা, সরকারি কর্মচারীরা নানা ধরনের অত্যাচারের মাধ্যমে কৃষক সমাজকে পঙ্গু করে দেয়। ব্রিটিশ আমলে পূর্ব বাংলার জমিদারদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল হিন্দু। আর প্রজারা অধিকাংশ ছিল গরিব মুসলিম কৃষক। জমিদাররা প্রজাদের ওপর অবৈধভাবে নানাপ্রকার কর ধার্য ও আদায় করত। 

অন্যদিকে ইংরেজরা ‘বাজেয়াপ্ত নীতির' দ্বারা কোটি কোটি টাকা মূল্যের নিষ্কর জমি বাজেয়াপ্ত করায় সম্ভ্রান্ত অনেক পরিবার ধ্বংস হয়। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অর্থনীতি ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুসলমানরা পিছিয়ে পড়ে।

হাজী শরীয়তউল্লাহ মুসলমানদের এই অধঃপতিত অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস চালান। তৎকালীন মুসলিম সমাজে যে 'আশরাফ আতরাফ' (উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণির মুসলিম) বিভাজন ছিল, তিনি তার বিরোধী ছিলেন। তিনি বলেন, সকল মুসলমান ভাই ভাই। শ্রেণিভেদ মাত্রই কুসংস্কার। শরীয়তউল্লাহ আরও বলতেন সকল জমির মালিক সৃষ্টিকর্তা। তাই তিনি জমিদারদের অবৈধ খাজনা না দেওয়ার জন্য মানুষকে আহ্বান জানান। হাজী শরীয়তউল্লাহর বক্তব্য নিম্নবিত্ত মানুষকে আকৃষ্ট করে। ফলে শরীয়তউল্লাহর নেতৃত্বাধীন ফরায়েজি আন্দোলন নিম্নবিত্ত মুসলিম শ্রেণির মধ্যে বিস্তার লাভ করে। জমিদার শ্রেণি এই আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করে। হাজী শরীয়তউল্লাহর জীবদ্দশায় এই আন্দোলন ফরিদপুর , বরিশাল, ঢাকা, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। শরীয়তউল্লাহর মৃত্যুর পরে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র মুহসীনউদ্দিন ওরফে দুদু মিয়া। 

ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যান্য কয়েকটি বৃহৎ গণসংগ্রামের মতো ফরায়েজি আন্দোলন ধর্মীয় বিষয় নিয়ে শুরু হলেও তা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সংগ্রামে পরিণত হয়েছিল। ফরায়েজি আন্দোলন জমিদার - মহাজন' , 'নীলকর' , 'ইংরেজ শাসন শোষণের এই তিন প্রধান স্তন্ত্রের ওপর আঘাত করে। কৃষক, জনসাধারণ তাদের সেই ধর্মীয় জাগরণকে বাজনৈতিক স্তরে উন্নীত করেছিল। প্রথমে ইসলাম ধর্মের সংস্কার আন্দোলনরূপে শুরু হলেও ফরায়েজি আন্দোলন কেবল মুসলমান জনসাধারণকে সংঘবদ্ধ ও সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেনি, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে স্থানীয় হিন্দু কৃষকদের একটি বৃহৎ অংশকেও সংগ্রামে টেনে আনতে পেরেছিল এবং আন্দোলনের ক্ষেত্রে হিন্দু - মুসলমানের মধ্যে কিছুটা হলেও ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। 

ফরায়েজি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য 

১. মুসলমান সমাজ থেকে কুসংস্কার দূরীকরণ: শরীয়তুল্লাহর সময় বাংলার মুসলমানদের একটি অংশ বহু স্থানীয় লোকাচার ও পর্ব - উৎসব পালনে উৎসাহী হয়ে ইসলামের মৌলিক শিক্ষার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছিল। সমাজে শ্রেণি ও বর্ণগত ব্যবধানসহ অনেক বদ্ধমূল অনৈসলামিক কুসংস্কারও ছিল। এ কারণেই তিনি ইসলামের প্রকৃত আদর্শের প্রতি তাদের মনোযোগী করতে ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেন। শরীয়তুল্লাহ ইসলামের মূল বিশ্বাস বা মতবাদ থেকে যে কোন বিচ্যুতিকে 'শিরক' ও 'বিদাত' বলে ঘোষণা করেন।

২. ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন : শরীয়তুল্লাহ বলেন, ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভারতবর্ষের মুসলমানগণ সত্যিকার ইসলামি বিধানমত জীবনযাপন করতে পারবে না। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশকে 'দারুল হারব' বা (বিধর্মীর রাজ্য) বলে ঘোষণা করেন। 'দারুল হারবে' জুমার নামাজ ও ঈদের নামাজ পড়া নাজায়েজ বলে ঘোষণা দেন তিনি। কারণ জুমার নামাজ ও ঈদের নামাজের খুৎবায় নিজের দেশের শাসকের নামে খুৎবা পড়তে হয়। শ্রীয়তুল্লাহ এই ঘোষণায় সরাসরি কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য না থাকলেও বলা যায়, এতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বীজ নিহিত ছিল। 

৩. জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে আন্দোলন: শরীয়তউল্লাহ কেবল ধর্মীয় সংস্কার করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি তার শিষ্যদেরকে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য উৎপীড়নের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। জমিদার ও নীলকরদের শোষণ - উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য তায় ধর্মীয় প্রচারের মধ্যেই চলত। তিনি মুসলমানদেরকে হিন্দু জমিদার কর্তৃক গো - হত্যার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করতে বলেন। এছাড়া হিন্দু জমিদারদের আরোপিত অথচ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত নয় এমন বহু অতিরিক্ত আবওয়া (অবৈধ কর) , আলিপূজা, দুর্গাপূজা। ইত্যাদি অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য মুসলমান কৃষকদের ওপর আরোপিত কর দিতে নিষেধ করেন। 

৪. লাঠিয়াল বাহিনী গঠন: ১৮৩১ সালে হাজী শরীয়তউল্লাহ যখন ঢাকা জেলার নয়াবাড়ীতে ডান দলীয় প্রচার কাজ চালাচ্ছিলেন তখন হিন্দু জমিদারদের সাথে তার বিরোধ রায়ে। এ সময় সংস্কারবিরোধী কিছুসংখ্যক মুসলমানও তার বিরোধিতা করে। তাই অত্যাচারী জমিদারদের হাত থেকে অনুসারীদের রক্ষা করার জন্য তিনি একটি লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করেন। এতে জমিদার শ্রেণি তার ওপর আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

৫. অঞ্চলভিত্তিক আন্দোলন: ১৮৩৮ সালে হাজী শরীয়তউল্লাহ ঢাকা, পাবনা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চলে ফরায়েজি আন্দোলনের আঞ্চলিক সংগঠন গড়ে তোলেন। তার এই আন্দোলন মুসলমানদের মধ্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করে। কিন্তু তিনি বেশি দিন প্রচারকার্য চালাতে পারেননি। কারণ জমিদার , ইংরেজ শাসক ও মুসলমান সমাজের একাংশের বিরোধিতা।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url