ভূমিকম্পের ধারণা || Concept of earthquake

ভূমিকম্পের ধারণা 
ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। পৃথিবীর বহু দেশে এবং বহু অঞ্চলে এই প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সভ্যতার বহু ধ্বংসলীলার কারণ হিসেবে ভূমিকম্পকে দায়ী করা হয়। ধারণা করা হয় , গত ৪,০০০ বছরে ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলায় পৃথিবীর প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ লোক মারা গেছে । নানা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ভূপৃষ্ঠ পরিবর্তিত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে , ভূত্বকের নিচের অংশে তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলো থেকে তাপ বিচ্ছুরিত হয়। এই তাপ সঞ্চিত হয়ে পৃথিবীর অভ্যন্তরে পরিচলন স্রোতের সৃষ্টি হয় এবং সেখানে প্রবল শক্তি উৎপন্ন হয়ে ভূত্বকের বিভিন্ন অংশে আলোড়ন ও পরিবর্তন সাধন করছে। অভ্যন্তরীণ শক্তি দ্বারা ভূত্বকের এই পরিবর্তন আকস্মিক প্রক্রিয়া ও ধীর প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়। আকস্মিকভাবে পরিবর্তনকারী শক্তির মধ্যে ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরি প্রধান । কখনো কখনো ভূপৃষ্ঠের কতক অংশ হঠাৎ কোনো রণে কেঁপে ওঠে । এ কম্পন অত্যন্ত মৃদু থেকে প্রচণ্ড হয়ে থাকে, যা মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয়। ভূপৃষ্ঠের এরূপ আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পনকে ভূমিকম্প বলে। ভূঅভ্যন্তরের যে স্থানে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয় তাকে ভূমিকম্পের কেন্দ্র (Focus) বলে। কেন্দ্রের ঠিক সোজাসুজি উপরের ভূপৃষ্ঠের নাম উপকেন্দ্র (Epicenter)। কম্পনের বেগ উপকেন্দ্র হতে ধীরে ধীরে চারিদিকে কমে যায়।
ভূমিকম্পের ধারণা
ভূমিকম্পের কারণ 
ভূমিকম্পের কারণ অনুসন্ধানকালে বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেন পৃথিবীর বিশেষ কিছু এলাকায় ভূকম্পন বেশি হয় । এ সমস্ত এলাকায় নবীন পর্বতমালা অবস্থিত। পৃথিবীর ব্যবচ্ছেদে দেখা যায় যে ভূ - ত্বক ৮ টি বড় বড় টুকরা এবং ৬ টি আঞ্চলিক টুকরা দ্বারা বিভক্ত। এগুলো টেকটনিক প্লেট নামে পরিচিত । ভূ - পৃষ্ঠে যেসব কারণে ভূমিকম্প হয়ে থাকে তার মধ্যে অন্যতম হলো এই প্লেটগুলোর বিভিন্ন রকমের স্থানান্তর বা বিচ্যুতি । এছাড়াও অন্য যেসব কারণে ভূমিকম্প হয় তা নিম্নরূপ:
ভিত্তিশিলা চ্যুতি বা ফাটল বরাবর আকস্মিক ভূআলোড়ন হলে ভূমিকম্প হয়। আগ্নেয়গিরির লাভা প্রচণ্ড শক্তিতে ভূঅভ্যন্তর থেকে বের হয়ে আসার সময়ও ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। ভূত্বক তাপ বিক্রিরণ করে সংকুচিত হলে ভূ - নিম্নদ্ধ শিলাস্তরে ভারের সামঞ্জস্য রক্ষার্থে ফাটল ও ভাঁজের সৃষ্টির ফলে ভূকম্পন অনুভূত হয় । ভূ - আলোড়নের ফলে ভূত্বকের কোনো স্থানে শিল্পা ধসে পড়লে বা শিল্পাচ্যুতি ঘটলে ভূমিকম্প হয়। এছাড়াও পাশাপাশি অবস্থানরত দুটি প্লেটের একটি অপরটির সীমানা বরাবর তলদেশে ঢুকে পড়ে অথবা অনুভূমিকভাবে আগে - পিছে সরে যায়। এ ধরনের সংঘাতপূর্ণ পরিবেশে ভূমিকম্প সংঘটিত হয়।

ভূমিকম্পের ফলাফল 
ভূমিকম্পের ফলে পৃথিবীতে বহু পরিবর্তন ও ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। ভূমিকম্পের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ফল সম্বন্ধে নিচে আলোচনা করা হলো। ভূমিকম্পের ফলে ভূত্বকে অসংখ্য ফাটল এবং চ্যুতির সৃষ্টি হয়। কখনো সমুদ্রতলের অনেক স্থান উপরে তেলে ওঠে। আবার কখনো স্বলভাগের অনেক স্থান সমুদ্রতলে ডুবে যায়। অনেক সময় নদীর গতি পরিবর্তিত বা বন্ধ হয়ে যায়। ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে পর্বতগাত্র থেকে বৃহৎ বরফখণ্ড হঠাৎ নিচে পতিত হয় এবং পর্বতের পাদদেশে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। ভূমিকম্পের ধাক্কায় সমুদ্রের পানি তীব্র থেকে নিচে নেমে যায় এবং পরক্ষণেই ভীষণ গর্জন সহকারে ১৫-২০ মিটার উঁচু হয়ে ঢেউয়ের আকারে উপকূলে এসে আছড়ে পড়ে। এ ধরনের জলোচ্ছ্বাসকে সুনামি বলে। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভূকম্পনের ফলে সৃষ্ট সুনামির আঘাতে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, ভারত প্রভৃতি দেশে ব্যাপক জান-মালের ক্ষতি হয়। ভূমিকম্পের ফলে কখনো উচ্চভূমি সমুদ্রের পানিতে নিমজ্জিত হয়। আবার কখনো সমুদ্রের তলদেশের কোনো স্থান উঁচু হয়ে সমুদ্রে দ্বীপের সৃষ্টি করে।

ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে ভূপৃষ্ঠে অনুভূমিক পার্শ্বচাপের প্রভাবে কঁচকে তাঁজের সৃষ্টি হয়। ভূমিকম্পের ফলে পার্বত্য অঞ্চল থেকে ধস নেমে নদীর গতি রোধ করে হ্রদের সৃষ্টি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দুর্ভিক্ষ ও মহামারিতে বহু প্রাণহানি ঘটে। ভূমিকম্পে রেলপথ , সড়কপথ , পাইল লাইন প্রভৃতি ভেঙে যায় এবং যাতায়াত ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে । টেলিফোন লাইন , বিদ্যুৎ লাইন প্রভৃতি ছিঁড়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সমুদ্রের তলদেশে প্রবল ভূমিকম্প সংঘটিত হলে ভূপৃষ্ঠের বড় বাঁধ , কালভার্ট , সেতু প্রভৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়াও অনেক সময় সুনামির সৃষ্টি হয়।


ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের পদক্ষেপ
যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঠিক পূর্বাভাস ক্ষয়শ্রুতির হার কমাতে সাহায্য করে। বিশেষ করে দুর্যোগের উৎপত্তির স্বপ্ন , সময় , স্বায়িত্বকাল এবং এর শক্তিমাত্রা ও সম্ভাব্য কবলিত এলাকা সম্পর্কে সঠিক পূর্বাভাস বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য দুর্যোগের চেয়ে ভূমিকম্পের প্রকৃতি আলাদা। এটি অকস্মাৎ সংঘটিত হয় , খুবই ক্ষণস্থায়ী এবং ভূঅভ্যন্তরে ঘটে থাকে। ফলে সরাসরি পর্যবেক্ষণের কোনো সুযোগ নেই। তারপরেও কিছু পদক্ষেপ নিলে ভূমিকম্প অনুমানে সহায়ক হবে, জানমালের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা হ্রাস করা যাবে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন , যে সমস্ত অঞ্চলে গত ১০০ বছরে ভূমিকম্প হয়নি অথচ সাধারণভাবে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত , সেখানে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা খুব বেশি। এগুলোর মধ্যে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া , মধ্য জাপান , মধ্য চিলি , তাইওয়ান এবং সুমাত্রার পশ্চিম উপকূল উল্লেখযোগ্য । এ সমস্ত অঞ্চলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে রিখটার মান - এ উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা আছে । ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নিলে ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়।

বাড়ি তৈরির সময় মাটি পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীর পরামর্শ নিয়ে বাড়ির ভিত মজবুত করতে হবে। বাড়ি তৈরির সময় দুটি বাড়ির মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব রাখতে হবে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার একাধিক পথ রাখতে হবে এবং বহুতল ভবনে জরুরি সিঁড়ি রাখতে হবে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন ত্রুটিমুক্ত রাখতে হবে। বাড়ির আসবাবপত্র যথাসম্ভব কাঠের হওয়া ভালো। প্রতিটি বাড়িতে সদস্যদের জন্য হেলমেট রাখতে হবে।  ভূমিকম্পের সময় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সুইচ বন্ধ রাখতে হবে। তাড়াহুড়া না করে খোলা জায়গায় আশ্রয় নিতে হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url