আরবজাতি || Arab Nation
আরবজাতির ধারণা
আরবভূমির প্রাচীন অধিবাসীদের সম্পর্কে কোনো সঠিক ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া না গেলেও এ কথা ঠিক যে , ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আরব দেশে বিভিন্ন জাতির লোক বসতি স্থাপন করেছিল।
ঐতিহাসিক আমীর আলীর মতে– “প্রাচীন কালদীয় জাতি যে বংশ হতে উদ্ভূত আরবের পূর্বতন অধিবাসীরাও সে বংশোদ্ভূত বলে কথিত হয়।"
অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে – প্রাচীন জাতি ও ভাগে বিভক্ত ছিল। যথা- (১) আদিম আরব, (২) মূল আরব এবং (৩) মুস্তারব।
আদিম আরবজাতি
এরা ৫ ভাগে বিভক্ত ছিল। যথা— আদ বংশ, ছামুদ বংশ, ভাছা ও জাদিম বংশ, জারহাম বংশ এবং আসালিকা বংশ।
হাযরামাউতের অধিবাসী ছিল আদ বংশ। এ বংশ হ্রদ (আ) নবির আমলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ছামুদ বংশ মত্তা নগরীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। এরা হজরত নূহ (আঃ) -এর প্রপৌত্র সালেহ (আ.) নবির সময় মহান আল্লাহর গজবে বিলীন হয়ে যায়। তাছম ও জাদিম বংশদ্বয় পরস্পর বিবাদ ও গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নিজেদের কবর রচনা করে। জারহাম বংশের বংশধররা সরকালের মধ্যে অযোগ্যতার কারণে আরব ভূখণ্ড থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আসালিকা বংশ প্রাচীন আরবে একটি শক্তিশালী সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। তারা দক্ষিণ মিশরও অধিকার করে সেখানে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এদের দলপতি ওয়ালিদই সর্বপ্রথম ফেরাউন নামের উদ্ভাবন করেন। বর্তমানে এদের কোনো বংশধরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
মূল আরব: মূল বা আদি আরবগণ ছিল কাতানের বংশধর। কাহতানের জারহাম ও ইয়ারব নামক দুই পুত্র ছিল। জারহাম ছিলেন হেজাজের এবং ইয়ারব ছিলেন ইয়ামানের শাসক। ইয়ারবের দুই প্রপৌত্র হাপীর ও খালান এবং তাদের বংশধরগণ মহানবির (স) জন্মের ৭০ বছর পূর্ব সময়কাল পর্যন্ত ইয়ামানের শাসনকার্য পরিচালনা করেন।
মুস্তারব: বহিরাগতরা ইতিহাসে মুস্তারব নামে অভিহিত হতো। তারা বাবেলের সিরিয়ার নিকটবর্তী স্থানের অধিবাসী হযরত ইব্রাহিম (আ) -এর পুত্র ইসমাইল (আ) -এর বংশধর ছিলেন। ইসমাইল (আ) -এর ৫৮ তম অধঃস্তন পুরুষ আল্ - ফিহরের অন্য নাম ছিল কুরাইশ। সে নাম হতেই কুরাইশ বংশ নামের উৎপত্তি ঘটে। আরবের অধিবাসী আরব ভূখণ্ডের ভূপ্রকৃতির তারতম্যের কারণে সে দেশের অধিবাসীদেরকে দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা— (১) শহরের স্থায়ী বাসিন্দা ও (২) যাযাবর বা বেদুইন।
শহরের স্থায়ী বাসিন্দা (শহরবাসী): হাজরামাউড, ইয়েমেন ও ওমান নিয়ে গঠিত দক্ষিণ আরবের উর্বর অঞ্চলগুলোতে প্রাচীন আরবের জনপদ গড়ে উঠেছিল। এ অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দারা কৃষিকার্য ও ব্যবসা - বাণিজ্য করে কালাতিপাত করতো। তারা অনেকটা সভ্য জীবন যাপন করতো। এ সকল স্থায়ী বাসিন্দারা শহরবাসী নামেও অভিহিত হতো। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে বহির্বাণিজ্য ও সংযোগ স্থাপন করেছিল।
যাযাবর: ৮০% মরুবাসী আরব যাযাবর (আহল উল বাদিয়া) বা বেদুইন নামে আখ্যায়িত হতো। তারা পরিবারবর্গ, উট, ভেড়া ও ঘোড়ার খাদ্যের সন্ধানে একস্থান হতে অন্যস্থানে ঘুরে বেড়াত। স্বাধীনচেতা, বেপরোয়া ও দুর্ধর্ষ যাযাবরদের কোনো প্রকার স্থায়ী ঘর - বাড়ি ছিল না। শিক্ষার ও লুণ্ঠন ছিল তাদের পেশা। জনৈক ঐতিহাসিক বলেন, “তাদের গৃহ ছিল তাঁবু; আহার্য ছিল উটের মাংস; পানীয় ছিল উট ও ছাগলের দুধ; আর জীবিকা ছিল লুটতরাজ।
ইতিহাসে গোত্রপ্রীতি ও যুদ্ধপ্রীতির জন্য তারা ছিল বিখ্যাত। বেদুইন আরবদের জাতীয়তাবোধ ও স্বদেশানুরাগ বলতে গোত্রপ্রীতিই বুঝাত। গোত্র প্রথাই ছিল বেদুইন সমাজের মূল ভিত্তি । প্রতিটি তাবু একটি পরিবার; কয়েকটি পরিবারের সমন্বয়ে একটি হেই (hayy) নামক সংগঠন; এরূপ কয়েকটি হেই - এর সংমিশ্রণে একটি গোত্র (qawm, a clan) এবং কিছুসংখ্যক গোত্রের সমন্বয়ে একটি জাতি (qabilah) গঠিত হতো। প্রতিটি গোত্র বয়স, জ্ঞান - বুদ্ধি, বীরত্ব ও সাহসের ভিত্তিতে একজন শেখ বা গোত্রপতি নির্বাচন করতো। শেখ পারিবারিক প্রধানদের সমন্বয়ে গঠিত গোত্রীয় পরিষদের সাথে পরামর্শ করে গোত্রের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।
ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, “বেদুইন সমাজের ভিত্তি হচ্ছে গোত্রীয় সংগঠন। আর আসাবিয়াহ ( কৌম চেতনা ) হচ্ছে তাদের গোত্রের মূলমন্ত্র।"
স্বজনপ্রীতি, গণতন্ত্রপ্রীতি, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বোধ, অতিথিপরায়ণতা ইত্যাদি ছিল বেদুইন চরিত্রের মহান গুণাবলি। রক্তের পবিত্রতা, কবিতা ও বাগ্মিতা, তরবারি ও ঘোড়া, সর্বোপরি পূর্বপুরুষদের আভিজাত্য ও বীরত্ব ছিল তাদের গর্বের বিষয়বস্তু।
আরবদেশ ও আরববাসীর বৈশিষ্ট্য আরবদেশের বৈশিষ্ট্য
আরব উপদ্বীপ একটি বিশাল ও বিস্তৃত মালভূমি। এ উপদ্বীপের পশ্চিম প্রান্ত অন্যান্য অংশ বা অঞ্চল হতে অনেক উঁচু। এদেশের ভূখণ্ড পশ্চিম হতে পূর্বদিকে ব্রুমনিম্ন ঢালু ভূমি দ্বারা গঠিত। মধ্য আরবে কিছুসংখ্যক পর্বতশৃঙ্গ পরিদৃষ্ট হয়। এগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৪০০০ হতে ৬০০০ ফুট উঁচু। মরুময় এ আরব ভূখণ্ডের জলবায়ু সর্বত্র উষ্ণ। এদেশে নাব্য নয় এরূপ ইতস্তত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছুসংখ্যক নদ - নদী ও ওয়াদি রয়েছে। ভূমি অনুর্বর। কেবলমাত্র মরূদ্যান এবং উপকূল ভাগ অপেক্ষাকৃত উর্বর।
ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের জন্য এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের মিলনকেন্দ্রে অবস্থান করেও এদেশ যেন সমগ্র বিশ্ব হতে বিচ্ছিন্ন । আরব ভূখণ্ডের এক তৃতীয়াংশ মরুময়। উত্তর ভাগে 'লুকুদ’ মরুভূমি এবং নুরুদ হতে আরম্ভ করে দক্ষিণভাগ পর্যন্ত প্রায় ৬০০ মাইল /৯৬০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে আরবের বৃহত্তম মরুভূমি ''আল - দাহনা" (আল রব-আল বালী)। এছাড়া এদেশের পশ্চিম দিকে রয়েছে আল হারুবাহ্ নামক আর একটি ক্ষুদ্র মরুভূমি।
কতিপয় পর্বতমালা, কিছুসংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদ - নদী, স্বল্পসংখ্যক মরূদ্যান এবং এক বিশাল ও বিস্তৃত মরুভূমি বুকে নিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে বিদ্যমান রয়েছে প্রাচীনকালের আরব উপদ্বীপ বা আরব দেশটি। এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থা ও বৈশিষ্ট্য যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনি গুরুত্বপূর্ণও বটে।
আরববাসীর বৈশিষ্ট্য
আরব ভূখণ্ডের বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যের ফলে সমগ্র প্রাচীন আরবের জনসমষ্টির মাত্র অংশ ছিল স্থায়ী বাসিন্দা (বা শহরবাসী)। তারা কৃষিকার্য ও ব্যবসা - বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করতো। তারা অনেকটা সভ্য জীবন যাপন করতো। অপরপক্ষে আরবের অংশ জনগোষ্ঠী ছিল যাযাবর বা বেদুইন। প্রাচীন আরব দেশকে যাযাবর বা বেদুইনদের দেশ বলে অভিহিত করলে অত্যুক্তি করা হবে না। বেদুইন আরববাসী শিকার, লুণ্ঠন ও যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকতো। উট, ভেড়া ও ঘোড়া ছিল তাদের সকল কর্মকাণ্ডের সহায়ক। খেজুর ছিল তাদের প্রধান খাদ্য ও খেজুর বৃদ্ধ বাসস্থান নির্মাণের সম্পদ। এগুলো ব্যতীত বেদুইনদের অস্তিত্বই কল্পনা করা যেত না।
প্রাচীন আরববাসীর বিশেষ করে বেদুইন সমাজের মূল ভিত্তি ছিল গোত্রপ্রীতি। 'আসাবিয়া' ছিল তাদের গোত্রের মূলমন্ত্র। গোত্রের সদস্যদের পরস্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকলেও ভিন্ন গোত্রের লোকদের সাথে প্রবল শত্রুতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিদ্যমান ছিল। এর ফলে গোত্রে গোত্রে প্রায়শ দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষ সংঘটিত হতো।
তারা যুদ্ধ - বিগ্রহে লিপ্ত থাকতে এত বেশি অভ্যস্ত ছিল যে জনৈক লেখক বলেন, “শত্রুকে কিংবা শত্রুর প্রতিবেশীকে আক্রমণ করাই ছিল তাদের প্রধান কাজ। কাউকে খুঁজে পাওয়া না গেলে তারা স্বয়ং সহোদর ভ্রাতাকে আক্রমণ করতে কুণ্ঠিত হতো না।"
প্রখ্যাত রোমান ঐতিহাসিক গিবন বলেন, “জাহেলিয়া যুগে মহানবি (স ) -এর আবির্ভাবের প্রাক্কালে ১৭০০ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।"
লুটভরাজ, যুদ্ধ - বিগ্রহ, জিঘাৎসা, হত্যা, চরিত্রহীনতা, মদ্যপান, কন্যাসন্তান হত্যা, নারী অপহরণ ইত্যাদি জঘন্য অপরাধে লিপ্ত থাকলেও তাদের মধ্যেও কিছু মহত্ত্বের সুকুমার গুণাবলি বিদ্যমান ছিল। জন্মগতভাবে প্রতিটি আরববাসী ছিল পূর্ণ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। প্রত্যেক আরব নিজেকে অভিজাত বলে বিশ্বাস ও দাবি করতো। প্রতিটি আরববাসী নিজেকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য করতো। তাদের মতে, আরবজাতি বিশ্বের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট। রক্তের বিশুদ্ধতা, বাগ্মিতা , কবিতা, অশ্ব, তরবারি, বংশমর্যাদা ইত্যাদি ছিল তাদের গর্বের বিষয়বস্তু। তারা কলুজি চর্চাকে বৈজ্ঞানিক চর্চার মর্যাদা দান করে। আতিথেয়তা, স্বাধীনতা - প্রীতি, সাহস, মনোবল, সহিষ্ণুতা, পৌরুষ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, দানশীলতা ইত্যাদি ছিল তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
প্রাচীন আরবের অধিবাসীদের আর একটি চমৎকার বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তারা ছিল স্বভাব কবি এবং তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল শ্রুতিধর। কেবলমাত্র মুআলাকাত ব্যতীত তাদের রচিত অন্যান্য কাবা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। জমিল, লবিদ, ইমরুল কায়েস প্রমুখ রচিত মুজালাকাত আজও বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
তৎকালীন আরব সমাজব্যবস্থায় কিছু ক্ষেত্রে নারীর স্বাধীনতা সীমিত আকারে হলেও স্বীকৃত ছিল। বিশেষ করে বেদুইন মহিলারা সমাজে পুরুষদের সমান অধিকার লাভ করতো।
আরববাসীদের মধ্যে আরও একটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। তা হচ্ছে- দক্ষিণ আরবের বাসিন্দারা ইয়েমেনী বা কাহতানী নামে অভিহিত হতো। এরা শান্ত ও উন্নত সভ্যতার অধিকারী ছিল । উত্তর আরবে বসবাসরত জনগণ মুদারীয় নামে পরিচিত ছিল। দক্ষিণ আরবে প্রাচীন সেমিটিক, সাবেয়ী ও হিমাইয়ারী ভাষা প্রচলিত ছিল। উত্তর আরবের অধিবাসীরা আরবি ভাষায় কথা বলতো। বৈচিত্র্যময় আরবের ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিবেশ আরববাসীদেরকে বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করে গড়ে তুলেছিল।
ভৌগোলিক প্রভাব: অদ্ভুত ও বিচিত্র ভৌগোলিক পরিবেশ আরব উপদ্বীপের জনগণের দেহ, মন, চরিত্র ও সকল প্রকার কর্মকান্ডের উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। আরব ভূখণ্ডের স্বল্পসংখ্যক এলাকাতে যে অতি নগণ্য সংখ্যক কৃষিজীবী স্থায়ীভাবে বসবাস করতো তাদের মধ্যে জীবনস্পন্দন ও কর্মচাঞ্চলা পরিলক্ষিত হতো। তারা ব্যবসা - বাণিজ্য উপলক্ষে দেশ - দেশান্তরে গমন করতো। বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগের ফলে তাদের জীবন ছিল পরিবর্তনশীল। এভাবে তারা নিজস্ব সভ্যতা গড়ে তুলেছিল।
কিন্তু অধিকাংশ আরব ভূখণ্ড মরুময়। এখানকার মরুভূমি প্রকৃতির রুদ্র লীলাস্থল। প্রতিকূল প্রকৃতির সাথে লড়াই করে জীবনধারণ করতে হয় বলে মরুদুলাল আরবগণ কর্মঠ, কষ্টসহিষ্ণু, ধৈর্যশীল, রুক্ষ, দুর্ধর্ষ দুঃসাহসিক জাতিতে পরিণত হয়েছে। ভৌগোলিক প্রভাব ও পরিবেশের কারণে আরবের রৌদ্রদগ্ধ বালুকা , নিষ্করুণ ও উনন্মাদ ‘লু’ হাওয়া, রুদ্র পর্বতমালা সে দেশের অধিবাসীদেরকে পরিশ্রমী ও সংগ্রামশীল জাতিরূপে গড়ে তুলেছে। নিজেদের আহার ও পানীয় এবং পশুচারণ ও পশুপালনের প্রয়োজনে মরুবাসী বেদুইনগণ যাযাবর বৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল।
নিরাপত্তার প্রয়োজনে তার স্ব - স্ব গোত্রের দলপতির নেতৃত্বে দলবদ্ধ ও সংঘবদ্ধ হয়ে বসবাস করতো। অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই তারা আক্রমণাত্মক ও আত্মরক্ষামূলক উভয় প্রকার যুদ্ধে পারদর্শিতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। এরূপে গৃহীত সৈনিকবৃত্তি তাদের জীবনে শৃঙ্খলা, সংঘবন্ধতা, একতা, শক্তি ও সাহস সঞ্চার করতে এক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল।
প্রাকৃতিক সম্পদের অভাবেই মরুবাসী আরব বেদুইনদের জীবনে আরাম - আয়েশ ছিল না — ছিল শুধু মুক্ত জীবনের অফুরন্ত আনন্দ ও নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার অপূর্ব আকাঙ্ক্ষা। মাথার উপর সুবিশাল সুনীল আকাশ ও পদতলে সীমাহীন মরুভূমির স্বাধীন আবহাওয়ার মানুষ হয়ে তারা স্বাধীনতাকেই জীবনের প্রধান সম্পদ বলে মনে করতো।
ভৌগোলিক পরিবেশের কারণে খাদ্য ও পানীয়ের দুষ্প্রাপ্যতা, দুঃসহ তাপ, রাস্তাঘাটের অভাব বৈদেশিক আক্রমণের হাত থেকে আরব দেশকে রক্ষা করেছে। আরববাসী কোনো শক্তির কাছে মাথা নত করতে রাজি ছিল না। তারা প্রতিবেশী অন্যান্য জাতির ন্যায় মহাবীর আলেকজাণ্ডারের আনুগত্য স্বীকার করে নি কিংবা তাঁর নিকট কোনো দূতও পাঠায়নি। দেশের আবহাওয়া ও প্রকৃতির প্রভাবে আরবের প্রতিটি নাগরিক দেশের স্বাধীনতা অটুট রাখতে সচেতন ছিল।
এভাবে এটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আরবের ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বৈচিত্র্য দেশ বাসীর স্বভাব ও চরিত্র গঠনে এবং ইতিহাস রচনায় অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করেছিল
মূল্যায়ন: উপরোল্লিখিত ভৌগোলিক পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে ও প্রতিপালিত হয়ে মরুবাসী আরব সন্তানরা অন্য জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করে তা আরও উন্নত ও সুমার্জিত করার অদ্ভূত ক্ষমতা লাভ করেছিল। এ ক্ষমতা বলে তারা মিশরীয়, অ্যাসিরীয়, ব্যাবিলনীয়, গ্রীকো - রোমান সভ্যতা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করে তা পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত করতে সক্ষম হয়েছিল। ইসলামের অনুপ্রেরণায় আরববাসীর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটে।
তাই বলা হয়ে থাকে যে, বেদুইনরাই “ইসলামের সফলতার মূলে ছিল বেদুইনদের লুপ্ত ক্ষমতা ও প্রতিভা। খলিফা ওমর ( রা ) -এর ভাষায়, ইসলামকে চমৎকার মাল - মশলা সরবরাহ করেছিল।”