সুমেরীয় সভ্যতা || Sumerian civilization
সুমেরীয় সভ্যতার ধারণা
খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ৬০০০ হতে ৫০০০ অব্দে অ-সেমেটিক সুমেরীয় জাতি টাইগ্রীস (দজলা) ও ইউফ্রেটিস (ফোরাত) নদীর মধ্যভাগে বসবাস করত। এই সুমেরীয় জাতিই ছিল মেসোপটেমীয় (অর্থাৎ ব্যাবিলনীয় ও অ্যাসিরীয় সভ্যতার আদি প্রতিষ্ঠাতা।
ঐতিহাসিকদের মতে—“তারাই সেমেটিকদেরকে সভ্যতার আলোেক প্রদর্শন করে।”
কিছুসংখ্যক ঐতিহাসিক তাদেরকে বর্তমান দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় জাতির পূর্বপুরুষ বলে অনুমান করে। থাকেন। কেননা সুমারীয়ানদের সাথে দক্ষিণ ভারতীয়দের মুখাবয়বের প্রভূত সামঞ্জস্য পরিদৃশ্যমান। তারা ছিল দীর্ঘজীবী।
ঐতিহাসিক বেরোসস বলেন, “ব্যাবিলনীয় ধ্বংসাত্মক প্রাবনের পর সুমারীয়দের ৮৬ জন রাজা মোট ৩৪০৮০ বছর রাজত্ব করেন।”
পরবর্তীকালে তাদের আয়ুষ্কাল নাকি সাধারণ মানুষের ন্যায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এইচ. এ. ডেভিসের মতে সুমেরীয়দের জাতি পরিচয় রহস্যাবৃত। তারা সেমিটিক নয়, আবার আর্যও নয়। তাদের গায়ের রং অনুজ্জ্বল সাদা, তাদের প্রধান নগর নিপুর খ্রিস্টের জন্মের পাঁচ থেকে ছয় হাজার বছর আগে নির্মিত , অর্থাৎ মিশরের যে কোনো নগরের আগে।
সুমেরীয় সভ্যতার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা
সুমেরীয়গণ সুসভ্য জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও তারা সুসংহত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। বস্তুত, সুমেরীয় অধ্যুষিত মেসোপটেমিয়া ছিল অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রের সমষ্টি প্রাচীরবেষ্টিত এ সকল নগররাষ্ট্র ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন। প্রত্যেক নগররাষ্ট্রের একজন রাজা ও নিজস্ব দেবতা ছিল। জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় ক্ষেত্রে রাজাই ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কেন্দ্রীয় রাজশক্তির অভাবে সুমেরীয় শাসদে কোনো প্রকার রাজনৈতিক ঐক্য বিদ্যমান ছিল না। প্রভুত্ব স্থাপনের জন্য রাজ্যগুলো পরস্পর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত থাকতো।
উল্লেখ্য যে, সুমেরীয় সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র ছিল ইরিদু, কিস, লাগাস আল-উবাইদ, নিপ্পুর ও উর।
সুমেরীয় সভ্যতার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
ব্যক্তিস্নাতন্ত্র্য ছিল সুমেরীয় সভ্যতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রত্যেক নাগরিক ভূমির স্বত্বাধিকার ভোগ করতো। তারা প্রত্যেকে অবাধ ব্যবসায় বাণিজ্য পরিচালনা করার সর্বপ্রকার সুযোগ লাভ করতো। ব্যবসায়-বাণিজ্য উপলক্ষে সুমেরীয়রা দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গমনাগমন করতে পারতো। সোনা ও রূপার মাধ্যমে সে যুগে লেনদেন কার্য সম্পন্ন হতো। দেশের উর্বর অববাহিকায় প্রচুর রবিশস্য উৎপন্ন হতো। দেশে ভূমি-দাস প্রথা বিদ্যমান।
সুমেরীয় সভ্যতার ধর্মীয় বিশ্বাস
সুমেরীয়গণ প্রাচীন মিশরীয়দের ন্যায় ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে তেমন উন্নত ধরনের মনোবৃত্তির পরিচয় দিতে সক্ষম হয়নি। সুমেরীয়দের প্রধান দেব-দেবীর নাম ছিল সূর্যদের শামস্, মাতৃদেবী ইসতার এবং ঝড় - বৃষ্টির দেবতা ইন্লিল। পরকাল সম্পর্কে তাদের স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তারা কফিন ছাড়াই মৃতদেহকে বাসমূহের মেঝের নিচে সমাহিত করতো। তাদের সময়ে নির্মিত ধর্ম মন্দিরগুলো জিগুরাত নামে অভিহিত হতৌ। উর-এ নির্মিত জিগুরাভটি অদ্যাবধি ভগ্ন অবস্থায় বিদ্যমান থেকে উন্নত সুমেরীয় স্থাপত্যের নিদর্শন বহন করছে । এই উর শহর থেকেই হযরত ইব্রাহিম (আ) কেনানে চলে আসেন। সুমেরীয়দের কিছু পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক কাহিনী যেমন সৃষ্টি তত্ত্ব, মহাপ্লাবন পরবর্তীতে ওল্ড টেস্টামেন্টে স্থান পেয়েছে।
সুমেরীয় সভ্যতার চারু ও কারুশিল্প
শিল্পকলা, বিশেষ করে স্থাপত্য শিল্পে সুমেরীয়দের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তাদের নির্মিত স্থাপত্যগুলো অনিন্দ্যসুন্দর ছিল বলে অনুমান করা হয়। উর-এ প্রাপ্ত রাজকীয় সমাধি হতে খ্রিস্টপূর্ব ৬২০০ - ২০০০ অব্দের মূল্যবান স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা ও ব্রোঞ্জের বহু অলংকার উদ্ধার করা হয়েছে। তারা কাঁচা ইটের দ্বারা নির্মিত জিগুরাত ও বিভিন্ন প্রকার ইমারতে বিদান , গম্বুজ ও ভন্টের ব্যবহার করে স্থাপত্য শিল্পের ক্রমবিকাশের এক অমূল্য অবদান রেখেছে। ভাস্কর্যে পাথর কেটে নয়া তৈরির দক্ষতায় , মৃৎশিল্পে এবং হাতির দাঁতের কারুকার্যে সুনিপুণতা প্রদর্শনে তারা বিস্ময়কর কৃতিত্ব অর্জন করে।
সুমেরীয় সভ্যতার লিখন পদ্ধতি
সুমেরীয় লিখন পদ্ধতির উদ্ভব মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা বটে। তাদের উদ্ভাবিত লিখন পদ্ধতি ‘কুইনিফরম লিখন' নামে অভিহিত হতো। নল - খাগড়ার তৈরি কলম দ্বারা নরম মাটির ট্যাবলেটে চিত্রাঙ্কন করে তা দ্বারা মনের ভাব ও অনুভূতি প্রকাশের বিশ্বের ইতিহাসে সম্ভবত এটিই প্রথম প্রচেষ্টা।
নব্য সুমেরীয় সাম্রাজ্য
খ্রিস্টপূর্ব ৩৭৫০-২৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী কোনো সময়ে সেমেটিক বংশোদ্ভূত প্রথম সারগণ সুমেরীয়দেরকে পরাজিত করে আক্কাদ অঞ্চলে একটি নতুন সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। তিনিই সর্বপ্রথম বিবদমান রাষ্ট্রগুলোকে সংঘবদ্ধ করে একটি কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত সমগ্র সিরিয়ার উপরও স্ত্রীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় সুমেরীয় সভ্যতার উপর ভিত্তি করেই আক্কাদীয় সভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে। সুমেরীয়গণ সুদীর্ঘকাল আক্কাদীয়দের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করে অবশেষে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে পুনরায় সুমের ও আক্কাদ অঞ্চলে রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়।
এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ নৃপতির নাম ছিল দুঙ্গী। “বিশ্বের চারটি অঞ্চলের নৃপতি” উপাধি ধারণ করে তিনি সুমেরীয় জাতিকে সুসংঘবদ্ধ করে সর্বপ্রথম একটি বিধিবদ্ধ আইন প্রবর্তন করেন। ঐতিহাসিকদের মতে ব্যাবিলনীর নরপতি হাম্মুরাবির বিখ্যাত কোড দুঙ্গীর কোড হতে গৃহীত হয়েছিল। পরবর্তীকালে এ কোড ব্যাবিলনীয়, অ্যাসিরীয়, ক্যালডীয় এবং হিব্রুদের সাম্রাজ্যে আইনরূপে সমাদৃত হয়েছিল।
সুমেরীয় সভ্যতার মূল্যায়ন ও প্রভাব
পানি দ্বারা পরিচালিত ঘড়ি, চন্দ্রভিত্তিক বর্ষপঞ্জি, গুণ ও ভাগ করার পদ্ধতি, ওজন ও পরিমাপ ব্যবস্থার প্রবর্তন করে সুমেরীয় জাতি বিশ্ব সভ্যতার অগ্রগতি ও ক্রমবিকাশে যথেষ্ট অবদান রেখে গেছে। কৃষি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিল্পকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে সুমেরীয় জাতি প্রভূত উন্নতি সাধন করেছিল। মানব সভ্যতার ইতিহাসে সুমেরীয়দের উদ্ভাবিত লিখন পদ্ধতি একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। মেসোপটেমীয় অর্থাৎ ব্যাবিলনীয় , অ্যাসিরীয় প্রভৃতি সভ্যতার উন্মেষ ও ক্রমবিকাশে সুমেরীয়দের অবদান অনস্বীকার্য। এমনকি হিব্রু ও ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশেও এদের অবদান একেবারে নগণ্য ছিল না। ইতিহাস প্রসিদ্ধ নৃপতি দুঙ্গীর মৃত্যুর পর সুমেরীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর যে ইতিহাস প্রসিদ্ধ সাম্রাজ্যের উদ্ভব ঘটে, সেটি ছিল ব্যাবিলনীয়। কালক্রমে এটি সমগ্র দক্ষিণ মেসোপটেমিয়া পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।
কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, “এটি ছিল প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার সমসাময়িক এবং সমান গুরুত্বপূর্ণ। এ সভ্যতা টাইগ্রীস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল।
ব্যাবিলন শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে “বাব ইল” শব্দ থেকে। "বাব ইল” -এর অর্থ দেবতার নগর। আরব ঐতিহাসিকগণ এ উন্নত উপত্যকাভূমিকে “ উম্মুল বিলাদ ” বা সভ্যতার জন্মভূমি নামে অভিহিত করেছে।
ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, “মেসোপটেমিয়াই মানবসভ্যতার আদি লীলাভূমি।”
ঐতিহাসিক ম্যালোয়ান মনে করেন, “খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে এ অববাহিকা সভ্যতার প্রথম আলোকে উদ্ভাসিত হয়।"
আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে সেমেটিক জাতির একটি শাখা টাইগ্রীস ও ইউফ্রেটিস (দজলা ও ফোরাত) উপত্যকায় গমন করে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে সুমেরীয়দের কাছে গৃহ নির্মাণ, জলসেচ, লিখন পদ্ধতি প্রভৃতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করে। অতঃপর কালক্রমে অ - সেমেটিক সুমেরীয় জাতি এবং উল্লিখিত সেমেটিক জাতির সংমিশ্রণে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটে।