সমবায় প্রতিষ্ঠান || Co - operative Enterprise

সমবায় প্রতিষ্ঠান

সমবায় প্রতিষ্ঠান কাকে বলে?
ব্যক্তিবর্গ স্বেচ্ছায় সমান অধিকার ও সমান দায়িত্ব নিয়ে সম্মিলিতভাবে যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, তাকে সমবায় প্রতিষ্ঠান বা সমবায় কারবার বলা হয়। সমবায় সমিতিগুলো পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। 
অর্থনীতিবিদ কার্লভাটের মতে, 'সমবায় এরূপ একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে মানুষ তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য স্বেচ্ছায় সমানাধিকারের ভিত্তিতে একে অপরের সাথে সহযোগিতা করে।" 
অধ্যাপক চেম্বার্স মনে করেন, ‘'পণ্যদ্রব্য সরবরাহ অথবা অন্যান্য শিল্প পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠিত যে প্রতিষ্ঠানের মুনাফা সদস্যদের মধ্যে বণ্টন করা হয় তাকে সমবায় কারবার বলে।"
এরূপ প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা নিজেরাই কারবারের উদ্যোগ গ্রহণ, মূলধন সরবরাহ, কারবার পরিচালনা ও যাবতীয় ঝুঁকি বহন করে থাকেন।


সমবায় প্রতিষ্ঠানের মূলনীতি
সমবায় সংগঠনগুলো কার্যকরভাবে ও দক্ষতার সাথে পরিচালনার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সমবায় মৈত্রী (International Co operative Alliance) কর্তৃক সমবায় পরিচিতি নির্দেশিকাতে ৭ টি মূলনীতি ঘোষনা করেছে। যথা-
১. স্বতঃস্ফূর্ত ও অবাধ সদস্যপদ (Voluntary and Open Membership) 
২. সদস্যের গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ (Democratic Member Control)
৩. সদস্যের আর্থিক অংশগ্রহণ (Member Economic Participation)
৪. স্বায়ত্বশাসন ও স্বাধীনতা (Autonomy and Independence) 
৫. শিক্ষা , প্রশিক্ষণ ও তথ্য (Education, Training and Information)
৬. আন্তঃসমবায় সহযোগিতা (Co - operation among Co - operative) 
৭. সামাজিক অঙ্গীকার (Concern for Community) 
বাংলাদেশের ২০০১ সালে প্রণীত সমবায় আইন ২০০১ (সংশোধিত / ২০০২, সংশোধিত / ২০০৩) -এর ১৪ ধারা অনুযায়ী সমবায় সমিতিগুলোর স্বতন্ত্র আইনগত ভিত্তি রয়েছে এবং এগুলো একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা।


সমবায় কারবারের সুবিধা
১. উৎপাদন বৃদ্ধি : সমবায় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উৎপাদনকে প্রসারিত করা সম্ভব। তখন অর্থনৈতিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে মিতব্যয়িতা দেখা দেয়। ফলে উৎপন্ন দ্রব্যের দাম কমানো সম্ভব। তখন বিক্রয় বৃদ্ধির মাধ্যমে বিক্রয়লব্ধ অর্থের পরিমাণও বাড়ানো সম্ভব।

২. সঞ্চয় বৃদ্ধি: সমবায় কারবারে সদস্যদের মধ্যে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মূলধন বৃদ্ধির প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। সেই উদ্দেশ্যে তারা অধিক সঞ্চয়ে উৎসাহিত হয়।

৩. আয়ের সুষম বণ্টন: সমবায় সমিতির মাধ্যমে জাতীয় আয় বণ্টন সুষম হতে পারে। সমিতির সদস্যদের মধ্যে সমবন্টনের নীতি কার্যকর হয়। কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের আয় সমবায়ের দ্বারা বাড়ে। ফলে দেশে ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৪. সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি: সমবায়ের মাধ্যমে সদস্যদের আয় বাড়ে। দরিদ্র ব্যক্তিদের প্রান্তিক ভোগ প্রবণতা বেশি। তাই সদস্যদের আয় বাড়লে দেশের ভোগ্য দ্রব্যের চাহিদা বাড়ে। এর ফলে সমাজের মোট চাহিদা বাড়ে। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৫. মধ্যবর্তী সুবিধাভোগী দূরীকরণ: উৎপাদন ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে দালাল ও ফড়িয়াদের মত কিছু সুবিধা ভোগী ব্যক্তি দেখা যায়। এদের দ্বারা দরিদ্র কৃষক ও ক্ষুদ্র উৎপাদনকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমবায় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ ধরনের দরিদ্র ব্যক্তিরা এক জোট হয়ে সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের বিতাড়িত করতে পারে।

৬. স্থনির্ভরতা: সমবায়ের মূলনীতি হলো স্বনির্ভর এবং স্বায়ত্তশাসন। সমবায়ের মাধ্যমে সকল সদস্য তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকে। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্মায়। এর দ্বারা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে একটি চাঙ্গাভাব দেখা দেয়।

৭. শ্রমিক - মালিক সম্পর্ক: সমবায় প্রতিষ্ঠানসমূহে মালিক - শ্রমিক সুসম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। ফলে উৎপাদনে কোনোরূপ বিঘ্ন সৃষ্টি হয় না।


সমবায় কারবারের অসুবিধা 
১. বিলম্বিত সিদ্ধান্ত: সমবায় কারবারে পরিচালকমণ্ডলী থাকে। সেখানে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে কারবারের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মতামত গ্রহণ করতে হয়। এ অবস্থায় কোনো সিদ্ধান্ত দ্রুত নেয়া যায় না।
২. পরিচালনায় অদক্ষতা: সমবায় কারবারে পরিচালকমণ্ডলী সদস্যদের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত হয়। কিন্তু প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় যে, পরিচালক হিসাবে যারা নির্বাচিত হয়, অনেকেরই প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার অভাব থাকে। ফলে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে অদক্ষতা দেখা দেয়।

৩. মূলধনের অভাব: উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সমবায় কারবার দরিদ্র ব্যক্তিদের সংগঠন বলে বিবেচিত হয়। তারা দরিদ্র বলে প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ করা তাদের পক্ষে কঠিন। তাছাড়া প্রয়োজনীয় ঋণ সংগ্রহের ক্ষেত্রেও বাধা বিপত্তি থাকে। ফলে মূলধনের অভাবে সমবায় কারবার তার লক্ষ্য অর্জনে অনেক সময় ব্যর্থ হয়।

৪. সততার অভাব ও কর্মে শিথিলতা: সমবায় কারবারের সদস্যরা নিজ নিজ স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়। তখন ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা অসৎ পথ অবলম্বন করে।

৫. উদ্যোগের অভাব: সমবায় কারবার ঠিকমতো পরিচালনা করতে হলে উৎপাদনক্ষেত্রে কখনও কখনও ঝুঁকি গ্রহণ করার প্রয়োজন পড়তে পারে। উৎপাদন ও ব্যবসাক্ষেত্রে উন্নতি করতে হলে ঝুঁকির বিকল্প নেই। কিন্তু সমবায় সমিতির সদস্যরা বিভিন্ন চরিত্রের হওয়ায় সফল উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।

৬. সীমিত কার্যক্ষেত্র: সমবায় প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড সীমিত গণ্ডির মধ্যে পরিচালিত হয়। এর ফলে কর্মকাণ্ড প্রসারিত হয় না। তাই সমাজের উদ্যোগী ব্যক্তিরা এই সীমিত কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে চায় না।


বাংলাদেশের আর্থ - সামাজিক উন্নয়নে সমবায় প্রতিষ্ঠানের অবদান
বাংলাদেশের সমবায় সমিতিগুলো মূলত সমাজের মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষের সংগঠন। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সমবায় সমিতির অবদান অপরিসীম, যা নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো- 
১. স্বনির্ভরতা অর্জন: সমবায় সমিতির যৌথ কর্মপ্রচেষ্টার দ্বারা নিজেদের কাজ নিজেরা করার অভ্যাস গড়ে ওঠে। এতে স্বনির্ভরতা অর্জিত হয়। সদস্যদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে বিরাট মূলধন গঠিত হয় এবং তা সদস্যদের কল্যাণেই ব্যবহৃত হয়। সদস্যরা তাদের প্রয়োজনমতো ঋণ সুবিধাও পেয়ে থাকে।

২. অর্থনৈতিক উন্নয়ন: সমবায়ের মাধ্যমে সদস্যদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, পুঁজি, কর্মদক্ষতা, মেধা ইত্যাদির দ্বারা বৃহদায়তন ব্যবসায় গঠন করা যায়। ফলে সদস্যরা বৃহদায়তন উৎপাদন, ক্রয় এবং বিক্রয়ের সুবিধা পেয়ে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয় এবং আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে।

৩. সম্পদের সুষম বণ্টন: সমবায় সম্পদের সুষম বণ্টনে সহায়তা করে। সমবায় সমিতি মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত লোকজনের আত্মকর্মসংস্থান ও আয় - উপার্জনের সুযোগ করে দেয়। এতে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হতে থাকে। এভাবে সমাজের নিম্ন ও উচ্চ শ্রেণির ব্যবধান কমতে থাকে।

৪. মধ্যস্থ ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস : সমিতির সদস্যরা উপকরণ সংগ্রহ, উৎপাদন , বাজারজাতকরণ, ভোক্তার নিকট পৌছানোসহ যাবতীয় কার্য সম্পাদন করে থাকে। ফলে মধ্যস্থ ব্যবসায়ীর প্রয়োজন হয় না। এতে ন্যায্যমূল্যে উপকরণ সংগ্রহ ও উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি সম্ভব হয়।

৫. দারিদ্র্য বিমোচন : কৃষি, মৎস্য চাষ, দুগ্ধ খামার, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ক্ষেত্রে গঠিত সমবায় সমিতিগুলো তাদের কর্মকাণ্ডের দ্বারা দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৬. সামাজিক উন্নয়ন: সমবায় সমিতি সদস্যদের আর্থিক কল্যাণের সাথে সাথে বিভিন্ন সময়ে রাস্তাঘাট নির্মাণ ও মেরামত , সেচ প্রকল্প স্থাপন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি ইত্যাদি সমাজ কল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করে সামাজিক উন্নয়নেও অবদান রাখে। 

অতএব, বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও মেহনতি মানুষ অর্থাৎ কৃষক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, শ্রমিকসহ সকলের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য সমবায় সমিতির অবদান অপরিসীম।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url