এনজিও || NGO

এনজিও

এনজিও কী? 
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায় , স্মরণাতীতকাল থেকেই সমাজের অগ্রসর মানুষদের মধ্যে একটি অংশ পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য উল্লেখযোগ্য কল্যাণমূলক প্রয়াস গ্রহণ করে থাকে। প্রাক - শিল্প সমাজে এসে তা প্রকট আকার ধারণ করে। এই প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য সহায়তা করার উদ্যোগ নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে কিছু দেশীয় ও সামাজিক সংগঠন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে নানা রকম উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। ষাটের দশকে এরাই বেসরকারি সাহায্য সংস্থা, বেসরকারি সংগঠন বা NGO নামে পরিচিতি লাভ করে।


এনজিও এর সংজ্ঞা
NGO এর পূর্ণরূপ হলো Non Governmental Organization. ১৯৪৫ সালে যখন ইউনাইটেড ন্যাশন (UN) সৃষ্টি হয় তখনই NGO এর যাত্রা শুরু হয়, যা ছিল আন্ত: সরকারের একটি সংগঠন। 
জাতিসংঘ (UN) - এর মতে, "যেকোনো বেসরকারি সংগঠন যা সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত থাকে তাকে NGO বলে। সেখানে মুনাফাবিহীন, সন্ত্রাসবিহীন এবং অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়।"

বেসরকারি সংস্থা বলতে বোঝানো হয় সেসব সংস্থাকে যেগুলো উন্নয়ন বা সেবামূলক কর্মকাণ্ডে কোনো না কোনোভাবে জড়িত। সহজ অর্থে বেসরকারি সংস্থা বলতে কোনো অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে বোঝায় যা উন্নয়ন সহযোগিতা অথবা শিক্ষা ও নীতিগত কার্যক্রমে নিয়োজিত থাকে।
বেসরকারি সংস্থাকে একটি সংগঠন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয় এভাবে— "Established and governed by a group of private citizens for a stated philanthropic purpose and supported by voluntary individual contribution."

আবার বিশ্বব্যাংক কর্তৃক বেসরকারি সংস্থাকে সংজ্ঞায়িত করা হয় এভাবে— "NGO's as institutions outside the public and private sectors whose goals are primarily value - driven (humanitarian or co - operative) rather than profit driven."  
সাধারণ অর্থে এনজিও বলতে বোঝানো হয় সেইসব সংস্থাকে যেগুলো উন্নয়ন বা সেবামূলক কর্মকাণ্ডে কোনো না কোনোভাবে জড়িত থাকে। 


এনজিও এর বৈশিষ্ট্য 
এ ধরনের সংস্থার কিছু বৈশিষ্ট্য নিচে তুলে ধরা হলো-
১. এসব সংস্থা আন্তর্জাতিক, জাতীয় বা আঞ্চলিকভাবে সেবামূলক, শিক্ষামূলক এবং উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকে।
২. এসব সংস্থা বৈদেশিক সহায়তা, স্বেচ্ছামূলক কার্যক্রম, রেগুলেশন অর্ডিন্যান্স– ১৯৭৮ সালের আওতায় সমাজকল্যাণ বিভাগের রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত।
৩. এসব সংস্থা যেসব সূত্র থেকে তহবিল পেয়ে থাকে সেগুলো হচ্ছে— 
ক. বিভিন্ন উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন– ইউএসএআইডি, সিডা, নোরাড ইত্যাদি।
খ. বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা যেমন- অক্সফাম, ভোভিড, এন্টার প্রাইজেস, কুশো ইত্যাদি।
গ. বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অথবা তিনটির সবগুলো থেকে বা একাধিক সূত্র থেকে।
৪. এসব সংস্থা বেসরকারি হলেও সরকারি অনুমোদন নিয়েই এরা কাজ করে এবং সরকার গৃহীত পরিকল্পনা নীতির সাথে সম্পর্কিতভাবে বা সরকার নির্দেশিত পথে এদের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়।
৫. বেশিরভাগ বেসরকারি সংস্থাই বিদেশি সাহায্য দাতাদের নিকট দায়বদ্ধ , উপকারভোগীদের প্রতি নয়।


এনজিও রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি  
১৯৬১ সালে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিবন্ধীকরণ ও নিয়ন্ত্রণ আইনে বলা হয়, "এনজিও বলতে এমন এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা সমিতি বোঝায়, যা এক বা একাধিক ক্ষেত্রে সমাজকল্যাণমূলক সেবাকর্ম পরিচালনার উদ্দেশ্যে এবং জনগণের চাঁদা ও সাহায্যে সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভর হয়ে স্বেচ্ছায় প্রতিষ্ঠিত করে।" এ সংগঠনটি শুরু হওয়ার পূর্বেই রেজিস্ট্রেশন করতে হয় এবং এনজিও ব্যুরো এ সংগঠনকে তদারক করে। রেজিস্ট্রেশন এর জন্য কতগুলো প্রয়োজনীয় বিষয় পূরণ করতে হয়। যেমন-
১. পরিচালনা বা উপদেষ্টা পর্ষদ।
২. ভিশন (Vision), মিশন (Mission) এবং উদ্যেশ্যাবলির (Objective) বর্ণনা।
৩. NGO- র একটি যথার্থ নাম ও মনোগ্রাম, যা ইতোপূর্বে এরূপ কোনো সংগঠনে গৃহীত হয়নি। রেজিস্ট্রেশনের জন্য অন্যান্য যেসব কাগজপত্রের প্রয়োজন হয় তা হলো-

১. মিশন বর্ণনা (Mission Statement) যাতে লিপিবদ্ধ থাকে- 
ক. We have a dream (স্বপ্ন) 
খ . Mission (মিশন) 
গ. বিশ্বাস (Belief) 
ঘ . লক্ষ্য (a goal) এবং 
ঙ . মূল্যবোধ (Core Values) যেখানে জ্ঞান ও মানুষকে কাজে লাগানো হয়।
২. সংগঠিত কার্যক্রমের বর্ণনা 
৩. প্রকল্পের বিভিন্ন তথ্যমান 
৪. কর্মীর সংখ্যা 
৫. অর্থায়নের উৎস 
৬. এনজিও বোর্ডের তথ্য 
৭. Memorandum of Association or Bye laws যেখানে সংগঠনটি পরিচালনার বিধি ও উপবিধি লিপিবদ্ধ থাকে।
৮. বার্ষিক কার্যক্রমের রিপোর্ট 
৯. অর্থায়ন ও অডিট রিপোর্ট আয় ব্যয়ের তথ্য 
১০. অন্যান্য সমর্থক দলিলাদি যেমন কার্যনির্বাহী সভার অনুমোদন ইত্যাদি।


এনজিও - র প্রকারভেদ
বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়নে বহু ধরনের বেসরকারি সংস্থা সাফল্যের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। এসব বেসরকারি সংস্থা সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। প্রকৃতি, পরিধি, আর্থিক উৎস প্রভৃতি বিবেচনায় এদেশে ৫ ধরনের বেসরকারি সংস্থা কর্মরত রয়েছে। এগুলো নিচে আলোচনা করা হলো— 

১. স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা (Local NGO): একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় অল্প পরিসরে স্থানীয় চাহিদা ও প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে এ সংস্থাগুলো কাজ করে, যেমন— শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক সচেতনতা তৈরি প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত। এদের মধ্যে রয়েছে মেহের পঞ্চগ্রাম সমবায় সমিতি, টিটিএমএস, ভিলেজ এডুকেশন রিসোর্স সেন্টার, স্থানীয় এতিমখানা প্রভৃতি।

২. আঞ্চলিক বেসরকারি সংস্থা (Regional NGO): এগুলো হলো অঞ্চলভিত্তিক গড়ে ওঠা বেসরকারি সংস্থা। রংপুর, দিনাজপুর রুরাল সার্ভিস (RDRS) এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

৩ . জাতীয় বেসরকারি সংস্থা (National NGO): গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সামাজিক উন্নয়নে বিভিন্নমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করে দেশীয় বিশেষজ্ঞ ও নাগরিকদের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয় । এর মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, প্রশিকা, কারিতাস, আশা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

৪ . আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা (International NGO): এসব বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কর্মরত বিদেশি অর্থ ও কারিগরি সহায়তায় এবং ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সংস্থাগুলো এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত; যেমন— কেয়ার বাংলাদেশ, এসওএস, সেভ দ্য চিলড্রেন, কাসান, ওয়াল্ড ভিশন, টেরেডেস হোমস ইত্যাদি।

৫. আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা (International Associate NGO): জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিচালিত বেসরকারি সংস্থানসমূহের আর্থিক, কারিগরি ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ এবং সহযোগিতা প্রদানকারী সংস্থাসমূহ এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এদের কাজ হলো উল্লিখিত সংস্থার অনুকূলে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ, প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা। ফোর্ড ফাউন্ডেশন , এশিয়া ফাউন্ডেশন, ইউএসএইড, অক্সফাম, ইউকেএইড, ডানিডা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থাগুলো আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা হিসেবে ভূমিকা পালন করে । এদের মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা , বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ইউনিসেফ , বিশ্বব্যাংক, ইউনেস্কো, ইউএনডিপি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।


বাংলাদেশে এনজিও - র ভূমিকা
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ । এদেশের জাতীয় দারিদ্র্যের ঊর্ধ্বসীমা ২১.৮ % , আর দারিদ্র্যের নিম্ন সীমা ১১.৩%। এদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনে গুণগত ও পরিমাণগত পরিবর্তনের জন্য সরকারের পাশাপাশি ব্র্যাক, কেয়ার, হিড, প্রশিকা, আশা, শক্তি ফাউন্ডেশন, টিএমএসএস, সোসাইটি ফর সোস্যাল সার্ভিস (এসএসএস) , স্বনির্ভর বাংলাদেশ প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চালু রয়েছে।


বাংলাদেশে NGO- এর ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম
ক্ষুদ্রঋণ খাতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিশেষায়িত কর্মসূচি, সরকারি - বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ক্ষুদ্রঋণ দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাধিক্য, কার্যক্রমের গুণগত মান ও এ সেক্টরের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য ২০০৬ সালের ১৬ জুলাই মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি আইন -২০০৬ পাস হয় এবং কার্যকর করা হয় ২৭ শে আগস্ট ২০১৬ থেকে। এই আইনের উদ্দেশ্যপূরণকল্পে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) প্রতিষ্ঠা করা হয়। 
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানসমূহের পর্যবেক্ষণ ও তদারকির ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। এ আইন অনুযায়ী, এর সনদ ব্যতিরেকে কোনো ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। এমআরএ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত ৮১১ টি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানকে সনদ প্রদান করেছে।
দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ঋণদান কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে। এক হিসাবে দেখা যায় , ফেব্রুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক ২,৫৬৮ টি শাখার মাধ্যমে ৬৪ টি জেলার ৪৭৯ টি উপজেলার ৮১,৬৭৮ টি গ্রামে ৯১.৩২ লক্ষ সদস্যের মধ্যে এ কার্যক্রম সম্প্রসারিত করেছে এর মধ্যে ৯৭ শতাংশই মহিলা । ব্যাংকটি ফেব্রুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১৯৪৪৯০.৯০ কোটি টাকা এবং আদায়কৃত ঋণের পরিমাণ ১,৭৮,৯২০.৯৭ কোটি টাকা।


NGO কার্যক্রমের পটভূমি
স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে বিশেষ করে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, হাট - বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি অবকাঠামো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আর এই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন করার লক্ষ্যে এক বিশাল কর্মকাণ্ড শুরু হয়। কারণ উল্লিখিত ক্ষেত্রে পুনর্বাসনের কাজ সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয় বিধায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সেবামূলক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসে। NGO গুলো আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থার অর্থায়নে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। 
প্রাথমিক পর্যায়ে NGO গুলোর ভূমিকা ছিল যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া এবং এদের পুনর্বাসন কার্যক্রমে সহযোগিতা করা। তবে সময়ের বিবর্তনে এদের কার্যক্রমের পরিধি অনেক বিস্তৃতি লাভ করেছে। কৃষি, কুটির শিল্প , ঋণদান ও সঞ্চয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য , পরিবার পরিকল্পনা, মাতৃমঙ্গল ও শিশু পরিচর্যা, স্যানিটেশন, সামাজিক বনায়ন ছাড়াও আরও অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে NGO নিজেদের সম্পৃক্ত করে, এছাড়াও অনেক NGO ছিন্নমূল দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে নিয়েও কাজ করছে। তবে এদের মূল কার্যক্রম গ্রামকেন্দ্রিক, অর্থাৎ গ্রাম উন্নয়নই এদের প্রধান লক্ষ্য।
বাংলাদেশের সূচনালগ্নে NGO গুলো বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করে। তবে তাদের বেশির ভাগ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় মাঠ পর্যায়ে। অর্থাৎ গ্রামের চাহিদাকে সামনে রেখে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেই কার্যক্রমের সূচনা হয়। অপরপক্ষে, সরকারি কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, শহরের অফিসে বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে যা অনেক ক্ষেত্রে গ্রামের প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
এমনকি সরকারের গৃহীত অনেক কার্যক্রম, গ্রামের দরিদ্র জনগণের কাছে পৌছাতে পারে না। অন্যদিকে, বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকাণ্ডে NGO- এর সাফল্যও উল্লেখযোগ্য । উদাহরণস্বরূপ ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে এদেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে মানুষের সংখ্যা ছিল শতকরা ৮০ ভাগ। সরকার ও NGO উভয়ের সমন্বিত কার্যক্রমের ফলে ঐ সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ২১.৮ শতাংশে। ভবিষ্যতে এ সংখ্যা আরও কমবে বলে আশা করা যায়।


বাংলাদেশে কতিপয় এনজিও - র কার্যক্রম
ব্র্যাক: ব্র্যাক বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থা। সংস্থাটি বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ঋণদান কর্মসূচি ছাড়াও দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে থাকে। বিশেষ করে সামাজিকভাবে বঞ্চিত ও বিভিন্ন ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মানুষ যেমন- অতি দরিদ্র চরবাসী, দুঃস্থ নারী , অবসরপ্রাপ্ত ও ছাঁটাইকৃত সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্রঋণ এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়ে থাকে। ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত সংস্থাটির মোট বিতরণকৃত ও আদায়কৃত ঋণের পরিমাণ যথাক্রমে ২০৫২৮১.৯৪ কোটি ও ১৮,৪৪৮৪.১৬ কোটি টাকা। বিতরণকৃত ঋণের সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৭১১৪৭২৬ জন এবং এর মধ্যে মহিলা সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৬১৬৫১১৯ জন, যা মোট উপকারভোগীর ৮৭ শতাংশ।


ব্র্যাকের কার্যক্রম
বাংলাদেশে মূলত স্যার ফজলে হাসান আবেদ এর নির্দেশনা ও পরিচালনায় ব্র্যাকের সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে উঠেছে । আর যেসব দেশ বা উৎস থেকে ব্র্যাক তার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অর্থ পেয়ে থাকে সেই সব দেশ বা উৎস হচ্ছে- ইউনিসেফ , সিডা (কানাডিয়ান ইন্টা. ডেভলপমেন্ট এজেন্সি), নোডিক, ফাও, হু, অক্সফাম , ইইউ ইত্যাদি। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই ব্র্যাকের কার্যক্রম বিস্তৃত রয়েছে। ব্র্যাকের কার্যক্রমগুলোকে চারভাগে ভাগ করা যায়। যা নিচে উল্লেখ করা হলো—

১. গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি: গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচিতে কিছু সংখ্যক কেন্দ্রের সুগঠিত দলের মধ্যে পুরুষ ও মহিলা দল উভয়ই রয়েছে। গ্রুপ গঠনের প্রক্রিয়া অন্যান্য সংস্থাগুলোর মতোই হয়ে থাকে। আর এই গ্রুপের মাধ্যমেই তাদের ঋণ দেওয়া হয়। গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচির একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিপূরক প্রকল্প হচ্ছে আড়ং। গ্রামীণ মহিলাদের তৈরি কাপড় কিনে আড়ং - এর মাধ্যমে শহরে বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।

২. শিক্ষা কর্মসূচি : ব্র্যাকের শিক্ষা পদ্ধতি উদ্ভাবনীমূলক ও কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। এ কার্যক্রম দেশব্যাপী অল্প সময়ে শিক্ষা বিস্তার লাভে সাহায্য করেছে। শিক্ষা কর্মসূচির অধীনে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় ব্র্যাক বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে এবং সেসব বিদ্যালয়ে কয়েক লক্ষ ছাত্রছাত্রী পড়াশুনা করে থাকে। সম্প্রতি ঢাকায় ব্র্যাকের পরিচালনায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

৩. স্বাস্থ্য কর্মসূচি: ব্র্যাক স্বাস্থ্য কর্মসূচির অধীনে খাবার স্যালাইন, শিশু ও মাতৃ স্বাস্থ্য কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।


৪. সহায়ক সেবা কার্যক্রম: ব্র্যাকের সহায়ক সেবা কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে লাইব্রেরি, কম্পিউটার সেন্টার, ব্র্যাক প্রকাশনী, হিমাগার ও বরফকল স্থাপন। এছাড়াও গ্রামের প্রান্তিক চাষিদের সহায়তাদানের জন্য একটি পাস্তুরিত দুধের কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে।

প্রধান প্রধান এনজিও - র সার্বিক কার্যক্রম
আশা: আর্থ - সামাজিক উন্নয়নে ১৯৭৮ সালে আশা প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং ১৯৯২ সালে স্পেশালাইজড ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান হিসাবে এ NGO কার্যক্রম শুরু করে। এটি বর্তমানে সর্ববৃহৎ আত্মনির্ভর দ্রুত বিকাশমান ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থা হিসাবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এর ইনোভেটিভ স্বল্প ব্যয় ও টেকসই ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ২০১৭ সালে ৭৮,৩৯,১১৯ জন উপকারভোগীর মধ্যে প্রায় ২৯.৮৩১.৪২ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের শুরু থেকে অর্থবছরের ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিভত ঋণ বিতরণ দাঁড়িয়েছে ১৮.৫৮০৭.৭৫ কোটি টাকা এবং আদায় ১,৭০,১৬৬.৩১ কোটি টাকা।

প্রশিকা: ১৯৭৫ সালে ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জের কয়েকটি গ্রামে প্রশিকার কার্যক্রম সূচিত হয়েছিল। পরে ১৯৭৬ সালে। সংস্থাটি আনুষ্ঠানিকভাবে বৃহত্তর পরিসরে কাজ শুরু করে। বর্তমানে প্রশিকা দেশের ৫৯ টি জেলার ২৪,২১৩ টি গ্রাম ও ২,১১০ টি বস্তিতে বসবাসরত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছে। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন খাতে ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত ৬,১৯০.৬৮ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে এবং একই সময় ঋণ নিয়ে উপকৃত হয়েছেন ২৭,৭৬,৩৪৪ জন দরিদ্র মানুষ।

শক্তি ফাউন্ডেশন: ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত শক্তি ফাউন্ডেশন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, কুমিল্লা, স্বগুড়া, রাজশাহীসহ অন্যান্য বড় বড় শহরের বস্তির দুস্থ মহিলাদের ঋণ প্রদান করে। এছাড়া এসব মহিলাদের স্বাস্থ্য, ব্যবসা ও সামাজিক উন্নয়নেও সংস্থাটি কাজ করে থাকে। বর্তমানে সংস্থাটি ৫৩ জেলায় ৪৫,১৮৪৮ জন সদস্যের মধ্যে সেবা প্রদান করছে । ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত সংস্থার বিতরণকৃত মোট ক্ষুদ্রঋণের পরিমাণ ৮,২৫০.৮৪ কোটি টাকা ও আদায়ের পরিমাণ ৭৫১১.৪০ কোটি টাকা।

ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস): টিএমএসএস জাতীয় পর্যায়ের সমাজ সেবামূলক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যা দারিদ্র্য দূরীকরণ, আর্থ - সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের ৫৭ টি জেলার ৩৪৬ টি উপজেলায় এর কর্মকাণ্ড বিস্তৃতি লাভ করেছে। ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত (৬৩,৭৮,১৫০ জন উপকারভোগীর মাঝে টিএমএসএস মোট ২৪,৯৪৪.৩৪ কোটি টাকা ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করেছে। উপকারভোগীর প্রায় ৯৬ শতাংশই মহিলা।

সোসাইটি ফর সোস্যাল সার্ভিস (এসএসএস): সমাজের দরিদ্র , অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত নারী - পুরুষ ও শিশুদের দারিদ্র্য বিমোচন , অধিকার আদায় ও তাদের শিক্ষা স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিসহ সমন্বিত সেবা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৮৬ সালের নভেম্বর মাসে সোসাইটি ফর সোস্যাল সার্ভিস ( এসএসএস ) আত্মপ্রকাশ করে । বর্তমানে দেশের ৩১টি জেলায় এবং ১৮৬টি উপজেলা এসএসএস - এর কর্মসূচি সম্প্রসারিত হয়েছে। প্রধান কার্যালয়ের অধীনে ১৩টি জোন, ৫৯টি এরিয়া, ৩৫৩ টি শাখা ও ৭ টি প্রকল্প অফিসের মাধ্যমে ৬,০০,৯০৬ জন সদস্যকে প্রত্যক্ষভাবে সেবা প্রদান করছে। উপকারভোগী ৯৮ শতাংশই মহিলা। অবশিষ্ট ২ শতাংশ পুরুষ ও শিশু। ডিসেম্বর, ২০১৮ পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিভূত ঋণ বিতরণ হয়েছে ১৫৯৩৮.৬৭ কোটি টাকা।

কারিতাস: দেশের পিছিয়ে পড়া দরিদ্র মানুষের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে তাদের উন্নয়ন শিক্ষার পাশাপাশি দারিদ্র বিমোচনে কারিতাস নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। বর্তমানে দেশের ২৬টি জেলার ৬২টি উপজেলায় কারিতাসের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত ২,৫৪,৮৬৭ জন উপকারভোগীর মাঝে কারিতাস মোট ৩,৯৮৪.০৭ কোটি টাকা ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করেছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url