প্রাক-ইসলামি আরবের ভৌগোলিক অবস্থান
আরব একটি ত্রিভুজাকৃতি উপদ্বীপ। এ দেশ তিনদিকে জল এবং এক দিকে বল দ্বারা পরিবেষ্টিত। এ জন্য আরব দেশকে আরবি ভাষায় ‘জাজিরাতুল আরব’ বা আরব উপদ্বীপ বলে অভিহিত করা হয় ইসলামের লীলাভূমি এ দেশ বিশ্বের অন্যতম ‘বৃহত্তম উপদ্বীপ’। এর উত্তরে সিরিয়ার মরুভূমি, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, পূর্বে পারস্য উপসাগর এবং পশ্চিমে লোহিত সাগর।
ধারণা করা হয়, প্রাচীনকালে হেজাজ অঞ্চলের তায়ামা প্রদেশের কাছে ‘আরাবা’ নামে যে একটি স্থান ছিল। সেটির নামানুসারে কালক্রমে উপদ্বীপটির নাম আরব হয়েছে। মতান্তরে দক্ষিণ আরবীয়দের কল্পিত পূর্বপুরুষ ক্লাহতানের পুত্র ইয়ারাবের নাম থেকে আরব নামের উৎপত্তি হয়েছে। আবার আরব শব্দটির সাথে হিব্রু ভাষার আবহার শব্দটির যথেষ্ট মিল আছে। দুটিরই অর্থ মরুভূমি। তাই আবহার শব্দ থেকেও উপদ্বীপটির নামকরণ আরব হতে পারে।
ভূতত্ত্ববিদদের মতে কোনো এক সময় আরব বৃহৎ মরুভূমি সাহারার একটি অংশ হিসেবে পরিগণিত হতো। কালক্রমে নীলনদ এবং লোহিত সাগর দ্বারা আরব আফ্রিকা মহাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সুয়েজ খাল খননের ফলে এটি সম্পূর্ণভাবে আফ্রিকা মহাদেশ হতে আলাদা হয়ে যায়।
প্রাক-ইসলামি আরবের গুরুত্ব
প্রাচীন বিশ্বের মানচিত্রে আরব দেশ তুলনাহীন এক অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী ছিল। আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কৃত হবার পূর্বে প্রাচীন বিশ্বের তিনটি মহাদেশ — এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার সংযোগ কেন্দ্র বলে বিবেচিত হতো। পাশ্চাত্য দেশগুলোর প্রাচ্যে প্রবেশের দ্বার হিসেবেও আরব দেশের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এ কারণেই মিশরীয় ও ব্যাবিলনীয় শাসকদের আমল থেকে অদ্যাবধি এ দেশটিতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো আধিপত্য বিস্তারে সদা তৎপর।
প্রাক-ইসলামি আরবের আয়তন
আরব ভূখণ্ডের আয়তন ১০,২৭,০০০ বর্গমাইল (২৬,৫৮, ৭৮১ বর্গ কিলোমিটার)) এবং প্রতি বর্গমাইলে মাত্র ৭ জন লোক বাস করে। আয়তনে এটি ইউরোপের এক চতুর্থাংশ এবং আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের এক - তৃতীয়াংশ। এটি সমগ্র দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের চেয়েও বড়। ভূপ্রকৃতি, আবহাওয়া ও উৎপন্ন দ্রব্য।
প্রাক-ইসলামি আরবের ভূ-প্রকৃতি
ভূপ্রকৃতি হিসেবে সমগ্র আরবকে মোটামুটি তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায়; যথা- উত্তর আরব, মধ্য আরব এবং দক্ষিণ আরব।
উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ আরব: উত্তর আরব প্রায়ই মরুময়। মরু অঞ্চল প্রধানত নুফুদ, সাহানা ও হাররাহ এ তিন ভাগে বিভক্ত। এ অঞ্চলের মধ্যে মধ্যে যেখানে মরুদ্যান রয়েছে, সেখানে হল পরিমাণ লোকালয় গড়ে উঠেছে। মধ্য আরবে আরবের বৃহত্তম মরুভূমি দাহনার কিছু অংশ বিদ্যমান থাকলেও প্রাচীনকাল হতেই সেখানে বেশ ক'টি নগর পরিলক্ষিত হয়। হেজাজ, নজদ ও আন - আশা এ তিনটি প্রদেশের সমন্বয়ে মধ্য আরব গঠিত। ইতিহাস প্রসিদ্ধ মক্কা নগরী হেজাজের রাজধানী। ইয়াসরিব, তায়েফ ও জেদ্দা হেলাজের আরও তিনটি প্রধান নগর। নজর আরবের বর্তমান সউদ বংশীয় বাদশাহদের জন্মভূমি। হাজরামাউত, ইয়েমেন ও ওমান নিয়ে দক্ষিণ আরব গঠিত। দক্ষিণ আরব অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। এ এলাকা ব্যবসায় - বাণিজ্য ও কৃষিকার্যের জন্যও বিখ্যাত।
ইয়েমেন শব্দের অর্থ সুখী’ এবং ইয়েমেন নাম হতেই উর্বর দক্ষিণ আরব ‘সুখী আরব ভূমি’ বা ‘সৌভাগ্য আরব’ (Arabia Felix) নামে প্রাচীনকালে অভিহিত হতো। বর্তমানে ইয়েমেন পৃথক রাষ্ট্র এবং ওমান মকটের সুলতানের শাসনাধীন রয়েছে। ঐতিহাসিক স্ট্র্যাৰো বলেন, “দক্ষিণ আরব অঞ্চল খুবই সমৃদ্ধ এবং সুগন্ধি দ্রব্যে ভরপুর দেশ।"
প্রাক-ইসলামি আরবের আবহাওয়া ও উৎপন্ন দ্রব্য
ঐতিহাসিক হিটির ভাষায়— “আরব অন্যতম সর্বাপেক্ষা শুষ্ক এবং গরমঘবান দেশ।'' (Arabia is one of the driest and hottest countries)
একাধিক ওয়াদি (wadi) থাকলেও সে দেশে নৌ - চলাচলের উপযোগী কোনো নদ - নদী নেই। আরবের এক তৃতীয়াংশ মরুময়, প্রকৃতির রুদ্র লীলাম্বল এবং মানুষের বসবাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য। এসব স্থান শুষ্ক, নিষ্ফরুণ, রৌদ্রদগ্ন ও বৃক্ষলতাদি শূন্য এবং সেখানে 'সুহ’ হাওয়া প্রবাহিত হয়। হেজাজের গড় তাপমাত্রা ৭০° ফারেনহাইট। কিন্তু ওমান, ইয়েমেন, তায়েফ প্রভৃতি স্থানে বছরে দুবার বৃষ্টিপাড় হয়। এসব এলাকা শস্য - শ্যামলা এবং আবহাওয়া মোটামুটি ভালো। এখানে কফি, নীল, শাক - সব্জি, ছাতা, ডুমুর, দাড়িহ, পিচ, খেজুর, ইন্দু, তরমুজ, লেবু ইত্যাদি জন্মে।
জীবজন্তু: উট, ঘোড়া, ভেড়া, দুম্বা, ছাগল, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি ছিল তাদের গৃহপালিত জন্তু। আরবের বন্য জন্তুর মধ্যে হায়েনা, বাঘ, সরীসৃপ, খেঁকশিয়াল প্রভৃতি সম্বন্ধে জানা যায়। বাজপাখি, কবুতর, ঈগল, হুদহুদ, ভিভিন্ন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের পাখি আরবে ছিল।
উট, ঘোড়া ও খেজুর গাছ: জীবজন্তুর মধ্যে উট ও ঘোড়া এবং গাছ - গাছড়ার মধ্যে খেজুর গাছ আরববাসীদের নিকট অত্যন্ত মূল্যবান। উটকে তারা প্রাণাপেক্ষাও প্রিয় মনে করে। সন্ত্রজীবনের একমাত্র সহায় ও সক্ষণ উট। উট তাদের নিকট মরুভূমির জাহাজ (The ship of the desert) এবং ব্যবসা - বাণিজ্য ও যাতায়াতের একমাত্র বাহন হিসেবে বিবেচিত হতো। উট অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু প্রাণী। উট শীতকালে ২৫ দিন এবং খ্রীষ্মকালে ৫ দিন। পানি পান না করেও কর্মক্ষম থাকে। উটের দুধ ও মাংস ছিল তাদের প্রিয় খাদ্যদ্রব্য। উটের চামড়া দ্বারা আরববাসী পোশাক - পরিচ্ছদ তৈরি এবং লোম ও চামড়া দ্বারা তাবু নির্মাণ করতো, এর মল দ্বারা জ্বালানি এবং সূত্র দ্বারা তারা মস্তিষ্ক রোগের প্রতিষেধক ঔষধ প্রস্তুত করতো।
যুদ্ধক্ষেত্রে উট ব্যবহৃত হতো এবং রক্তপাতের মূল্য, সুয়ারে পল, বিবাহের যৌতুকও উটের বিনিময়ে প্রদত্ত হতো। শেষের ঐশ্বর্যও উট দ্বারা পরিমাপ করা হতো। পবিত্র কুরআন মঞ্জিলে উটকে আরববাসীর জন্য এক বিশেষ নেয়ামত বা অবদান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ১৬০৫৬৮ আরবের প্রখ্যাত কবিগণ তাঁদের বিভিন্ন কবিতায় উটের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।
হযরত ওমর (রা) বলেন , “উট যেখানে উন্নত, আরবরাও সেখানে উন্নত " (The Arab prospers only where the camel prospers) আরব দেশে উটের পরেই ছিল ঘোড়ার স্থান। আরবের ঘোড়া বিশ্ববিখ্যাত।
খেলাধুলা, শিকার, লুটতরাজ ও যুদ্ধ - বিল্লাহে আরববাসী ঘোড়াকে ব্যবহার করতো। খ্রিস্টের জন্মের দুই হাজার বছর পূর্বে ঘোড়ার প্রচলন পরিদৃষ্ট হয় পশ্চিম এশিয়ায় এবং খ্রিস্টের জন্যের শুরুতেই সিরিয়া থেকে আরব দেশে ঘোড়া আমদানি করা হয়। আরবীয় ঘোড়ার প্রলুভক্তি , খ্যাতি ও বাহাদুরী সর্বজনবিদিত। বেদুইনদের আকস্মিক ও ঝটিকা আক্রমণে গতি সঞ্চারের জন্য ঘোড়ার প্রয়োজনীয়তা ছিল অত্যধিক।
প্রফের হিট্টি বলেন, 'ক্রুসেড আমলে বিলেতি ঘোড়া পূনরায় আরবীয় ঘোড়ার সামিশ্রণে নতুনত্ব লাভ করে। গাছ - গাছড়ার মধ্যে' খেজুর গাছ আরববাসীর নিকট ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। আরব দেশে খেজুর গাছ "queen" বা 'রাণী’ গাছ নামে সমধিক প্রসিদ্ধ।
প্রায় এক শ' প্রকারের খেজুর আরব দেশে পরিলক্ষিত হতো। খেজুর ছিল তৎকালীন আরববাসার প্রধান খাদ্য। এর রস ছিল তাদের প্রিয় পানীয়। সে দেশে গৃহ নির্মাণের কাজে, মাদুর ও দড়ি তৈরি, জ্বালানি কাঠরূপে এবং বিভিন্ন প্রকারের কাজে খেজুর গাছ ব্যবহৃত হতো। খেজুর বীজের গুঁড়া উটের জন্য এক প্রকার বিশেষ ধরনের খাদ্য ছিল। আমির - ফকির নির্বিশেষে প্রতিটি আরববাসীর অকৃত্রিম বন্ধু ছিল খেজুর। খেজুর আরববাসীর জীবন ধারণের জন্য ছিল অপরিহার্য।