কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যাবলি সমূহ || Functions of the Central Bank

ব্যাংকের সংজ্ঞা 
ব্যাংক অর্থ ও ঋণের ব্যবসায়ে নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠান। ইংরেজি Bank শব্দটি কোথা থেকে উৎপত্তি হয়েছে বা কখন থেকে প্রচলিত এ নিয়ে মত পার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন জার্মান শব্দ 'Banck' থেকে Bank শব্দটি এসেছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন Bank শব্দটি এসেছে ইতালির ' Banco ' শব্দটি থেকে। ব্যাংক হচ্ছে এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অর্থ আমানত হিসেবে জমা রাখে এবং জমাকৃত অর্থ অলসভাবে ফেলে না রেখে বরং ব্যবসায় - বাণিজ্য, উৎপাদন বা ভোগের নিমিত্তে ঋণদান করে থাকে । সংগৃহীত আমানত অর্থের উপর আমানতকারীকে অপেক্ষাকৃত কম সুদ প্রদান করে কিন্তু ঋণগ্রহণকারীর উপর চড়া সুদ আরোপ করে। প্রাপ্ত সুদের উদ্বৃত্ত অংশই ব্যাংকের মুনাফা সৃষ্টি করে । অর্থনীতিবিদগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাংককে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন— 

অর্থনীতিবিদ জিওফ্রে ক্লাউথার - এর মতে, “ব্যাংক তার নিজের ও অন্য লোকের ঋণের ব্যবসা করে।”

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ রিচার্ড সিডনি সেয়ার্স ( ১৯০৮-১৯৮৯ ) -এর মতে , “ব্যাংক এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার ঋণ অন্যান্য লোকের ঋণ পরিশোধের জন্য গৃহীত হয়।"

অধ্যাপক কেয়ার্নক্রসের মতে , “আর্থিক মধ্যস্থতাকারী ধার ও ঋণের কারবারি প্রতিষ্ঠানই ব্যাংক।” 
সুতরাং বলা যায় যে, ব্যাংক হলো এমন একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যা মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে স্বল্প সুদের হারে জনগণের কাছ থেকে তাদের সঞ্চয় ও উদ্বৃত্ত আমানত হিসেবে গচ্ছিত রাখে ; উচ্চ সুদের হারে আমানতকৃত অর্থ থেকে ঋণ প্রদান করে এবং সকল আর্থিক লেনদেন চেক গ্রহণ ও প্রদানের মাধ্যমে সম্পন্ন করে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাকে বলে?
কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলো এমন একটি একক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান যা সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে থেকে মুদ্রা বাজারের অভিভাবক হিসেবে কাজ করে। মুনাফা অর্জন নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও জনগণের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনই এ ব্যাংকের মূল উদ্দেশ্য। অর্থনীতিবিদগণ বিভিন্নভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

অধ্যাপক ভেরা স্মিথ ( ১৯১২-১৯৭৬ ) বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং বলতে মূলত এমন একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে কেবল একটি ব্যাংকের নোট প্রচলনের একমাত্র অধিকার থাকে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অধ্যাপক আর. পি. কেন্ট বলেন, "এটিকে এমন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায় যা জনকল্যাণার্থে দেশের প্রচলিত মুদ্রার পরিমাণ , প্রসার ও সংকোচন - সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত।"

আন্তর্জাতিক লেনদেন নিষ্পত্তির জন্য ব্যাংক আইন মোতাবেক, "একটি দেশের মুদ্রা ও ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব যে ব্যাংকের ওপর ন্যস্ত থাকে তাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে।"

সুতরাং বলা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলো এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যার ওপর মুদ্রা প্রচলনের একচেটিয়া অধিকার ন্যস্ত থাকে। এ প্রতিষ্ঠানটি সরকার ও অন্যান্য ব্যাংকের ব্যাংকার, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রক, ঋণের পরিমাণ ও ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করে । মুনাফা অর্জন নয় বরং জনকল্যাণের উদ্দেশ্যেই কাজ করে যাওয়া এ ব্যাংকের মূল উদ্দেশ্য। পৃথিবীর প্রত্যেক দেশেই একটি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আছে। যেমন— বাংলাদেশে 'বাংলাদেশ ব্যাংক’, ইংল্যান্ডে ‘ব্যাংক অব ইংল্যান্ড' , ভারতে ‘রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া' প্রভৃতি।


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যাবলি সমূহ
একটি দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানামুখী কার্যাবলি সম্পাদন করে। কাজের প্রকৃতির ভিন্নতা অনুযায়ী এর কার্যাবলিকে নিম্নোক্তভাবে পাঁচ শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যথা— 
ক. সাধারণ কার্যাবলি 
খ. সরকারের ব্যাংক হিসেবে সম্পাদিত কার্যাবলি 
গ. দেশের সকল ব্যাংক এর ব্যাংকার হিসেবে  কার্যাবলি  
ঘ. উন্নয়নমূলক কার্যাবলি এবং 
ঙ. অন্যান্য কার্যাবলি।

নিচে বিভিন্ন কার্যাবলি সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো: 
ক. সাধারণ কার্যাবলি: কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিম্নলিখিত সাধারণ কার্যাবলি সম্পাদন করে-
১. নোট ও ধাতব মুদ্রা প্রচলন: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কাজ হলো দেশের জনগণ ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রয়োজনানুযায়ী নোট ও ধাতব মুদ্রা প্রচলন করা। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একচেটিয়া অধিকার। নোট প্রচলনের জন্য ব্যাংকটি প্রচলনকৃত নোটের মূল্যের বিপরীতে একটি নির্দিষ্ট শতাংশ স্বর্ণ, রৌপ্য বা বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ রাখে।

২. মুদ্রার মান সংরক্ষণ: এ ব্যাংক মুদ্রার যোগানের হ্রাস - বৃদ্ধি ঘটিয়ে দেশীয় মুদ্রার মান তথা ক্রয়ক্ষমতা সংরক্ষণ করে। আবার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করে এটি আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় মুদ্রার মান সংরক্ষণ করে। 

৩. ঋণ নিয়ন্ত্রণ: এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ ব্যাংক দেশে মুদ্রার যোগান নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের পরিমাণ ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে। ঋণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এ ব্যাংক ব্যাংক হার পরিবর্তন নীতি, খোলাবাজার নীতি, ব্যাংক জমার হার পরিবর্তন নীতি, ঋণের বরাদ্দকরণ ইত্যাদি পদ্ধতি অবলম্বন করে।

৪. মুদ্রা বাজার নিয়ন্ত্রণ: এ ব্যাংক দেশের মুদ্রা বাজারের অভিভাবক হিসেবে কাজ করে। মুদ্রা বাজারের পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে এ ব্যাংক দেশে মুদ্রা ও ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রার সরবরাহে স্থিতিশীলতা রক্ষা, বিনিময় হার নির্ধারণ ও বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলি পর্যবেক্ষণ করে।

৫. বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ: একটি দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের সফলতা অনেকাংশে বৈদেশিক মুদ্রার সূষ্ঠ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ওপর নির্ভর করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রার বৈদেশিক মূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিময় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

৬. দামস্তরের স্থিতিশীলতা রক্ষা: মুদ্রা সরবরাহের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশে দামস্তরের স্থিতিশীলতা রক্ষা করে। এ উদ্দেশ্যে এ ব্যাংক মুদ্রা বাজারের মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। 

খ. সরকারের ব্যাংক হিসেবে সম্পাদিত কার্যাবলি: বর্তমানকালে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক সে দেশের সরকারের ব্যাংকার হিসেবে কাজ করে । সরকারের ব্যাংকার হিসেবে এর কার্যাবলি নিম্নরূপ: 
১. সরকারের তহবিল সংরক্ষণ, 
২. অর্থ জমা, গ্রহণ ও স্থানান্তর, 
৩. সরকারের হিসেব সংরক্ষণ, 
৪. সরকারের উপদেষ্টা ও প্রতিনিধি, 
৫. সরকারের বিভিন্ন নীতির বাস্তবায়ন এবং 
৬. সরকারের ঋণের উৎস। 

গ. দেশের সকল ব্যাংকের ব্যাংকার হিসেবে সম্পাদিত কার্যাবলি: কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের অন্যান্য ব্যাংকেরও ব্যাংকার। সে হিসেবে তাকে নিম্নোক্ত কার্যাবলি সম্পাদন করতে হয়- 
১. ব্যাংক গঠন ও সম্প্রসারণ, 
২ . সদস্য ব্যাংকগুলোর নগদ রিজার্ভের আমানতকারী,
৩. ঋণের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল, 
৪. নিকাশঘর হিসেবে কাজ এবং 
৫. বিভিন্ন উপায়ে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোকে সাহায্য করা।

ঘ. উন্নয়নমূলক কার্যাবলি: কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্যও নানা ধরনের কাজ করে থাকে।
১. বৈদেশিক বাণিজ্যের উন্নয়ন: কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রেখে বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসারে সহায়তা করে। বিশেষত সরকারকে বাণিজ্যনীতি নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরমার্শ কেন্দ্রীয় ব্যাংকই দিয়ে থাকে।

২. কৃষি ও শিল্প উন্নয়ন: একটি দেশের কৃষি ও শিল্প খাতের উন্নয়নে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে বিভিন্ন নীতি (যেমন- নৈতিক প্ররোচনা) নির্ধারণের মাধ্যমে ঋণ সহায়তা দিয়ে থাকে।

৩. অর্থনৈতিক উন্নয়ন: কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি দেশের অনুন্নত ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী আর্থিক নীতি তৈরি ও বাস্তবায়ন করে সরকার উন্নয়নমূলক কাজে সাহায্য করে থাকে।

৪. সমবায় ব্যাংকের উন্নয়ন: কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমবায় ব্যাংকের উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে থাকে।

ঙ. অন্যান্য কার্যাবলি: নিন্মোক্ত কার্যাবলী লক্ষ্য করা যায়:
১. গবেষণা: একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য নতুন নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গবেষণা করে থাকে।

২. তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ: সরকারের ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের ব্যাংকার হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করে।

৩ . রিপোর্ট তৈরি: কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশ - বিদেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতির তথ্য সংগ্রহ করে গবেষণা ও রিপোর্ট তৈরি করে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url